রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

কানাডায় নিউ ফ্রান্স

 

মন্ট্রিয়ল ছবি মাইকেল ডিচার্লসডে

উত্তর আমেরিকায় কানাডার এই অঞ্চলে প্রথম ফরাসি অভিযাত্রীরা এসে যে উপনিবেশ গড়েছিল তার নাম দিয়েছিল ‘নিউ ফ্রান্স’। ১৭০০ এর গোড়ার দিকে, ফ্রান্স সমুদ্র তীরের প্রদেশ গুলিতে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল যা আজকের হিসাবে আধুনিক অন্টারিও, কুইবেক ও হাডসন বে অঞ্চল। এই অঞ্চলটি ক্রমে উত্তর-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মেক্সিকো উপসাগর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। তখন কুইবেক শহর ছিল প্রথম সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু এবং নিউ ফ্রান্সের বসবাসকারী ফরাসিরা একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতিও তৈরি করেছিল। ফরাসি জনগণ বিদেশী বসবাসকারী হিসাবে পরিচিত ছিল আদিবাসীদের নিকট। ফ্রান্সের কৃষকদের তুলনায়, এখানে আসা অনেক অভিবাসীর জীবন সমৃদ্ধ হয়েছিল। তবু ফ্রান্স থেকে খুব বেশি লোক নিউ ফ্রান্সে আসতে চায়নি, বেশিরভাগ মানুষ মনে করত নিউ ফ্রান্স খুব ঠান্ডা এবং খুব বিপজ্জনক। এখানে অভিবাসন খুব কম হয়েছিল ফলে নিউ ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যাই ছিল খুব কম। ১৭৬৩ সালে প্রায় ৭০,০০০ ফরাসি নিউ ফ্রান্সের এই উপনিবেশে বসবাস করত। এই ক্ষুদ্র জনসংখ্যা নিউ ফ্রান্সকে দুর্বল করে রেখেছিল, ১৭৬৩ সালে ব্রিটেন কর্তৃক দখল নেওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল এটি, আজও অনেকে এমনটা মনে করেন।

- Advertisement -

ফরাসি অনুসন্ধান :
প্রথম ফরাসি অভিযাত্রী যিনি কানাডায় এসেছিলেন তার নাম ছিল জ্যাকি কার্টিয়ার। ১৫৩৪ থেকে ১৫৪২ সাল অবধি তিনি তিনবার সমুদ্র অভিযান করে কানাডার এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তিনিই প্রথম ইউরোপীয় যিনি সেন্ট লরেন্স নদীতে চলাচল করেন, অঞ্চলের প্রথম ম্যাপ তৈরি করেন এবং ম্যাপে কানাডা নামটি দেখান। তাকে ফরাসি রাজা সোনা ও সম্পদের খুঁজে পাঠিয়েছিল কিন্তু তিনি তা করেননি, তাই ফ্রান্স কানাডার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। এছাড়াও ১৬ শতকের শেষের দিকে ফ্রান্স ধর্মীয় যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, অনুসন্ধানে বিশেষ মনোনিবেশ করতে পারেনি।

মন্টিয়াল নামের উৎস :
ফরাসিদের আগমনের আগে, সেন্ট লরেন্সের তীরে আদিবাসী ইরোকোয়ানরা বসবাস করত হোচেলাগা নামের গ্রামে। তারা হাউডেনোসাউনি বা যাকে “লংহাউস” বলা হত, (অর্থাৎ ঘর গুলো লম্বা লম্বা ছিল) সেখানে বাস করত, সাধারণত এদেরকেই ইরোকুইস বলা হত। এরা এই অঞ্চলে প্রভাবশালী আদিবাসী জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল।
জ্যাকি কার্টিয়ার যখন ১৫৩৫ সালে হোচেলাগা নামের গ্রামে পৌঁছেছিলেন, তিনি আদিবাসী নেতার সহযোগিতায় একটি পাহাড়ে আরোহণ করেছিলেন, পাহাড়ের চূঁড়ায় পৌঁছে আশেপাশের ভূখণ্ডের এবং সেন্ট লরেন্স নদীর এক অপূর্ব মনোরম দৃশ্য দেখেন। কার্টিয়ার এই অভূতপূর্ব সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়েছিলেন এবং একে মন্ট-রয়্যাল (মাউন্ট রয়্যাল) বলে উল্লেখ করেছিলেন। এই মন্ট-রয়্যালের উচ্চারণ থেকেই পরে যখন শহর স্থাপন করা হয়, নিউ ফ্রান্সে এ শহরের নামকরণ করেছিল মন্টিয়াল।

স্যামুয়েল ডি চ্যাম্পলাইন নিউ ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠাতা :
১৭ শতকের প্রথম দশকে ফ্রান্স আবার নিউ ফ্রান্সের অঞ্চল নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে, ১৬০৪ সালে একদল অভিযাত্রীকে পুনঃ কানাডায় পাঠায়। তারা প্রথমে আটলান্টিকের উপকূলে এসেছিল, স্যামুয়েল ডি চ্যাম্পলেন এই দলের প্রধান ছিলেন। তিনি নিউ ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন হয়ে ওঠেন অল্প সময়ের মাঝে। চ্যাম্পলেন ১৬০৮ সালে কুইবেক সিটি প্রতিষ্ঠা করেন। জ্যাকি কার্টিয়ারের থেকে ভিন্ন ভাবনায় তিনি একটি ফরাসি উপনিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন এবং তার জন্য অগ্রগতি লাভ করেছিলেন। তিনি নিউ ফ্রান্সের প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন, অনেক ইতিহাসবিদ তাকেই নিউ ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করেন।

কুইবেক নামের উৎস :
একটি নামের উৎস খুঁজে বের করার জন্য ফরাসিরা অঞ্চলের আদিবাসী নামের গুরুত্ব বিবেচণা করেছিল। যেখানে নদী সরু হয়ে আসে ঐ স্থানকে সেখানকার আদিবাসীরা কেবেক বলে উচ্চারণ করে, এটি অ্যালগনকুইন শব্দ কেবেক থেকে উদ্ভব হয়েছিল। বিভিন্নভাবে অনুবাদ করা হয়েছিল এবং শহরের অবস্থানের সাথে জায়গার আদিবাসী নামকে স্মরণে রাখতে স্যামুয়েল ডি চ্যাম্পলেন শহর প্রতিষ্ঠার পর কুইবেক নামকরণ নির্বাচন করেছিলেন।

নিউ ফ্রান্স: সমাজ ও অর্থনীতি
১৭ শতকের প্রথম কয়েক দশকে নিউ ফ্রান্সের অর্থনীতি এবং জনসংখ্যা দুর্বল ছিল। নিউ ফ্রান্সের নেতারা অর্থনীতির বিকাশে তেমন আগ্রহী ছিলেন না মনে করা হয়। বেশিরভাগ সময়ই লোমসহ পশম ব্যবসায় ( ফার ট্রেড ) ব্যস্ত ছিল এবং এই ব্যবসায় তাদের অংশীদার ছিল আদিবাসীগণ। আদিবাসীদের সহযোগিতা ছাড়া পশম ব্যবসার প্রসার হতো না, অস্তিত্বই থাকতো না। আদিবাসীরা ফরাসি তৈরি পণ্যের জন্য বিশেষ করে শিল্পজাত পণ্যের অত্যন্ত উৎসুক ছিল পশমের বিনিময়ে। পরবর্তীতে ফ্রান্সের সরকার চেয়েছিল নিউ ফ্রান্স বৈচিত্র্যময় হোক এবং সমৃদ্ধ হোক। সুতরাং ১৬৬৩ সালে, রাজা লুই নিউ ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নেন। সময়ের সাথে সাথে, নিউ ফ্রান্সের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল তবে অর্থনীতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। ফলে নিউ ফ্রান্স কখনও তেমন বৈচিত্র্যপূর্ণও হয়নি।

আদিবাসীদের সাথে সম্পর্ক :
প্রাথমিক ফরাসি বসতি স্থাপনকারীরা বেঁচে থাকার জন্য আদিবাসীদের উপর নির্ভর করতেই হয়েছিল। ফরাসি অর্থনীতিও আদিবাসীদের পশম ও কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল ছিল। ১৭০০ এর প্রথম দশকের গোড়ার দিকে, পশম ব্যবসা ফরাসিদের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছিল। কখনও কখনও এ নিয়ে ফরাসিদের সাথে আদিবাসীদের যুদ্ধও হয়েছিল । তাদের প্রধান শত্রু ছিল আদিবাসী হাউডেনোসাউনি, আবার ওয়েন্ডাতরা ফরাসিদের মিত্র ছিল। তাদের অনেকেই ফরাসিদের প্ররোচনায় ক্যাথলিক হয়ে উঠেছিল। ফরাসি মিশনারিরা আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করতে খুবই আগ্রহী ছিল। দুঃখজনকভাবে, ওয়েন্ডেটদের একটি বড় অংশ ফরাসিদের থেকে সংক্রামিত হয়ে নানা রোগে মারাও গিয়েছিল।

নিউ ফ্রান্সের পতন :
নিউ ফ্রান্স ব্রিটিশদের সাথে অসংখ্য যুদ্ধ করেছে। তারা উভয়ই উত্তর আমেরিকায় ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিল। এমনকি চূড়ান্ত যুদ্ধ একাধারে সাত বছর চলেছিল ১৭৫৬ সাল থেকে ১৭৬৩ পর্যন্ত। ফরাসিরা শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের নিকট হেরে গিয়েছিল। ব্রিটিশ সামরিক বাহিনী এবং তাদের আদিবাসী মিত্ররা, ফরাসি ও তাদের আদিবাসী মিত্রদের চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী ছিল। অবশ্য নিউ ফ্রান্সের উত্তরাধিকার পুরুষানুক্রমে আজও অনেকে কানাডায় বসবাস করছে কুইবেক প্রদেশে, অনেক ফরাসি ভাষাভাষী কানাডার বাকি অংশেও অন্য অভিবাসীদের মতই শান্তিপ্রিয়ভাবে বসবাস করছে।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent