শুক্রবার - মে ৩ - ২০২৪

এশিয়ার বিষ্ময়কর উত্থান

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জীর ভাষ্যমতে একবিংশ শতাব্দী হবে এশিয়ান সেঞ্চুরিছবিটম ব্লিজ

সিন্ধু নদীর তীরে ইন্দাস উপত্যকায় পাঁচ হাজার বছর আগে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কালের বির্বতণে সেই সভ্যতা পৃথিবী ভ্রমণ করেছে। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার উত্থান হয়েছিল খৃষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগে। রানি ক্লিওপেট্রার মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার বছর টিকে ছিল এই সভ্যতা। দক্ষিণ আমেরিকায় মায়া সভ্যতার স্থায়িত্ব কাল ছিল প্রায় দুই হাজার বছর। ইউরোপে রোমান সভ্যতা টিকেছিল পাঁচশত বছর।
সভ্যতার এই বিশ্ব পরিভ্রমণে অর্থনীতি একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। সেটা ছিল ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বাণিজ্যের রথযাত্রা। তবে এইসব সভ্যতার পতনের মূল কারণ ছিল অর্ন্তগত দ্ব›দ্ব, বিভেদ এবং বহিঃশত্রুর আক্রমণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর্থসামাজিক পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যায়। প্রযুক্তির প্রভূত উন্নয়ন এবং আধুনিকায়নের ফলে বিশ্বায়নের যাত্রা শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উত্তর আমেরিকায় ‘বেবী বুমার’ জোয়ারে এসেছে অর্থনেতিক সমৃদ্ধি। কিন্তু সেই সমৃদ্ধির সাগরে এখন ভাটা পড়েছে। ইউরোপের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাও স্তিমিত হয়ে পড়েছে।
গত পঞ্চাশ বছরে এশিয়া মহাদেশের বিষ্ময়কর উত্থান ঘটেছে। ষাট দশকের এশিয়ার দেশগুলির অর্থনীতি ছিল কৃষি নির্ভর এবং মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার মার্কিন ডলারের নিচে (২০১০ সালের দর অনুযায়ী)।
গত পঞ্চাশ বছরে এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাপক নগরায়ণ হয়েছে। দ্রুত নগরায়ণের ফলে এশিয়ার অন্তত ২০টি শহর হবে বিশ্বের বৃহত্তম মেগা সিটি। শিল্পায়ন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া জগতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। যোগাযোগের দ্রুত উন্নয়নের সাথে প্রযুক্তির আদান-প্রদান এশিয়ার দেশগুলির জন্য নিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা।
প্রথাগত ভাবে মধ্যপ্রাচ্য ব্যতিত এশিয়ার দেশ সমূহকে চারটি ভাগে বিভাজন করা যায়। উত্তর পূর্ব এশিয়া (চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া), দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া (আসিয়ান দেশসমূহ) এবং দক্ষিণ এশিয়া (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা) এবং মধ্য এশিয়া।
গবেষণা এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকিঞ্জী এই চার এশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থানকে বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথম হলো অগ্রগামী এশিয়া যার দেশ সমূহ হলো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুর। এই দেশগুলির নাগরিকদের মাথাপিছু আয় ত্রিশ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি এবং সামগ্রিক জিডিপি বৈশ্বিক জিডিপির দশ শতাংশ। এই দেশগুলো বাদবাকি এশিয়াকে যোগান দিয়েছে পুঁজি, প্রযুক্তি এবং বাজার।
দ্বিতীয় এশিয়া হলো চীন। এই নব চীনকে বলা হয় বিশ্বের কারখানা। ভূমি, শ্রমশক্তি, পুঁজি এবং প্রযুক্তিকে সম্বল করে চীনের অর্থনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। এই প্রবৃদ্ধির ধারায় ২০৩০ সালে চীনের অর্থনীতির আকার হবে পশ্চিম ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান। আগামীতে চীন হবে বাদ বাকী বিশ্বের পুঁজির যোগানদার।
তৃতীয় অর্থনৈতিক শক্তি হিসাবে উত্থান ঘটাবে আসিয়ানভুক্ত এগারটি রাষ্ট্র। আসিয়ান থেকে বাদ পড়বে সিঙ্গাপুর এবং যুক্ত হবে নেপাল ও ভুটান। মূলত তরুণ প্রজন্মের জনশক্তি, বাণিজ্যে বিনিয়োগ, দ্রুত প্রবৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক জাগরণের কারণে এগিয়ে আসবে এই তৃতীয় জোট।
চতুর্থ অগ্রগামী শক্তি হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ (ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান)। এই চর্তুভেদী এশিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে বৈশ্বিক জিডিপির এক তৃতীয়াংশ এবং সারা বিশ্বের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চল্লিশ শতাংশ।
এশিয়ার উন্নত দেশগুলো (যেমন- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, চায়না) জিডিপির বৃদ্ধির হার লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, প্রায় এক দশকের অধিক সময় গড় জিডিপি একটি মাত্রায় স্থিতিশীল ছিল।
জিডিপির এই স্থিতিমাত্রা লক্ষ্য করা যায় আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার ক্ষেত্রে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও একই ধাপে এগিয়ে চলছে।
আশাতীত ভাবে অগ্রসর হয়েছে এশিয়ার অর্থনীতি। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জীর ভাষ্যমতে একবিংশ শতাব্দী হবে এশিয়ান সেঞ্চুরি। ২০৪০ সালের মধ্য সারা বিশ্বের ৫০ ভাগ জিডিপির ভাগীদার হবে এশিয়া এবং ৪০ ভাগ পণ্যের ভোক্তা হবে এশিয়ায়।
২০০০ সালে এশিয়ার জিডিপি ছিল বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ এবং ২০৪০ সালে তা হবে পঞ্চাশ শতাংশ। আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা এবং পরিবেশের বিপন্নতা রোধ করা না গেলে এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হবে না।
প্রথমত এশিয়ার রাজ্যগুলোতে পরিলক্ষিত হয় শিল্পায়ন এবং নগরায়ণ। তার সাথে যুক্ত হয়েছে পণ্যের চাহিদা ও উৎপাদন এবং তা সমন্বয় করছে করপোরেট সেক্টর। বিশেষত জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সামরিক ব্যয় ব্যাপক হারে কমিয়ে এনে কর্পোরেশন এবং ব্যাংকগুলোতে অর্থ বিনিয়োগ করে। শিল্প এবং বাণিজ্যে এগিয়ে আসে মিতসুবিশি, মারুবিনি, ইতোচু, টয়োটা, নিশান, হোন্ডা, প্যানাসনিকের মত বৃহৎ কর্পোরেট সেক্টর।
হ্যান নদীর তীরে অবস্থিত দক্ষিণ কোরিয়া গড়ে তোলে স্যামসাং, এলজি, হুনডাই, কিয়া ইত্যাদি উৎপাদন ভিত্তিক কর্পোরেশন। শিল্প এবং বাণিজ্যকে টেকসই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সুষ্ঠু এবং সুশৃংখল ব্যবস্থাপনা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। একই সাথে ব্র্যান্ড কমিউনেকশনের ক্ষেত্রেও তারা বিশেষভাবে মনোযোগী হয়। জাপানের টয়োটা কিংবা লেক্সাস অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড।
কিন্তু চীন এবং ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে কিছুটা ভিন্ন খাতে। প্রথমেই এই দেশ দুটি বিদেশী ব্র্যান্ডের পণ্যের কারখানা গড়ে তোলে নিজস্ব ভূমিতে। মূলত এই বৃহৎ দেশ দুটি ভূমি এবং শ্রম শক্তিকে উৎপাদন খাতে বিনিয়োগ করে। ফলে চীন এবং ভারতীয় ব্র্যান্ডের পণ্য এখনও বিশ্ববাজারে তেমন সমাদর পায়নি।
অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির ফলে এশিয়ার বড় দেশগুলো বিশেষত চীন এবং ভারতে উৎপাদন বাড়ছে কিন্তু সেই তুলনায় রপ্তানী কমছে। ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্য চায়নার উৎপাদন সক্ষমতা বেড়েছে তিন গুণ, ৩.১ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে হয়েছে ৮.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। একই সময়ে রপ্তানী ১৫.৫% থেকে কমে হয়েছে ৮.৩ শতাংশ।
শিল্পায়নে সক্ষমতা এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে বৈদেশিক পণ্য আমদানীর নির্ভরতা কমে এসেছে। অবকাঠামো, শ্রম শক্তির দক্ষতা এবং উৎপাদন সক্ষমতা এশিয়ার দেশসমূহের উন্নয়নের নেয়ামক হলেও দ্রুত শ্রমঘন নির্ভর পণ্যের রপ্তানী বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। বরং সেই জায়গাটা দখল করে নেবে গবেষণা, উদ্ভাবনা শক্তি এবং প্রযুক্তির প্রয়োগ।
সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় এশিয়ার এই চারটি অংশের দেশগুলো আগামী দশ বছরে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে দাপটের সাথে অবস্থান করবে। বর্তমানে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে এই দেশগুলোর আন্ত-দেশীয় আমদানী রপ্তানির পরিমাণ ৬০ শতাংশ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ৬৬ শতাংশ।
এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহের এই উত্থানের পেছনে যে সব বিষয় ভূমিকা রেখেছে সেগুলো হলো দ্রæত নগরায়ণ, আন্ত-দেশীয় যোগাযোগের অভূতপূর্ব সুযোগ এবং তরুণ জনশক্তি। এই তরুণ মানবসম্পদ যে হারে শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে পশ্চিমা দেশগুলো তার সাথে পাল্লা দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে। এই তরুণ জনশক্তি আবার ক্রেতা হিসাবে আবির্ভূত হচ্ছে। ফলে তাদের বিবিধ চাহিদা মেটাতে সম্প্রসারিত হচ্ছে বাজার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলোর রক্ষণশীল নীতির কারণে এশিয়ার তরুণ প্রজন্ম নিজ নিজ দেশেই গড়ে তুলছে শিল্প কারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য এবং আন্ত-দেশীয় যোগাযোগ এবং আমদানী-রপ্তানি। এশিয়ার এই চার শক্তির দেশসমূহে উন্মেষ ঘটেছে এক নবীন উদ্যোক্তা শ্রেণির যারা আউটসোর্সিং থেকে শুরু করে বিবিধ যোগাযোগ নির্ভর ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছে। এছাড়াও এই নবীন উদ্যোক্তা শ্রেণি এগ্রো ফার্ম, তথ্য প্রযুক্তি, ট্রান্সপোর্ট এবং ট্রেড সহ বিবিধ ব্যবসায়ীক কর্মকান্ডে নিয়োজিত হচ্ছে।
ইতিপূর্বে এশিয়ার উদ্ধৃত্ত সঞ্চয় চলে যেত লন্ডন এবং নিউইয়র্কে এবং চক্রাকারে বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে এশিয়ায় ফিরে আসতো। কিন্তু সেই পথের পরিবর্তন হয়েছে। এখন এশিয়ার অগ্রগামী দেশগুলো বিশেষত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চায়না পুঁজির জোগানদার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। একই সাথে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং গবেষণায় এশিয়া আন্তঃঅঞ্চলে স্বর্নিভর শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসছে।
এশিয়ার এই অর্থনৈতিক উত্থানে তিনটি বিষয়কে বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমত বৈশ্বিক উষ্ণতা। বিশাল জনগোষ্ঠি যে পরিমাণ জ্বালানি ক্ষয় করছে তার ফলে কার্বন নিঃসরনের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। একই সাথে বনাঞ্চলের ক্ষয় এশিয়াকে আরো নাজুক পরিস্থিতির সামনে ফেলে দিচ্ছে। বাড়ছে প্রাকৃতিক দূর্যোগের সম্ভাবনা। টাইফুন, বন্যা, জলোচ্ছাস ইত্যাদি সহ উজাড় হচ্ছে বনবাদাড়।
দ্বিতীয়ত, আরেকটি অশনি সংকেত হলো অর্থের কেন্দ্রীকরণ এবং আয় ও সম্পদের বৈষম্য। সার্বিক দরিদ্র্যের হার কমে এলেও গত দুই দশকে ধনী এবং মধ্যবিত্তের আয় বৈষম্য বাড়ছে, সম্পদের কেন্দ্রীকরণ ঘনীভূত হচ্ছে। এই বৈষম্যের ব্যবধান যত বাড়ছে ততই অস্থির হয়ে উঠছে সমাজ, বিশেষত নব প্রজন্মের বেকার তরুণেরা।
সামাজিক সুরক্ষার জাল, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়গুলোকে প্রাধান্য না দিলে থমকে যেতে পারে এশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতি।
তৃতীয়ত, ভৌগলিক বিভেদের আশংকা। একই সাথে যুক্ত হচ্ছে ধর্মীয় মেরুকরণ। এশিয়ার বহুমাতৃকতাই এশিয়ার শক্তি। অথচ এই শক্তিকে যদি বিভেদের কারণে বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং পৌরানিক পেশিশক্তির প্রয়োগ ঘটে তাহলে ভেস্তে যেতে পারে অর্থনৈতিক উত্থান এবং স্তিমিত হয়ে পড়বে অগ্রগতি।

- Advertisement -

Read More

Recent