গঙ্গা কিংবা ব্রহ্মপুত্রের তুলনায় বিশাল কিছু নয়। পাহাড়ি ঢলের মিশ্র জলস্রোতে সৃষ্ট এক মৌসুমী নদী। ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের ধামতারি জেলায় যার উৎপত্তি। ৯০০ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা সর্পিল পথ পেরিয়ে উড়িষ্যার ঐতিহাসিক কটক নগরীকে আলিঙ্গন করেছে। এরপর নানান ডালপালা বানিয়ে বিভিন্ন শাখা নদীর আঁচল ধরে ঝাঁপ দিয়েছে বঙ্গোপসাগরে। চওড়ায় কখনো সর্বোচ্চ আধা কিলোমিটার, কখনোবা একটু বেশি। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় আর উড়িষ্যার মানুষ আদর করে নাম দিয়েছে মহানদী। যদিও চলার পথে অনেক জায়গায় মহানদী প্রশস্ততা হারিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছোটনদীর আকার ধারণ করেছে। কিন্তু নামের মাহাত্ম্য হারায়নি।
নামের মাহাত্ম্য হারাবে কি করে? উপমহাদেশের দীর্ঘতম আড়াআড়ি বাঁধ নির্মিত হয়েছে এ নদীর বুক চিড়ে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার সত্ত্বেও অনেকেই জানিনা বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ হিরাকুদ বাঁধের কথা। মহানদীর পেট বরাবর নির্মাণ করা হয়েছে এই বাঁধ। উড়িষ্যা রাজ্যের সম্বলপুর শহরের শ্রেষ্ঠ সম্বল হিরাকুদ বাঁধ। রেকর্ডের খাতায় ভারতের দীর্ঘতম বাঁধের তকমা লাগিয়ে সম্বলপুরকে বিশ্বে পরিচিত করেছে হিরাকুদ। ইউক্রেনের কিয়েভ ড্যাম সিস্টেম কিংবা আর্জেন্টিনা প্যারাগুয়ে বর্ডারের ইয়াসাইরেটা ড্যাম সিস্টেম, ইত্যাদি সামষ্টিক ধরণের বাঁধের কথা বাদ দিলে বিশ্বের একক সরল দীর্ঘতম ড্যাম হিরাকুদ বাঁধ।
আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণে স্থান নির্ধারণের জন্য যে কয়টি বিষয় বিবেচনায় আনা হয় তার একটি নদীর প্রশস্ততা। আমাজন নদীর সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ১০০ কিলোমিটার। অথচ সরু এলাকায় আমাজন মাত্র ১ কিলোমিটার চওড়া। আমাজন নদীতে বাঁধ দেয়ার প্রয়োজন হলে অবশ্যই অধিকতর প্রশস্ত এলাকা এড়াবার চেষ্টা করা হবে। মহানদীতে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টো হয়েছিলো।
উড়িষ্যার কৃষি ও সেচ উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, মৎস্য চাষ , নদী পাড়ের ভূপ্রকৃতি, পানির গতি এবং নদীর পলি পরিবহনের হার ইত্যাদি বিবেচনায় যে স্থানটি নির্বাচন করা হয়েছিলো তা ছিলো বেশ প্রশস্ত। যে কারণে নদীর উপর বাঁধের মূল সেকশনের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৪.৮ কিলোমিটার। উজানে জল সংরক্ষণের জন্য রিজার্ভর নির্মাণ করা হয়েছে। এতে নদীর দুদিকে ডাইকসহ বাঁধ প্রলম্বিত করা হয়েছে। ফলে বাঁধের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে ২৫.৮ কিলোমিটার। দীর্ঘ এই বাঁধের মাধ্যমে উড়িষ্যা সরকার ৫৯০ কোটি ঘনমিটার অর্থাৎ ৫ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি লিটার জল সংরক্ষণ করতে পারে।
বহুকাল আগে থেকেই উড়িষ্যা বন্যাকবলিত এলাকা। মহানদীর বদ্বীপ এলাকায় প্রতিবছর প্রায় ৮০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা বন্যায় প্লাবিত হতো। যা বাংলাদেশের মোট আয়তনের অর্ধেকের চেয়ে বেশী। কৃষকরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হতো। ব্রিটিশ ভারতে মৎস্য চাষের অন্যতম উপযুক্ত স্থান ছিলো উড়িষ্যা। প্রদেশের বিশাল একটি শ্রেণী মাছ ধরা পেশায় নিয়োজিত ছিলো। আজও উড়িষ্যা মাছ ধরায় একটি অগ্রগামী রাজ্য। ভারতের অষ্টম মৎস্য উৎপাদনকারী রাজ্য উড়িষ্যা। কিন্তু জনসংখ্যা বিচারে কেরালার পর সবচাইতে বেশী মৎস্য চাষ উড়িষ্যায়। অন্ধ্র, পশ্চিমবঙ্গ, তামিল নাড়ু বা গুজরাটে মাছের পরিমান বেশী হলেও জনসংখ্যা অনেক বেশী। ব্রিটিশরাজ উড়িষ্যার কৃষক এবং মৎস্যজীবী বাঁচাতে মহানদীর জল নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করেছিলো। তবে ঔপনিবেশিক ক্ষমতায় থাকাকালীন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তেমন কিছু করেনি।
ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে মুহূর্তে এ প্রকল্প অনুমোদন করে। ব্রিটিশ উড়িষ্যার শেষ গভর্নর স্যার হথর্ন লুইস ১৯৪৬ সালের ১৫ মার্চ হিরাকুদ বাঁধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। বাঁধের আনুষ্ঠানিক রিপোর্ট দেয়া হয় এরও পরে। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে। দুমাস পরেই ভারত স্বাধীন হয়ে যায়। তবে প্রকল্পের কাজ বিন্দুমাত্র আটকে থাকেনি। ১৯৪৮ সালের ১২ এপ্রিল পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু প্রথম কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজ উদ্বোধন করেন। গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধের পরিকল্পনা তখন পর্যন্ত কার্যকর অনুমোদন লাভ করেনি।
প্রকৌশল কাঠামোগত দিক থেকে হিরাকুদ বাঁধ কংক্রিট, ইটের ব্লক এবং মাটির কম্পোজিট স্ট্রাকচার। বাঁধ নির্মাণের নকশা অনুমোদন, নির্মাণ কাজের তদারকি এবং মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫২ সালে মজুমদার কমিটি গঠন করা হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন বা নকশা অনুযায়ী তাঁরা প্রকল্পের খরচ এবং নির্মাণ কাজের মেয়াদ নর্ধারণ করেন। সে অনুযায়ী প্রকল্প ব্যয় ধরা হয় ৯২.৮ কোটি ভারতীয় রুপি। প্রকল্প শেষ করার সময় বেঁধে দেয়া হয় জুন ১৯৫৫ পর্যন্ত।
নকশা মোতাবেক বাঁধের ভাটির দিকে কৃত্রিম জলাধারের মোট এরিয়া দাঁড়ায় ৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার। যা মালদ্বীপের মোট আয়তনের প্রায় আড়াই গুন। হিরাকুদ জলাধার ভারতের একক বৃহত্তম কৃত্রিম হ্রদ। বাঁধ দর্শন এবং কৃত্রিম হ্রদের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নদীর দুপাড়ে বাঁধের উপর দুটি অবজারভেশন টাওয়ার নির্মাণ করা হয়। একটির নাম গান্ধী মিনার, অপরটি জওহর মিনার।
নকশা প্রণয়ন এবং অর্থ বরাদ্দের পর বাঁধ নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে। বাঁধের মূল অংশের নির্মাণ ১৯৫৩ সালেই শেষ হয়ে যায়। নির্মাণে ১০ লক্ষ ৭০ হাজার ঘনমিটার বা প্রায় ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ সিএফটি কংক্রিট ঢালাই করা হয়। আর ১ কোটি ৮১ লক্ষ ঘনমিটার মাটি বা প্রায় ৬৪ কোটি সিএফটি মাটি ভরাট করা হয়।
নির্মাণের পর বাঁধের উচ্চতম স্থানের উচ্চতা দাঁড়ায় সমুদ্রের গড় উচ্চতার চেয়ে ৬৪২ ফুট উপরে। রিজার্ভরের পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা সমুদ্রের গড় উচ্চতার চেয়ে ৬৩০ ফুট উপরে। ৬৪টি স্লুইস গেট এবং ৩৪টি ক্রেস্ট গেট নির্মাণ করা হয়। সব গেট একত্রে খুলে দিলে পানি প্রবাহের সর্বোচ্চ পরিমান প্রতি সেকেন্ডে ৪২ হাজার ৪৫০ ঘনমিটার। কিউসেকে মাপলে পরিমান দাঁড়াবে প্রায় ১৫ লক্ষ কিউসেক। বাঁধের আওতাধীন ক্যাচমেন্ট এরিয়া ৮৩ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার।
হিরাকুদ বাঁধের আটকানো জল থেকে ইচ্ছেমতো প্রবাহ ব্যবহার করে দুটো আলাদা হাইড্রোইলেকট্রিক প্লান্ট চালানো হয়। একটি প্লান্ট বাঁধ সংলগ্ন বুরলা নামক স্থানে। আরেকটি বাঁধ থেকে দক্ষিণপূর্বে ১৯ কিলোমিটার দূরে চিপলিমা নামক জায়গায়। দুটো প্লান্টে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমান ৩৪৭.৫ মেগাওয়াট।
বাঁধের পূর্ণাঙ্গ অপারেশন ক্ষমতা অর্জিত হলে ১৩ জানুয়ারি ১৯৫৭ প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু হিরাকুদ বাঁধ উদ্বোধন করেন। ততদিন পর্যন্ত খরচ হয়ে যায় পুরো ১০০ কোটি রুপি। নির্মাণ খরচের আনুমানিক মূল্য ধরা হয়েছিলো ৯২.৮ কোটি, সে হিসাবে খরচ খুব বেশী বাড়েনি। তবে আজকের বাজারে তা ৮৫০ কোটি রুপি বা ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রতিটি বাঁধ নির্মাণে কিছু ট্রাজেডি থাকে। নির্মাণকালে অনিরাপদ কাজ করতে গিয়ে জীবন যায় অনেক শ্রমিকের। বাঁধ এলাকা থেকে উচ্ছেদ করা হয় অসংখ্য মানুষকে। বনজঙ্গলের প্রাণীদের আশ্রয়স্থল ডুবে যায় নতুবা শুষ্ক মরু এলাকায় পরিণত হয়। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে প্রাকৃতিক নদীর উপর কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ পরিবেশবাদীরা সমর্থন করেন না।
সবচে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে বাঁধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন কাজে। দেড় লক্ষ মানুষ সরাসরি উচ্ছেদ হয় তাঁদের বাপ দাদার ভিটা থেকে। ২২ হাজার পরিবারকে স্থানান্তর করা হয়। বাঁধের প্রাথমিক বাজেটের ১২ কোটি রুপি ধরা হয়েছিলো ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেবার জন্য। পরে বাঁধের নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের বরাদ্দ কমিয়ে দেয়। নতুন বরাদ্দের পরিমান সাড়ে ৯ কোটি রুপি। কিন্তু লজ্জাজনক ভাবে বিতরণের সময় বরাদ্দকৃত অর্থ আরো কমে যায়। ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া হয় মাত্র ৩ কোটি ৩২ লক্ষ রুপি। হাজার হাজার মানুষ টাকা না পেয়ে মনের কষ্টে পৈতৃক নিবাস ফেলে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করেন।
বাঁধ নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য গবাদি পশু। শত দুঃখের মাঝে এক মজার ঘটানোও আছে। হিরাকুদ বাঁধ নির্মাণে সৃষ্ট কৃত্রিম হ্রদে একটি দ্বীপ তৈরী হয়েছে। এর নাম ক্যাটল আইল্যান্ড। আইল্যান্ডটি এককালে একটি গ্রাম ছিলো। কৃত্রিম লেকের পানির কারণে গ্রামটি মূলভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অধিবাসীরা গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। তাঁদের পালিত গবাদি পশুপাখি রয়ে যায়। এখন এই দ্বীপটিতে কেবলমাত্র পশুপাখিরাই বসবাস করছে। অসাধারণ এক অভয়ারণ্য তৈরী হয়েছে এখানে। পর্যটকেরা হিরাকুদ বাঁধ থেকে লঞ্চে করে এখানে আসতে পারে। ক্যাটল আইল্যান্ড ছাড়াও আরো কিছু দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে এখানে।
হিরাকুদ নির্মাণে কতোজন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন সে তথ্য এখন আর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে সে যুগে নির্মাণ কাজে হেলথ, সেফটি এন্ড এনভায়রনমেন্ট বলে ভারতবর্ষে কিছু ছিলোনা। ভারতের নির্মাণ কাজ আজো নিরাপদ হতে পারেনি।
ব্রামটন, অন্টারিও, কানাডা