বুধবার - মে ৮ - ২০২৪

কানাডার বিস্ময় কেন্টিলিভার ব্রিজ

কানাডার কুইবেক শহরের অদূরে সেন্ট লরেঞ্চ নদীর উপর বিশ্বের দীর্ঘতম কেন্টিলিভার ব্রিজ আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে নির্মাণের শত বর্ষ পর প্রযুক্তির ইতিহাসে দুর্ভাগ্য ও বিচ্যুতি অতিক্রম করে সাফল্যের এক বিস্ময়

কানাডার কুইবেক শহরের অদূরে সেন্ট লরেঞ্চ নদীর উপর বিশ্বের দীর্ঘতম কেন্টিলিভার ব্রিজ আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে নির্মাণের শত বর্ষ পর, প্রযুক্তির ইতিহাসে দুর্ভাগ্য ও বিচ্যুতি অতিক্রম করে সাফল্যের এক বিস্ময়। এই বিস্তৃতি গম্ভীর ভাবে ইঞ্জিনিয়ার কমিউনিটির জন্যে প্রতীকী প্রবাদ এবং ঐকান্তিকতার একটি কীর্তিস্তম্ভ। যে স্মৃতিলিপি স্মরণ করিয়ে দেয় ইঞ্জিনিয়ারিং প্রক্রিয়ায় বিধ্বংসী যে কোন প্রভাবকে জয় করতে থাকা চাই অধ্যবসায় ও উদ্যম। নির্মাণের সময় দুই পর্যায়ে ডিজাইন ত্রুটি এবং ডিজাইন অফিসের সাথে কার্যনির্বাহী ইঞ্জিনিয়াদের যোগাযোগের অপ্রতুলতার কারণে নির্মাণাধীন ব্রিজ ভেঙ্গেপড়ে, ফলে প্রথমবার ৭৫ জন নির্মাণকর্মী প্রাণ হারায় এবং দ্বিতীয় দফায় ১৩ জন মারা যায়। এমন দুর্ভাগ্যজনক বিপর্যয়ের পরেও কানাডা সরকার এর নির্মাণ পরিত্যাগ করেনি বরং সুষ্ঠু ডিজাইন ও উন্নত পরিচালন ব্যবস্থা প্রয়োগের মাধ্যমে, দীর্ঘসময় লাগলেও (১৮৮৭ থেকে ১৯১৭) নির্মাণ কাজ সমাধা করেছিল। তাই আজ শতবর্ষের অধিক সময় এই ব্রিজ বিশ্বের ইঞ্জিনিয়ারিং বিস্ময় ও কীর্তিস্তম্ভ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কানাডীয় ও আমেরিকান সোসাইটি অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স একে জাতীয় ঐতিহাসিক নির্ধারিত স্থান হিসাবে চিহ্ণিত করেছে। ইঞ্জিনিয়ারদের ত্রুটি বিচ্যুতি কতটা বিপুল ও বিনাশক হতে পারে তার বিবেচনা এবং নৈতিক বিচার বিশ্লেষণের জন্য কুইবেক ব্রিজ আজ ইঞ্জিনিয়ারদের তীর্থক্ষেত্র বলে পরিচিত।
নির্মাণকালে প্রথম বিপর্যয় ঘটে ১৯০৭ সালের ২৭ আগস্ট, গ্রীষ্মে প্রখর তাপে কর্মদিন শেষ হওয়ার প্রাক্কালে যখন এক নির্মাণকর্মী বেইউভেইস লক্ষ্য করেছিলেন, একটি লোহার বোল্ট লাগানো রিভেট ভেঙ্গে আসছে প্রায় দু-টুকরো হয়ে। সে তার ফোরম্যানকে ডেকে জানিয়েছিল উদ্বেগপূর্ণ ঘটনাটি, কিন্তু মুহূর্তের মাঝেই শুনা গিয়েছিল তীক্ষ্ন আর্ত বিকট লোহার মটকানো শব্দ বাতাসে অনুপ্রবিষ্ট। প্রকাণ্ড আকারের কেন্টিলিভার, কর্মীদের সহ নদী গর্ভে হুড়মুড় করে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল, যার বিপুল বলবত্তা ও বিকট শব্দে প্রায় ১০ কি.মি পর্যন্ত কুইবেকবাসী ভেবেছিল ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। অদৃষ্ট ও নিয়তি নির্ণয় করেছিল কে বাঁচবে আর কে প্রাণ হারাবে সেই আকস্মিক বিপর্যয় হতে। টাইম কিপার দিনের কর্মশেষের হুইসেল দিতে প্রস্তুত, কিন্তু লক্ষ করেছিল সামনেই নিয়ন্ত্রণহীন আতঙ্ক, ব্রিজ ঢলে পড়েগেল নদীর জলে, সাথে বেইউভেইস জলে নিমজ্জিত, তবে সে সৌভাগ্যবশত জীবনে বেচে গিয়েছিল ধ্বংসস্তুপের উপর একটি পা খুইয়ে। আরো কয়েকজনকে বাঁচিয়েছিল উদ্ধারকারী নৌকো। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে বাঁকি যারা দেখছিল তারা ক্ষণিক পূর্বে মাত্র কাজ ছেড়ে ব্রিজ থেকে নেমে এসেছিল আর প্রমাদ গুনেছিল বিভীষিকা সামনে দেখে।
সেদিন মোট ৮৬ জন নির্মাণকর্মীর ৭৫ জন জীবন হারিয়েছিল, কেউ মোচড়ানো লোহার পাতের মাঝে আটকা পড়ে, বাঁকিরা জলের নীচে চাপাপড়ে, তারা প্রায় সবাই ইস্পাতফলকের কাজে দক্ষকর্মী ছিল।
এই প্রকাণ্ড বিপর্যয়ের পর এবং বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখামুখি হয়েও কানাডা সরকার ব্রিজ প্রকল্প পুননির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়, অধিক গুরুভার বহনকারী কেন্টিলিভার ডিজাইন দ্বারা।
হতভাগ্য কুইবেক ব্রিজ দ্বিতীয় দফায় বিপর্যয়ের কবলে পড়ে, ১১ সেপ্টে: ১৯১৬ সালে যখন একেবারেই শেষ পর্যায়ে কেন্টিলিভারের সবচাইতে মাঝের স্পেনটি যথাস্থানে উত্তোলনের সময় ছিটকে পুনঃ নদীতে পড়েযায়, এবারও ১৩জন দক্ষ কর্মীর প্রাণহানি ঘটে। অবশেষে ১৯১৭ সালে ব্রিজের কাজ সমাপ্ত হয় এবং যাত্রী ও রেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। আজ হতে শতবর্ষেরও আগে প্রিন্স অব ওয়েল্স ২২শে আগস্ট ১৯১৯ সালে ব্রিজ আনুষ্ঠানিক ভাবে নদী পারাপারের জন্য খুলে দিয়েছিল।
কুইবেক ব্রিজ দৈর্ঘ্যে ৩২৩৮ফুট, চওড়া ৯৫ফুট এবং উচ্চতায় ৩৪১ফুট, মাঝের কেন্টিলিভার স্পেনের দৈর্ঘ্য ১৮০১ফুট। প্রথমত ডিজাইন ছিল পাশাপাশি দুটি রেল লাইনের জন্য, পরে পরিবর্তন করে একটি রেল লাইন করা হয়, গাড়ী চলাচলের জন্য দুটি হাইওয়ে লেইন আর একটি পায়ে হাঁটার পথ রাখা হয়।
আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার থিয়োদোর কুপার কুইবেক ব্রিজের প্রথম ডিজাইনার ছিলেন, তিনি দাম্ভিক এবং অহংকারী লোক ছিলেন, যদিও দ্বিতীয় অ্যাভিনিউ ব্রিজ (নিউইয়র্ক) সহ অনেক মর্যাদাপূর্ণ প্রকল্পের সাথে তার নাম রয়েছে আমেরিকায়। কুপার কেন্টিলিভার সংযোজন প্রণালী বাছাই করে নিয়েছিলেন, সর্বোত্তম ও স্বল্পব্যয়ে উৎকৃষ্ট পরিকল্পনা মনে করে, যেহেতু সেন্ট লরেঞ্চ নদী খুব প্রশস্ত তাই মাঝের কেন্টিলিভার অংশ বেশ বিস্তৃত। তবে স্বল্পব্যয় কথাটিই তার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একদিকে ব্যয় কমাতে গিয়েছিলেন আবার মাঝের স্পেনের বিস্তারও ৪৯০ মিটার থেকে ৫৫০ মিটারে বাড়িয়েছিলেন। কানাডীয় সরকারের ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট ডগলাস, কুপারের সবিস্তার বিবরণী নিরীক্ষা করে স্পেনের বিস্তৃত বড় অংশে খুব বেশী ভার বহনে মাত্রাতিরিক্ত চাপ পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। কিন্তু কুপার এই সমালোচনাকে নিষ্ঠুর নিন্দা বলে অগ্রাহ্য করেন, “ডগলাসের বার্তা কুপারকে পদমর্যাদায় হেয় প্রতিপন্ন করা বলেও মন্তব্য করেন” এবং কিছুতেই মেনে নিতে চাননি।
কুপার নিয়মিত প্রকল্প পরিদর্শন করতেও অস্বীকার করেন, নিজের স্বাস্থ্য-গত কারণ দেখিয়ে এবং তার পরিবর্তে পিটার স্লাপ্যাক কে পরিদর্শন কাজে পাঠিয়েছিলেন, যার অভিজ্ঞতা শুধুই ডেস্ক ইঞ্জিনিয়ারের ছিল। ইতোমধ্যে ১৯০৭ এর গ্রীষ্মে স্বল্পব্যয়ের ডিজাইনের পরিণতি লক্ষ্যনীয় ভাবে দেখা দেয়, বিশেষ করে কেন্টিলিভারের সংক্ষেপণ অংশে, তদারককারী এক তরুণ ইঞ্জিনিয়ার নরম্যান মেকলিউর ছয়ই আগস্ট ১৯০৭ সনে প্রথম লক্ষ্য করেন নীচের দিকের একটি লোহার বিম কিছুটা বেঁকে যাচ্ছিল, সে দ্রুত টেলিগ্রাম করে আমেরিকাতে কুপারকে জানায়, তিনি সকরুনভাবে টেলিগ্রামের উত্তর দেন অবাক হয়ে, যে কিভাবে তা ঘটছে। ১২ই আগস্ট নরম্যান আবারও দেখলেন আরো দুটি বিম বেঁকে যাচ্ছিল, এই বলে রিপোর্টও পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু প্রকল্পের নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার জন ডিন কাজ বন্ধ করার সম্মতি দেননি ডিজাইনারের আদেশ পাননি বলে।
নরম্যান পুনঃ ২৭শে আগস্ট সকালে বিমের বাঁকানোর পরিমাপ নেন এবং কুপারকে জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠান, কুপারও সাথে সাথে পেনসিলভিনিয়ায় ফোয়েনিক্স ব্রিজ কোম্পানিকে ( কেন্টিলিভারের ফেব্রিকেটর ও কুইবেক ব্রিজের কন্ট্রাকটর) টেলিগ্রাম পাঠান এই বলে যে, আর যেন ভারী কিছু ব্রিজে তোলা না হয়, পরবর্তি পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট না আসা অবধি। নির্মাণ সাইটে ইঞ্জিনিয়ার জন ডিনও একই টেলিগ্রাম পেয়েছিলেন ঠিকই, হয়ত বুঝতে পারেননি অথবা উপেক্ষা করেছেন, ফলে তখনো কাজ বন্ধ করার আদেশ দেননি।
পরিণামে ২৭শে আগস্ট ১৯০৭ সাল কর্মদিন শেষ হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কর্মীদের সহ কেন্টিলিভার ভেঙ্গে নদীতে পড়ে যায়। বিশ্বের দীর্ঘতম ব্রিজের নির্মাণকালে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পের সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছিল, ৭৫ জন দক্ষ কর্মীর অবিস্মরণীয় প্রাণহানি ঘটেছিল। বিপর্যয়ের পর প্রায় দুই বৎসর লেগেছিল নদীর তলদেশ হতে ব্রিজের বিক্ষিপ্ত ভগ্নাংশ সম্পূর্ণরূপে অপসারণ ও পরিষ্কার করতে।
কুইবেক ব্রিজের বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা পরবর্তি তরুন ইঞ্জিনিয়ারদের জন্যে বরিষ্ঠ প্রযুক্তিগত মানদণ্ড, বর্ধনশীল উচ্চমানের পেশা ও সর্বজনীন দায়িত্ব নিয়ে আগুয়ান হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রদ আলোক বর্তিকা।
এই ভেঙেপড়া ব্রিজ একটি রূপকথারও জন্মদেয়, ১৯২২ সাল থেকে কানাডায় ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রেজুয়েটদের আয়রন রিং পরানোর রেওয়াজ চালু হয়, বিভিন্ন ধাতুর মিশ্রনে এই রিং প্রস্তুত হলেও এক অংশ কুইবেক ব্রিজের মোষড়েপড়া ভগ্নাবশেষের লৌহপাত থেকে নিতে বলা হয়। নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতার প্রতীকী প্রতিজ্ঞা দেহে এবং মননে ধারণ করবার প্রয়াসে এবং ভুল ত্রুটির কারণে কুইবেক ব্রিজের বিপর্যয়কে স্মরণে রাখার তাগিদে।
যে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রেজুয়েটদের আয়রন রিং পরানো হয় তার নাম “ইঞ্জিনিয়ার নাম গ্রহন ও প্রতিজ্ঞার অনুষ্ঠান”, যেখানে গ্রেজুয়েটদের আহ্বান জানানো হয় কর্ম জীবনে পেশাদারি কাজে নীতি, সূত্র এবং মূলমন্ত্র থেকে কেউ যেন বিচ্যুত না হয়, প্রত্যেকেই যেন নিজ সাধ্য অনুযায়ী সর্বোত্তম প্রতিশ্রুত কাজে অংশ নেয় ।
এই রিং এর তাৎপর্য প্রত্যেক কানাডিয় ইঞ্জিনিয়ারের জন্যে ভাবোদ্দীপক, এ কারণে যে কর্মক্ষেত্রে যাহা স্মরণ করিয়ে দেয় কুইবেক ব্রিজের নির্মাণ কালীন ত্রুটি বিচ্যুতি, কর্মে অবহেলা, যোগাযোগের অপ্রতুলতা এমনকি ব্যক্তি জীবনে অহংকার ও তার পরিণামের কথা।
বিপর্যয়ের পর কয়েক জন প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার মনট্রিয়ালে মিলিত হন, ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় সংহতির উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করতে। তারা আলোকপাত করতে চেয়েছেন, কিছু সাধারণ পথ নির্দেশনা যদি স্থাপন করা যায় যাতে করে ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাধারীগন একটি প্রতিষ্ঠানের বন্ধনে আবদ্ধ থাকে এবং যার অনুপ্রেরণায় সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ নিয়ে সবাই সব সময় কাজ করে। যার ফলশ্রুতিতেই আজকে কানাডার পি.ই.ও বা প্রফেশনাল ইঞ্জিনিয়ার্স অরগানিজেশন। শুধু আয়রন রিংই নয়, ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে সই সাবুদ করতে চাইলে অবশ্যই পি.ই.ও রেজিস্টার মেম্বারের লাইসেন্সধারী হতে হয় এবং সকল কাজের জন্য জবাবদিহতার আওতায় থাকতে হয়, তার ব্যতিক্রম হলে গুরুতর সাজার ব্যবস্থাও রয়েছে।
স্কারবোরা, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent