শনিবার - মে ১৮ - ২০২৪

অজানা দেশ : সাত

ছবিভিটালি সাক্রিড

গভীর রাত পর্যন্ত গল্প, গান, হাসি-তামাসায় কাটল। খাওয়ার আয়োজন ছিল বিশাল। স্যামুয়েলের চক্ষু চরকগাছ,
– মা গো বাঙালিরা এত কিছু খায়, আমি তো জানতাম পুয়োর কান্ট্রি।
– আমাদের ভেরাইটিস খাবার আছে মিস্টার স্যামুয়েল, আর বাঙালির ঐতিহ্যই হলো রান্না আর খাওয়া। হা হা হা উদাত্ত কন্ঠে প্রাণখোলা হাসি হাসেন আবেদিন আহমেদ।
– কেন আপনার মিসেস, আপনাকে বাঙালি খাবার খাওয়ান না ? মিসেস আবেদিন বলেন।
– সে কিছু বাঙালি ডিশ রান্না করে মাঝে মাঝে ভেরি ডেলিসাস, তবে আমরা তো দুজন মানুষ আর আমরা খুব অল্প খাই। একটা দুটোর বেশি ডিশ রান্না করা হয় না।
– তা ঠিক প্রতিদিনের খাবারদাবার আমরাও খুব বেশি কিছু করি না। তবে আজ তো একটা ফিস্ট হলো। আপনারা এসেছেন, আমরাও ঘুরতে এসেছি।
– না মামী আপনার খাবার টেবিলে সব সময় অনেক রকম আইটেম, জয় প্রতিবাদ করে।
সবাই হেসে উঠে একসাথে।
তাতাইর চোখ খুঁজে লিমাকে। মেয়েটা যে কি খানিক ছিল সবার মাঝে, কখন উঠে চলে গেছে। আবার একা দরজা বন্ধ করেছে। নিশ্চয় পুশ করছে সিরিঞ্জ শরীরে। নেশা খুব জটিলভাবে ছড়িয়েছে। ঢাকা যেয়েই ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ভালো খুব ভালো কাটছে এই কয়টা দিন। তাতাইর খুব মজা লাগছে, অনেক দিন পর ছোটবেলার মতন হৈচৈ দিন পাওয়া গেছে। মামার টেলিভিশন প্রোগ্রাম রেকর্ডিং শেষ হলে ঢাকা ফেরা হবে।
জয়ের কাজটা করার চেষ্টা করবে। বিরাঙ্গনাদের কোনো তালিকা কি আছে? সেই মাকে কোথায় খুঁজে পাবে জয়? তাতাই কেমন করে সাহায্য করবে জয়কে। ওর খুব ভালোলাগত যদি খুঁজে এনে দিতে পারত ওর মাকে। সাজিদ ভাইর জন্য এবার একটা আলাদা কষ্ট হচ্ছে তাতাইর। সেও মনে মনে খুঁজে বেড়ায় মা, বাবা, ওর নিজেস্ব পরিচয়। আনন্দময় সময়ের মাঝে বিষাদের বাতাস, সুখ হাসি খুশি মানুষ ভিতরে বয়ে বেড়ায় এক ধরনের কান্না যার সমাধান করতে পারে না কেউ। অন্য সবার বিষয় ভাবার মাঝে তাতাই ওর নিজের পরিকল্পনাটা নিয়েও ভাবে। কি করতে পারে এখনো সঠিক কোনো ধারণা ঠিক করতে পারছে না। মামার সাথে বিশদ আলোচনা করতে হবে। মামার কাজগুলো ওর খুব পছন্দ। সাজিদ ভাইর মতন মানুষকে এই গ্রাম থেকে তুলে না নিয়ে গেলে বাংলাদেশের মানুষ বঞ্চিত হতো সাজিদ মেহরার কন্ঠসুধা থেকে। প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলে নিজের অসুস্থ মেয়েকে চাপিয়ে দেননি সাজিদের ওপর। এখনো আদরে ভালোবাসায় ছেলের মতন দেখেন সাজিদকে। সত্যি মামার মতন মানুষ হয় না। তাতাই সবার মাঝে বসে একা হয়ে গিয়েছিল ভাবতে ভাবতে। মামার কাছে উঠে গিয়ে মামাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে।
– মামা বলেন কি হলোরে মা ?
তাতাইর চোখে পানি এসে গেছে আবেগে ভালোলাগায়। সে কোনো মতন বলে,
– তোমাকে আদর করতে ইচ্ছা করছে মামা, তুমি অনেক ভালো ।
বেশ বেলায় ঘুম ভাঙ্গে তাতাইর। চোখ মেলে দেখে ওর পায়ের কাছে বসে আছে আয়শা। ওকে চোখ মেলতে দেখে আয়শা বলে,
– এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাও তুমি?
হেসে চোখের পাতা নাচায় তাতাই,
– কত বেলা হলো ?
– এগারোটা।
– ও মা, লাফ দিয়ে উঠে তাতাই। এত ঘুমিয়েছি, ডাকোনি কেন ?
– বকো যদি।
– দূর বোকা এদিকে আয়। আয়শা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলে ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে তাতাই।
– তুমি একটা মিষ্টি মেয়ে হেসে উঠে দুজনে। আচ্ছা আমি চটপট রেডি হয়ে আসি। বাইরের অবস্থা কি ? মেহমান এসেছে ?
– কেউ আসেনি এখনও।
বাইরে লনে মামা, মামী, জিনিয়া আর স্যামুয়েল বসে আছেন, জয় আর সাজিদ উঠেনি এখনো। তাতাই আয়শার হাত ধরে ওখানে যায়। মামী বলেন,
– ভাব হয়ে গেছে?
– হুম, খুব মিষ্টি মেয়ে। তাতাই গাল টিপে দেয় আয়শার।
মামা বলেন,
– তাতাই মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্যামুয়েল আমার টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন। তুমি উপস্থাপনা করবে পুরো অনুষ্ঠান। মিসেস সামিয়া ইকবাল কি করবেন তাও জানি না। তবে তাদের বিষয়গুলো তারাই বলবেন। তুমি শুধু তাদের পরিচয়টা দর্শকের সামনে তুলে ধরবে। পারবে না ?
তাতাই মামার আকস্মিক প্রস্তাবে প্রথমে একটু নার্ভাস হলেও বিষয়টাতে ইনভলব হতে ওর খুব ভালো লাগল।
– ঠিক আছে মামা, আমি তাহলে উনাদের সাথে কথাবার্তা বলে উনাদের সম্পর্কে জেনে নেই।
কাপে চা ঢালতে ঢালতে তাতাই আয়শাকে বলল,
– আমার ঘর থেকে কলম আর নোট খাতাটা নিয়ে এসো আপু। আমি প্রশ্নগুলো সাজিয়ে নেই।
মামী খাবারের আয়োজন দেখতে উঠে গেলেন। মামা আয়শাকে নিয়ে পুকুরপাড়ের দিকে গেলেন ঘুরতে।
তাতাই জিনিয়া আর মিস্টার স্যামুয়েলের সাথে কথা বলতে শুরু করল।
কবে জিনিয়া দেশ থেকে কানাডায় গিয়েছেন। কবে তাদের পরিচয়। কেন বাংলাদেশে এসেছেন। তাতাই হালকা কয়েকটা প্রশ্ন করছে কিন্তু লক্ষ করে উনারা দুজনে গম্ভীর হয়ে যাচ্ছেন, জিনিয়া যেন বেশি অন্যমনস্ক। তাতাইর মনে হলো ওরা সহজ হতে পারছে না। জিনিয়া একসময় বললেন,
– আমরা নিজেদের মধ্যে একটু কথা বলে নেই তাতাই।
– অবশ্যই আপনারা আলোচনা করুন, আমি ভিতরে যাচ্ছি।
জয় আর সাজিদের ঘুম ভাঙ্গেনি এখনো, লিমা আপা কি করছে, সেও ঘুমাচ্ছে এখনো ?
তাতাই লিমার ঘরে যায়। লিমা গোসল করে একটা শাড়ি পরেছে। খুব সুন্দর লাগছে।
তাতাই উচ্ছ¡সিত হয়ে যায় ওকে দেখে,
– এমা লিমা আপু যা সুন্দর লাগছে, এমন রূপ নিয়ে ঘরে বসে আছো কেন? চলো তোমার গানের রেকর্ডিংটা হয়ে যাক। লিমার হাত ধরে টানে তাতাই।
– যাহ ফাজিল, আমি গান করব না।
– কি করবে তবে। দুজন নতুন মেহমান এসেছেন তাদের সাথে কথা বলবে ?
– রোদে গেলে আমার মাথা ঘুরে তাতাই।
– আচ্ছা ঘরেই থাকো তবে। খেয়েছো কিছু?
– আমরা ফিরব কবে তাতাই? লিমার প্রশ্ন শুনে তাতাই বুঝে ওর ভালো লাগছে না আর এখানে।
– দু-একদিনের মধ্যেই।
– আমার ঢাকা যেতে হবে তাতাই দু-এক দিনের মধ্যে। তোরা না গেলে আমি একাই চলে যাবো।
হঠাৎ করে তাতাইর রাগ হয় লিমা আপার উপর, একটু কড়াভাবেই বলে,
– তোমার একা যেতে হবে না আমারও কাজ আছে আমিও যাবো। সবারই কাজ আছে ঢাকায়, কেউ পড়ে থাকবে না এখানে, চিন্তা করো না। তাতাই অসহিষ্ণু হয় লিমার কথায়। মনে মনে ভাবে কত ঘোড়ার ডিমের কাজ তোমার জানা আছে। দাঁড়াও তোমাকে আমি ঠিক করব। এমন উল্টাপাল্টা করে জীবন কাটাতে দিব না। বেশি আদরে ভালোবাসায় স্পোয়েল্ড চাইল্ড হয়েছো। এমন সুন্দর একটা জীবন পেয়ে সেটা ধ্বংস করছো বসে বসে। অথচ তোমার মতন একটা তরতাজা মেয়ে চাইলে পৃথিবীতে অনেক সুন্দর কাজের স্বাক্ষর রাখতে পারতে। কোনোদিন কি দেখেছো মানুষের সত্যিকারের দুঃখ-কষ্ট, দেখো নাই। তাই এই দুঃখের বিলাসিতার জীবন বেছে নিয়েছো। মামা, মামী এমন ভালো মানুষ, কত বিশাল হৃদয়, ওদের মেয়েটা এমন অগভীর মনের হলো কী করে ?
অকারণ মন খারাপ রাগ হতে থাকে তাতাইর। লিমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সে মুহূর্তে আয়শা ছুটতে ছুটতে এসে বলে,
– মেহমান এসেছে।
– আবার কারা এল, লিমা প্রশ্ন করে ?
– যাদের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি ক’দিন ধরে, তুমি দিনদুনিয়ার কিছুর মধ্যে নেই লিমা আপা, এটা ঠিক না। চল আয়শা দেখা করি। ওরা লিমার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। লিমা দরজা বন্ধ করে ফেলে।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent