বৃহস্পতিবার - মে ৯ - ২০২৪

ক্রেতার চাহিদা : বৃত্তের বাইরে

ছবিখুসলি তাহ ধাহ

হাইওয়েতে একজন গাড়িচালক যখন দ্রæতগতিতে ধাবমান হয় তখন স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে শুধু উইন্ডশিল্ড দিয়ে সামনে তাকানোই কিন্তু যথেষ্ট নয়, রিয়ার ভিউ মিররে মাঝে মাঝে পেছনে তাকাতে হয়। পাঠক, মনে করুন আপনি একজন সময়ের যাত্রী। চলুন রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে পেছনের দিকে তাকাই।

ষাট বা সত্তরের দশকে ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের জীবনধারা ছিল অনেকটাই নিস্তরঙ্গ। মধ্যবিত্ত মানুষের চাহিদাও ছিল সীমিত। বিনোদন বলতে ছিল সিনেমা হলে সামাজিক চলচ্চিত্র দেখা, রেডিওতে গান শোনা। ঘরে ঘরে তখন টেলিভিশন ছিল না। উত্তম সুচিত্রার রোমান্টিক ছবি বা রাজ্জাক কবরীর রংবাজ তখন তুমুল ঝড় তুলতো তরুণ তরুণীর মনোজগতে। বলা যায়, আশির দশক থেকেই চলচিত্রে শুরু হল ধুমধারাক্কা, যৌনতা, মারামারি, খুন-খারাপী ইত্যাদির আধিক্য। নব্বইর দশকে রুচি বা চাহিদা আরো তীব্র হলো। পরিচালক ডেভিড ক্যামেরুনের ‘মেট্রিকস’ ধারার মুভি নিয়ে এলো যন্ত্রদানবদের অবিশ্বাস্য সব কাÐ কারখানা। তার সাথে যুক্ত হল ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ার, হরর মুভির ভয়ানক ভৌতিকতা। ছাপার অযোগ্য ভাষা চলে এলো সিনেমার সংলাপে।

- Advertisement -

চলচ্চিত্র নির্মাতারা দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী এমন সব সিনেমা তৈরি করা শুরু করলো যা গত প্রজন্মের গতানুগতিক চিন্তাভাবনা বা রুচির বৃত্তের বাইরে। সেন্সর বলতে রইলো শুধু ধুমপানের ওপর সতর্কবাণী। আর বাকি সব কিছু ছাড় পেয়ে গেল।

এককালের জনপ্রিয় চরিত্র জেমস বন্ডের প্রভাব ¤øান হয়ে গেল। রাস্তায় ‘কার চেইজ’ আর বন্দুকযুদ্ধ দর্শককে সিনেমা হলে টেনে রাখতে পারছে না। তার পরিবর্তে টিনএজারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, ড্রাকুলা এবং ভ্যাম্পায়ার ধরনের চরিত্র। সুপারহিট মুভির তালিকায় চলে এলো স্টার ট্রেক, ব্যাটম্যান, দি ম্যাট্রিকস রিলোডেড, লর্ড অব দ্যা রিংস এর মত ছবি। লক্ষ্য করলে বুঝে নিতে কষ্ট হয় না এসব সিনেমার চাহিদার কারণ। এখনকার প্রজন্ম চায় স্বাভাবিক বৃত্তের বাইরের উপাদানÑ যেখানে এলিয়েনের ছদ্মবেশে এসেছে ভায়োলেন্স, ভয়ানকতা এমনকি বিকৃত অবয়ব।

চলুন, সিনেমার পর্দা থেকে চোখ ফেরাই টেলিভিশনের দিকে। সত্তর বা আশির দশকে টিভি বিনোদনের মূল আকর্ষন ছিল নাটক, গানের আসর বা আনন্দ মেলা ইত্যাদি ধরনের ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। নব্বইয়ের দশকে স্যাটেলাইট টিভির আগমণ দর্শকদের রুচি বা পছন্দের দরজায় এসে হানা দিল। আকাশ সংস্কৃতির নামে ঘরে ঘরে উড়ে এলো নানা রঙের দেশী বিদেশী পাখি। সংবাদ, সংগীত, ক্রীড়া, সিনেমা, ভ্রমণ, রান্নাবান্না, কার্টুন থেকে শুরু করে রিয়েলিটি শো পর্যন্ত নানা ধরনের চ্যানেলের আগমণ ঘটলো। একদিকে যেমন ঘটেছে বিষয়ের ব্যাপ্তি অন্যদিকে এসেছে রুচি ও স্বাদের ভিন্নতা। লক্ষ্য করলে দেখবেন এই রুচির ভিন্নতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে এক ধরনের তীব্রতা আর মেকীময়তা। হিন্দী টিভি সিরিয়ালে এসেছে নেতিবাচক চক্রান্ত এবং সাজগোজের আধিক্য। ইংরেজি সিরিয়ালে স্থান পেয়েছে যান্ত্রিক দানব, বন্যতা, যৌনতা কিংবা চরম ভৌতিকতা। কনজুমারিজমের নামে বিজ্ঞাপনের আধিক্য প্রায় অসহনীয়। শপিং চ্যানেলের তেলেসমাতি যেন যাদুকরের অবিশ্বাস্য খেলা। রিয়েলিটি শোর নাটকীয়তা যে কোনো মেকীময়তাকে হার মানাবে।

খেলাধূলার বিনোদনেও এসেছে উম্মত্ততা। আজকের প্রজন্ম ক্রিকেট বা ফুটবলের মত সাধারণ খেলাধূলায় আর সন্তুষ্ট নয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বাঙ্গিজাম্প বা স্কুবা ডাইভিং এর রোমাঞ্চকর স্বাদ নিতে প্রস্তুত। আধুনিক থিম পার্কের রাইডগুলো দিনকে দিন হয়ে পড়ছে ভয়ংকর রকমের ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক অর্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আজকের গ্রাহক শিহরিত হতে চায় চরম উত্তেজনায়। সেইদিন গত হয়েছে যখন বালক বালিকারা মেরি গো রাউন্ড বা নাগর দোলার চক্রে সন্তুষ্ট ছিল। স্কাইফলের মত দুর্দান্ত রাইডে এই প্রজন্ম আনন্দ খুঁজে বেড়ায়।

সংগীতেও এসেছে এক ধরনের চরম উম্মাদনা। আগের দিনের মেলোডী যেন হারিয়ে গেছে সময়ের অন্তরালে বা আগের প্রজন্মের হৃদয়ের গভীরে। পশ্চিমের হার্ড রক বা মেটালিক সংগীত ছাড়া কনসার্ট জমে ওঠে না। টপ চার্টের একটা প্রিয় গান বারবার শোনার জন্য ক্রেতা কিনছে পুরো গানের এ্যালবাম। নৃত্যেও এসেছে পরিবর্তন। পশ্চিমে রক এন্ড রোলের পর এসেছে হার্ড রক, তারপর মেটাল এবং হেভি মেটাল। নৃত্যের ক্ষেত্রেও এসেছে ব্রেকড্যান্স, হিপহপ ইত্যাদি দ্রæত ড্রামবিট নৃত্য। লক্ষ্য করলে দেখবেন যে ক্রমেই এক ধরনের তীব্রতা বা চুড়ান্ত উম্মাদনার পেছনে ছুটছে দর্শক শ্রোতা।

গাড়ির ক্রেতার চাহিদায়ও একই ধরনের ক্রেইজ লক্ষ্য করা যায়। বিত্তবান গ্রাহক আর সাধারণ সিডান গাড়িতে সন্তুষ্ট নয়। চাহিদা বেড়েছে বিলাসবহুল স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেইকল বা লাক্সারি কারের। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় শহরের অলি গলি পথে এই ধরনের গাড়ি মোটেই উপযোগী নয়। কিন্তু ক্রেতার মন তা মানতে রাজি নয়। তার মন জুড়ে আছে এক ধরনের আবিষ্টতা। শুধু প্রেমিকাকে আকৃষ্ট করা নয়, নিজের মর্যাদার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই ধরনের গাড়ির মালিকানায়। পশ্চিমে ক্যাডিলাক বা বিএমডবøু অনেকের কাছেই পেশাগত সাফল্যেরও বহিঃপ্রকাশ।

আমেরিকার প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার রাফ লরেনকে আমেরিকান ড্রিম বিপণনে তার ভূমিকার কথা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। প্রত্যুত্তরে তিনি বলেছিলেন যে, ‘মানুষ তার নিজের স্বপ্নকে প্রকাশ করার বাসনা নিয়ে ফ্যাশনের আশ্রয় নেয়’। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন কোনো ভাল মুভি দেখেন বা বাস্তবে সফল কাউকে তার ভূমিকায় দেখেন তখন সেই চিত্রটা মনের ভেতর গেঁথে যায়। ক্যারিগ্রান্টকে আমি পছন্দ করি কারণ সে যে ভূমিকায় অভিনয় করেছে তার জন্য। আমার মনের মধ্যে সেই রূপটা অনুভব করি’। তার বিখ্যাত পোলো ব্রান্ড সমন্ধে তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় পোলোর স্বপ্ন দেখতাম। আমার পোশাকে সবসময় আমার মুড আর স্টাইলের প্রতিফলন ঘটে। যেমন ধরুন, ‘টুইড জ্যাকেট’ এটা আমার মধ্যে স্বপ্ন জাগিয়ে দিত- আমি যা হতে চাইতাম’। যৌবনে রাফ লরেন বিখ্যাত ফ্যাশন হাউস ব্রæক ব্রাদার্সে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। রাফ বলেন, ‘একদিন ব্রæক ব্রাদার্স থেকে বের হয়ে আসার পথে ত্রিশ দশকের ডাক সাইটে অভিনেতা ডগলাস ফেয়ার ব্যাংকস্ আমার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন। ওনার বয়স তখন মধ্য পঞ্চাশ, পরনে ছিল ডবল ব্রেস্টেড স্যুট এবং ছড়ানো কলার শার্ট। তাঁকে দেখতে দারুণ লাগছিল। ভেবে দেখলাম এই বয়স্ক ভদ্রলোকের ভঙ্গিতে এমন একটা কিছু ছিল যা আমি আমার আশে পাশের কারো মধ্যেই খুঁজে পাই না। সেই সময় ‘কুকি-কাটার’ পোশাক, বাটন ডাউন শার্ট আর সরু টাই পরার চল ছিল। আর আমি চাইতাম ছড়ানো কলার, চওড়া টাই এবং মানানসই স্যুট। মূলত ডগলাসের অনুপ্রেরণায় আমি বাজারে নিয়ে আসি নতুন ট্রেন্ড চওড়া টাই আর ছড়ানো কলার শার্ট’। রাফ লরেনের ভাষায়, ফ্যাশন ডিজাইনাররা মানুষের ভেতরের স্বপ্নকে জাগিয়ে দেনÑ তারা যেভাবে নিজেকে দেখতে চায়। একইভাবে সিনেমা পরিচালকরাও সেইসব উপাদান চলচ্চিত্রে নিয়ে আসেন যা দর্শকরা দেখতে চায়। এখানে গ্রাহকের চাহিদার বিষয়টিই মুখ্য।

লক্ষ করলে দেখা যাবে গত দুই দশকে গ্রাহক চাহিদায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বিশ্বায়নের প্রভাবে এই পরিবর্তন এখন সর্বব্যাপী। পাশ্চাত্যের যেকোনো ফ্যাশন রূপান্তরিত হয়ে ফিরে আসছে এখন পূর্বে। আধুনিক শহুরে জীবনধারার বিভিন্ন অনুষঙ্গ প্রাধান্য পেয়েছে গ্রাহক চাহিদায়। যেমন সফল ব্যবসায়ী বা নির্বাহীদের চাহিদার তালিকায় এসেছে গলফ ক্লাব মেম্বারশিপ, বিলাসবহুল অ্যাপার্টম্যান্ট, বিমানের বিজনেস ক্লাস, এয়ারপোর্টে প্রিমিয়াম লাউঞ্জ, প্রায়োরিটি সার্ভিস ইত্যাদি। ভার্জিন কোম্পানির মহাশূন্যযান গ্যালাকটিকায় মহাকাশ ভ্রমণের জন্য উদগ্রীব এক শ্রেণির গ্রাহক। এসব প্রত্যাশা পূরণের জন্য ক্রেতা পণ্য মূল্যের ব্যাপারে মোটেই স্পর্শকাতর নয়। বিমানের বিজনেস ক্লাসের যাত্রী আরাম আয়েশের পাশাপাশি নিজেকে পৃথক শ্রেণি বিন্যাসে দেখতে চায়। আবার তরুণ প্রজন্ম চায় বাঙ্গি জাম্প বা স্কুবা ডাইভিং-এ ঝুঁকি নেয়ার আনন্দ।

চুড়ান্ত বিশ্লেষণে এই বিষয়টি প্রতিয়মান হয় যে, আজকের দিনে বৃত্তের বাইরে একশ্রেণির ক্রেতার চাহিদা তৈরি হয়েছে। এই চাহিদা যতটা না প্রয়োজনের তারচেয়ে বেশি অনুভবের। সব ক্রেতাই যে অর্থের বিনিময়ে মানসম্পন্ন পণ্য চায় তা নয়, এই গতানুগতিক বৃত্তের বাইরে ক্রেতার চাহিদা ব্যাপ্তি পেয়েছে ব্যক্তির বিকাশে। এই বিকশিত চাহিদাকে যুক্তি দিয়ে বিচার করা যাবে না। চাহিদা নির্ধারণে ক্রেতার রুচি, পছন্দ এবং আবেগ বা অনুভূতি এখানে মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচ্য।

- Advertisement -

Read More

Recent