সোমবার - মে ১৩ - ২০২৪

বিপর্যস্ত অনুভব

মনের এমন অবস্থায় শাহরিয়ার মামার সাথে কথা বলে মা যুদ্ধের সময় হারিয়ে যাওয়া ওদের ছোট ভাই বাবুয়ার কথা বলে কাঁদে দুজনে মিলে

সামিয়াকে প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য।
আবেদিন আহমেদকে কতবার বলেছে, আমাকে এবার ছেড়ে দিন, মানুষ বিরক্ত হয়ে যাবে একই মুখ বারবার দেখে। আর নতুন কিছু তো করতে পারছি না। সেই একই কথা আর কতবার?
আবেদিন আহমেদের এক কথা, যে কথা চির সত্য তার পরিবর্তন হবে কেমন করে। পুরনো এক কথাই সঠিকভাবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। এটা আমাদের করে যেতেই হবে। ইতিহাস নতুন করে লেখা যায় না। যা ঘটেছে যেভাবে ঘটেছে তাই বারবার বলে যেতে হবে সেভাবেই। আপনি যেভাবে ভয়াবহতা দেখেছেন সেকথা আপনার কাছ থেকে শুনতে যেমন বাস্তব হয়ে উঠবে, অন্যের কথায় সেভাবে প্রকাশ পাবে না। আপনাকে আসতেই হবে, যতদিন আপনি আছেন, কথা বলতে পারবেন, আমার টিভি চ্যানেলে আপনাকে আসতেই হবে।
সামিয়া আর যুদ্ধ নিয়ে ভাবতে চান না। এই কষ্ট বুকের ভিতর সারাজীবনই থাকবে। ছাইচাপা হয়ে আগুন জ্বলছে, নতুন করে কষ্ট উসকে দিতে চান না আর ভেবে। অনুষ্ঠান করতে গেলে অনেক কিছু মনে হয়। অনেক মুছে যাওয়া, ম্লান হয়ে যাওয়া স্মৃতি সেদিনের মতন জেগে উঠে মনে। বড় কষ্ট হয় হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোর কথা ভেবে। আরো বেশি কষ্ট হয় এত রক্তের বিনিময়ে এখনো কি সঠিক স্বাধীনতা পেয়েছে মানুষ ? তখন সব কিছু অর্থহীন মনে হয়। তাই সামিয়া অনুষ্ঠান না করার কথা বলতে চেয়ে টেলিফোন করেছিলেন আবার আবেদিন আহমেদকে কিন্তু উনি নাছোড়বান্দা।
প্রতিবার সেই একই কথাবার্তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। এবার নতুন কিছু কি করা যায় এ বিষয়ে ভাবতে ভাবতে আনমনা বসেছিল বসার ঘরে, অন্ধকারে।
– মা এক কাপ চা হবে ?
কি ব্যাপার, মায়ের কোনো সাড়া শব্দ নাই, অন্ধকারে চুপচাপ বসে আছে কেন ? তিতাস দ্রুত এগিয়ে যায় সামিয়ার পাশে।
– মা কি হয়েছে ? ঠিক আছো তুমি। শরীর খারাপ ? তিতাস ওর কপালে হাত রাখে।
সামিয়া এতই আনমনা হয়ে ছিল ছেলের কথা শুনতে পায়নি। কপালে হাতের স্পর্শে ছেলের চোখে তাকায়।
তিতাস দেখে মায়ের চোখভরা জল। আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে আবার বলে,
– কি হয়েছে মা, তোমার শরীর খারাপ ?
– না শরীর ঠিক আছে।
– তাহলে কি নিয়ে ভাবছো? তিতাস জানে মা বেশি গভীর ভাবনায় ডুবে গেলে এমন আনমনা হয়ে যায়।
– আসলে একটা বিষয়ে বেশিই ভাবছি।
– বিষয়টা কি বলে ফেলো।
– টেলিভিশনের ষোল ডিসেম্বরের অনুষ্ঠান নিয়ে ভাবছি।
মা সব বিষয়ে চটপটে, পারফেক্ট শুধু এই যুদ্ধ বিষয়ে ভাবলে হয়ে যায় আনমনা, ভুলে যায় বাস্তব। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে তিতাস। তখন বুঝত না, মাকে ডাকলেও কেন সাড়া না দিয়ে চুপ করে বসে আছে কিন্তু এখন জানে মায়ের বুকের ভিতরের রক্তক্ষরণ। দুঃখ স্মৃতির ঢেউ, যন্ত্রণার বিপর্যস্ত অনুভব।
তিতাস মার পাশে বসে আদরে জড়িয়ে রেখে বলে,
– এত ভাবার কি হলো?
– প্রতি বছর একই রকম কথাবার্তা আর বলতে ইচ্ছা করে না।
– কিন্তু তুমি তো কি বলবে ভাবছিলে না, ডুবে গিয়েছিলে স্মৃতির সমুদ্রে।
– তা ঠিক হারিয়ে গিয়েছিলাম, এই তো হয় মৃদু হাসে সামিয়া।
– শাহরিয়ার মামার সাথে কথা বলবে ?
– না থাক, এখন ওদের অনেক রাত।
মনের এমন অবস্থায় শাহরিয়ার মামার সাথে কথা বলে মা যুদ্ধের সময় হারিয়ে যাওয়া ওদের ছোট ভাই বাবুয়ার কথা বলে কাঁদে দুজনে মিলে।
– আই কেন হেল্প ইউ, হঠাৎ তিতাস বলে।
চোখ বড় করে নড়েচড়ে বসে সামিয়া।
– তাই।
– হুম, আমার কাছে একটা বিষয় আছে ভেবেছিলাম পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ করব এই বিজয় দিবস সংখ্যায় কিন্তু তোমাকে দিতে পারি আফটার অল ইউ আর মাই মাদার। তবে কান্নাকাটি থামাতে হবে বাচ্চা মেয়ে।
চোখে জল নিয়ে তিতাসের দিকে হাসিমুখে তাকায় সামিয়া।
আচ্ছা বল, কাঁদবো না।
– গত সপ্তাহে যে বাইরে গেলাম তখন আমি এই কাহিনীটা পেয়েছি। আমার খুব কষ্ট হয়েছে জেনে। আমি জানি তুমি, বাবা তোমরা কেন এত ইমোশনাল যুদ্ধের বিষয়ে। আমি এই কাহিনীটা প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করব ভাবছি। কিছু একটা করতে পারলে আমার ভালো লাগবে। যারা এই দেশের হিরো তাদের কোনো মূল্যায়ন নাই, এ কেমন দেশ ? কত কষ্ট করে তারা জীবনযাপন করছে কারো কোনো খোঁজ নাই। যাদের সব হারানোর ব্যথায় এই দেশের জন্ম, তাদের হৃদয়ের কোনো মূল্য নাই। তাদের জীবনযাপনের কোনো ব্যবস্থা নাই। আমারও তোমাদের মতন অনেক কষ্ট হয় মা। তবে টেলিভিশনে প্রচার পেলে ভালোই হবে। তুমি প্রস্তুতি নেও মা।
সামিয়া কাঁদবে না ছেলের কাছে কথা দিলেও কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না। হারুন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তিতাসের কাহিনী শুনে। চোখ মুছে ফোঁপাতে ফোঁপাতে সামিয়া বলে,
– আমাকে নিয়ে যা তার কাছে তিতাস। আমি তাকে আমার কাছে এনে রাখব।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent