সোমবার - মে ২০ - ২০২৪

ব্যবসায়িক কৌশল: গ্রুভের সাফল্যের মন্ত্র

ছবিসেলেজম্যান গোভারজেব

ইন্টেলের প্রাক্তন প্রধান নির্বাহী এন্ড্রু গ্রুভ নব্বইর দশকে তার বিখ্যাত বই ঙহষু ঃযব চধৎধহড়রফ ঝঁৎারাব প্রকাশ করে ব্যাপক সাড়া জাগান। চধৎধহড়রফ শব্দটির বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ’। চধৎধহড়রধ মূলত এক ধরনের মানসিক রোগ। কিন্তু লেখক ‘চধৎধহড়রফ’ শব্দটি কিছুটা ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। গ্রুভ বলেছেন যে ব্যবসা জগতে পরিবর্তন এবং প্রতিযোগীর আক্রমণ কোনো দিক থেকে আসবে সেটা আগে থেকে সহজে বোঝা যায় না। সেই কারণে একজন সফল নির্বাহীকে সবসময় তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে কাজে লাগাতে হবে।

একটি বাস্তব উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো খোলাসা হবে। ২০০৭ সালে এ্যাপেল কর্পোরেশন টাচ স্ক্রিন ইন্টারফেসসহ বাজারে নিয়ে আসে স্মার্টফোন। এর আগে নিউমেরিক কীবোর্ড নিয়ে নোকিয়া ছিল প্রথম সারির জনপ্রিয় সেলফোন। আর পদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে ব্লাকবেরি ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল। কিন্তু অভিনব প্রযুক্তি আর আকর্ষণীয় ফিচার নিয়ে  এ্যাপেলের আইফোন এবং পরবর্তীতে এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিষ্টেম সমর্থিত স্যামসাং এর স্মার্টফোন দ্রুত বাজার দখল করে নিল। ক্রমশ পিছিয়ে পড়ল নোকিয়া এবং ব্লাকবেরি। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে নোকিয়া বিক্রি হয়ে গেল মাইক্রোসফটের কাছে। স¤প্রতি মাইক্রোসফট ঘোষণা দিয়েছে যে, নোকিয়া লুমিয়া ব্রান্ডের পর এই ব্রান্ডের কোনো স্মার্টফোন আর বাজারে ছাড়বে না। পরিবর্তনকে আগে থেকে আঁচ করতে না পারা এবং সেই অনুযায়ী বাজার চাহিদার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারায় পতন হল নোকিয়ার মত একটি জনপ্রিয় ব্রান্ডের। ব্লাকবেরি অবস্থাও তথৈবচ।

- Advertisement -

পরিবর্তনের এই গোলযোগে এন্ড্রু গ্রুভ কোনো আগন্তুক নন। গ্রুভের জন্ম হাঙেরিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি পালিয়ে চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে। রেস্টুরেন্টে বাসবয় হিসাবে কাজ করে পড়াশোনা চালিয়েছেন। নিউ ইয়র্কের সিটি কলেজ থেকে কেমি প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে থেকে ডক্টরেট সনদ অর্জন করেন। ফেয়ারচাইল্ড কোম্পানিতে সেমিকন্ডাকটর নিয়ে কিছুদিন গবেষণার কাজ করার পর ১৯৬৮ সালে মাইক্রোচিপ প্রস্তুতকারক ইন্টেলে যোগ দেন। ইন্টেলের দুই বিখ্যাত সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট নয়েস ও গর্ডন মোর ছিলেন গ্রুভের প্রাক্তন সহকর্মী।

ইন্টেল প্রথমদিকে ডায়নামিক মেমোরি চিপ তৈরি করতো। ১৯৭৬ সালে জাপানের তৈরি কমদামী মেমোরি চিপস মার্কিন বাজারে প্রবেশ করে। ইন্টেলের পক্ষে মূল্য প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়লো। বাজারে উৎপাদন খরচ এবং অসম প্রতিযোগিতার বিষয়টি আঁচ করে অপারেশন ডিরেক্টর গ্রুভ ইন্টেলের প্রডাক্ট লাইন এবং বিপণন কৌশলে আমূল পরিবর্তন আনলেন। ইন্টেল মাইক্রো চিপস এর বদলে মাইক্রোপ্রসেসর তৈরি করা  শুরু করলো। একই সাথে আইবিএম কম্পিউটারে ইন্টেল মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবহার করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে আবদ্ধ হল। গ্রুভের এই সময়োপযোগী কৌশল পরিবর্তনের কারণে ইন্টেল তার ব্যবসায়িক মন্দা কাটিয়ে ওঠে এবং সাফল্যের পথে এগিয়ে যায়। ব্যবসা প্রশাসনের ভাষায় পণ্য চক্রের এই পরিবর্তনকে বলা হয় সিগময়েড কার্ভ। পরবর্তী ত্রিশ বছরে গ্রুভ বিভিন্ন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করে ইন্টেলকে মহীরূহ কোম্পানিতে পরিণত করেন। গ্রুভ ১৯৮৭ সালে ইন্টেলের প্রধান নির্বাহী এবং ১৯৯৭ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ইন্টেলের ক্রমাগত ব্যবসায়িক সাফল্যের কারণে টাইম ম্যাগাজিন ১৯৯৭ সালে এন্ড্রু গ্রুভকে ম্যান অব দ্য ইয়ার ঘোষণা করে। আর আমেরিকার আইভী লীগের বিখ্যাত ওয়াটন বিসনেস স্কুল তাঁকে গত পচিশ বছরের মধ্যে ব্যবসায়িক অঙ্গনে তাকে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বাণিজ্য জগতে পরিবর্তন প্রতিনিয়তশীল (ঈযধহমব রং পড়হংঃধহঃ) এই মন্ত্রের প্রবক্তা হলেন এন্ড্রু গ্রুভ।

গত তিন দশকে প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে আমরা দেখেছি অনেক পণ্যের বিলুপ্তি ঘটেছে। এমনকি এই পরিবর্তনের সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে না পারার কারণে অনেক কোম্পানি হয়েছে ধুসর ইতিহাস। এক সময়ের বিখ্যাত কোডাক কোম্পানি সত্তর ও আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের ফিল্ম এবং ফটোগ্রাফি জগতের প্রায় নব্বই ভাগ বাজার নিয়ন্ত্রণ করতো। নব্বইর দশকে বাজারে এল ডিজিটাল ফটোগ্রাফির প্রযুক্তি। প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের সাথে কোডাক কোম্পানি তাদের ব্যবসায়িক কৌশল পরিবর্তন করে বাজার চাহিদার সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনি। পরবর্তীতে কোডাক কোম্পানি অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে এবং দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু একই সময়ে কোডাকের প্রতিদ্বন্দ্বী জাপানি ফুজি কোম্পানি সফলতার সাথে সেলুলয়েড ফিল্ম থেকে ডিজিটাল মিডিয়ায় তাদের পণ্যের দ্রুত রূপান্তর (ঞৎধহংভড়ৎসধঃরড়হ) ঘটিয়েছে। ডিজিটাল ক্যামেরা ছাড়াও স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিশেষত এক্সরে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই করার জন্য ফুজিফিল্ম এবং ফুজি মেশিন বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে।

এছাড়াও আমরা গত দুই দশকে লক্ষ্য করেছি গানের ভিনাইল রেকর্ড পরিবর্তিত হয়ে ম্যাগনেটিক ক্যাসেট আকারে বাজারে এসেছে এবং পরবর্তীতে সিডি ডিভিডি থেকে রূপান্তর ঘটেছে ডিজিটাল মিডিয়ায়। শুধু প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নয়, অর্থ বাজার এবং পুঁজি বাজারেও সময়ের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারার জন্য অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পতন ঘটেছে। ২০০৮ সালে মেরিল লিনচ (গবৎৎরষষ খুহপয) অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে এবং ব্যাংক অব আমেরিকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। একই সময়ে লেম্যান ব্রাদার্স (খবযসধহ ইৎড়ঃযবৎং) তারল্য সংকটে পড়ে দেউলিয়া হয়ে পড়ে। বিখ্যাত রিটেইল চেইন কে মার্ট, রেডিও শ্যাক এবং সিয়ার্স আজ সংকটে পড়ে বিপর্যস্ত।

গ্রুভ এক অর্থে ডারউইনের ‘সারভাইভাল থিয়রি’কে ব্যবসায়ীক সাফল্যের সাথে সস্পর্কিত করেছেন। অর্থাৎ শক্তিশালী ও বুদ্ধিমান হলেই চলবে না, বেঁচে থাকতে হলে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলার যোগ্যতা থাকতে হবে। প্রকৃত প্রস্তাবে, প্রতিযোগিতাই হল মূল চালিকাশক্তি যা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সম্পৃক্ত হতে এবং উদ্ভাবণী উদ্যোগ নিতে উদ্ধুদ্ধ করে।

কর্মীদের মেধা বিকাশ, উদ্ভাবণী ক্ষমতার প্রকাশ এবং নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়ার জন্য গ্রুভ ক্রমাগত উৎসাহিত করে গেছেন। তিনি ইন্টেলে এমন এক সংস্কৃতি তৈরি করেন যাতে করে তার ব্যবস্থাপকরা গতানুগতিক ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং আগামীর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।  এই প্রসঙ্গে এই সময়ের সবচেয়ে সফল কোম্পানি গুগলের কর্ম পরিবেশের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সন্টাক্লারার মাউন্টেন ভিউতে ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয় গুগলের সদর দপ্তর। এই সদর দপ্তরকে বলা হয় গুগলপ্লেক্স। প্রায় ২৬ একর জমির উপর ২২টি অফিস ভবনের সদর দপ্তরে কাজ করেন ১০ হাজার কর্মী। গুগলের কর্মীদের গুগলার বলা হয়। অফিস ভবন ছাড়াও গুগল সদর দপ্তরে রয়েছে বিনোদন পার্ক, খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, ব্যায়ামাগার, রেস্তোরা ইত্যাদি। গুগলারদের জন্য ধরাবাধা নয়টা-পাঁচটার কর্মঘণ্টা বেঁধে দেয়া নেই। অফিসে নেই কোনো নির্দিষ্ট কাজের টেবিল। যে কেউ যেকোনো সময় অফিসে আসতে পারে এবং যে যার পছন্দ অনুযায়ী জায়গায় কাজ করতে পারে। যোগান রয়েছে হরেক রকমের খাবার দাবার। তবে গুগলারদের তাদের এসাইনমেন্ট বা প্রজেক্টের সময়সীমা মাথায় রেখে কাজ করতে হয়। অর্পিত দায়িত্ব পালন করার জন্য গুগলারগণ ৮০ শতাংশ সময় ব্যয় করেন। বাকী ২০ শতাংশ সময় দেয়া হয় নতুন কোনো উদ্যোগ বা উদ্ভাবন নিয়ে ভাবা এবং গবেষণা করার জন্যে।

পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। গ্রুভ বিশ্বাস করতেন যে, ব্যবসায়ীক সাফল্যের মধ্যেই নিহিত রয়েছে পতনের বীজ। কারণ অর্থনৈতিক সাফল্য উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি ও সন্তুষ্টি নিয়ে আসে। এবং এই সন্তুষ্টিই হল পতনের বীজ। এইজন্য সার্বক্ষণিক সতর্কতা এবং ক্রমাগত উদ্যোগ নিতে হবে। নতুন পণ্য, নতুন কৌশল, নতুন প্রক্রিয়া, নতুন গ্রাহক চাহিদা এবং নতুন প্রযুক্তির আগমণের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে প্রতিনিয়ত। সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে বাজারের মাইকেল পোর্টার নির্দেশিত পঞ্চশক্তির দিকে। এই পাঁচটি শক্তি হল- প্রতিযোগী, বিকল্প পণ্য, আগন্তুক, সরবরাহকারী এবং ক্রেতা। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের রাডারকে খোলা রাখতে হবে নতুন কোনো কিছুর আগমণী সংকেত অনুধাবন করার জন্য। যেমন, ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিকে বুঝতে হবে যে, প্লাস্টিক কার্ডকে প্রতিস্থাপিত করবে ডিজিটাল মোবাইল কার্ড। বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে হয়তো সরে আসতে হবে টিভি বিজ্ঞাপন ছেড়ে সোশাল মিডিয়ার দিকে। বায়ু পরিবর্তনের সংকেত বুঝে পাল ঘোরাতে দেরী হলে দিক নির্দেশনা হারিয়ে গন্তব্যহীন সংকটে পড়বে নাবিক। যে কারণে আজকের দুনিয়ায় ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে নির্বাহীদের হতে হবে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। ব্যবস্থাপকদের হতে হবে উদ্ভাবণী ক্ষমতাসম্পন্ন। ক্রেতার চাহিদা এবং বাজারের সংকেত বুঝে নিতে হবে নতুন নতুন উদ্যোগ।

- Advertisement -

Read More

Recent