রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড

আমেরিকাতে যারা দাসপ্রথা বিলোপ করতে চেয়েছিল তাদের একটি গোপন নেটওয়ার্ক ছিল, নাম আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড । তারা আফ্রিকান আমেরিকানদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে উদার উত্তরের প্রদেশ গুলিতে ও কানাডায় পৌছাতে সাহায্য করেছিল। আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড ছিল আদতে উত্তর আমেরিকার দাসপ্রথা বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান অঙ্গ। এটি ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকায় (বর্তমানে কানাডা) ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ পলাতককে নিয়ে এসেছিল।

- Advertisement -

উৎপত্তি
দাসত্বকে সীমিত করার জন্য ১৭৯৩ সালে আইনের একটি বিধানে কানাডা বলেছিল যে কোনো ক্রীতদাস ব্যক্তি আপার কানাডায় ( অন্টারিও ) পৌঁছালে সেখানে সাথে সাথে মুক্ত বলে ধরা হবে। এটি প্রাথমিকভাবে কোন প্রকার সাহায্য ছাড়াই কানাডায় প্রবেশের সুযোগ সন্ধানে অল্প সংখ্যক আফ্রিকান আমেরিকানদের উত্সাহিত করেছিল। উত্তর আমেরিকায় ১৮১২ সালের যুদ্ধের পর কানাডায় ক্রীতদাসদের স্বাধীনতার কথা আরও ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৫০ সালের পর আমেরিকান পলাতক ক্রীতদাস আইন পাস হওয়ার সাথে সাথে আপার কানাডায় স্বাধীনতাকামীদের আগমন নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।

সংগঠন
আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড ১৯ শতকের গোড়ার দিকে মূলত ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভানিয়াতে অবস্থিত একদল স্বাধীনতাকামীদের দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। কয়েক দশকের মধ্যে, এটি একটি সুসংগঠিত এবং গতিশীল নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছিল। ১৮৩০এর দশকে “আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড” শব্দটি ব্যবহার করা শুরু হয়। ততক্ষণে, পলাতক দাসদের সাহায্য করার জন্য একটি গোপন নেটওয়ার্ক ইতিমধ্যেই রূপ নিয়েছিল।
আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড একটি প্রকৃত রেলপথ ছিল না এবং এটি রেলপথে চলতও না। এটি ছিল একটি জটিল, গোপন নেটওয়ার্ক এবং নিরাপদ ঘর যা দক্ষিণাঞ্চলীয় প্ল্যান্টেশনে ক্রীতদাসদের উত্তরে যেতে সাহায্য করেছিল। মানবাধিকার ও সমতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দাসপ্রথা বিলুপ্তিবাদীদের দ্বারা নেটওয়ার্কটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল। তারা পালিয়ে আসা দাসদের সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের নেটওয়ার্কের মধ্যে মুক্ত কালো, সহকর্মী ক্রীতদাস ব্যক্তি, কিছু শ্বেতাঙ্গ, সহানুভূতিশীল আদিবাসী, ব্যাপ্টিস্ট, নগর কেন্দ্রের বাসিন্দা এমনকি কৃষক, পুরুষ ও মহিলা, আমেরিকান এবং কানাডিয়ান লোকজন অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সঙ্কেত এবং কোড
রেলপথ পরিভাষা এবং প্রতীকী গোপন কার্যকলাপের মুখোশ হিসাবে নেটওয়ার্কে ব্যবহার করা হয়েছিল। এটি জনসাধারণ এবং ক্রীতদাস মালিকদের অন্ধকারে রাখতেও সহায়তা করেছিল। যারা ক্রীতদাসদের এ যাত্রায় পালাতে সাহায্য করেছিল তাদের বলা হত “কন্ডাক্টর”। তারা আন্ডারগ্রাউন্ড রেলপথের পয়েন্টে পলাতকদের পথ দেখিয়েছিল, স্থল বা জল পথের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিবহনের উপায় ব্যবহার করেছিল। অন্যতম বিখ্যাত কন্ডাক্টর ছিলেন হ্যারিয়েট টুবম্যান।
“যাত্রী,” “কার্গো”, “প্যাকেজ” এবং “মালবাহী” শব্দগুলো পলায়নকৃত ক্রীতদাসদের উল্লেখ করে। যাত্রীদের “স্টেশন” বা “ডিপোতে” পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল, যা ছিল নিরাপদ ঘর। স্টেশনগুলি “টার্মিনাল” নামে পরিচিত বিভিন্ন শহরে অবস্থিত ছিল। অস্থায়ী আশ্রয়ের এই স্থানগুলি কখনও কখনও জানালায় মোমবাতি জ্বালিয়ে বা সামনের উঠোনে কৌশলগতভাবে স্থাপন করা লণ্ঠন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল।

স্টেশন মাস্টার্স
নিরাপদ বাড়িগুলি “স্টেশন মাস্টার” দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। তারা পলাতকদের তাদের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং খাবার, পোশাক পরিবর্তন এবং বিশ্রাম ও লুকানোর জায়গা দেয়। পরবর্তী ট্রান্সফার পয়েন্টে পাঠানোর আগে তারা প্রায়ই তাদের টাকা দিত। ক্রীতদাস প্রথা বিলোপবাদী উইলিয়াম নামে একজন ফিলাডেলফিয়া, পেনসিলভানিয়ায় একটি স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন, তিনি অনেক স্বাধীনতাকামীদের কানাডা যাত্রায় সহায়তা করেছিলেন। যিনি টুবম্যান এবং তার যাত্রীদের সহ তার স্টেশনে থামানো পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের নাম রেকর্ড করেছিলেন।
জারমেইন লোগুয়েন ছিলেন আরেক কৃষ্ণাঙ্গ স্টেশন মাস্টার এবং এই আন্দোলনের নেতা, তিনি নিউইয়র্কের সিরাকিউসে একটি স্টেশন চালাতেন। ১৮৩৭ থেকে ১৮৪১সাল পর্যন্ত আপার কানাডার হ্যামিল্টন এবং সেন্ট ক্যাথারিনে স্বাধীনভাবে চলাফেরার পর তিনি সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। লোগুয়েনের দাসত্ব বিরোধী বক্তৃতা এবং সংবাদপত্রে তার নিবন্ধগুলির জন্য তিনি সুপরিচিত ছিলেন।

টিকিট এজেন্ট
স্বাধীনতাকামীদের নিরাপদ ভ্রমণের সমন্বয় করার কাজ ছিল টিকিট এজেন্টদের, তারা স্টেশন মাস্টার বা কন্ডাক্টরদের সাথে যোগাযোগ করে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিত। টিকিট এজেন্টরা কখনও কখনও জীবিকার জন্য ভ্রমণ করতেন, যেমন কোন কাজের জন্য বা কেউ প্রচারক কিংবা ডাক্তার হিসাবে। এটি তাদের ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের কার্যকলাপ গোপন করতে সক্ষম করত। উদাহরণ স্বরূপ, বেলভিলে জন্ম নেওয়া ডাক্তার আলেকজান্ডার মিল্টন রস ছিলেন একজন আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড এজেন্ট। তিনি তার পাখি দেখার শখটিকে একটি কভার হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন, যখন তিনি আমেরিকার দক্ষিণের প্রদেশগুলিতে ভ্রমণে যেতেন ক্রীতদাসদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জানাতে। এমনকি তিনি তাদের পলায়ন শুরু করার জন্য কয়েকটি সাধারণ জিনিষপত্র সরবরাহও দিয়েছিলেন। যারা দাসদের পালাতে সাহায্য করার জন্য অর্থ বা সরবরাহ দান করেছিল তাদের বলা হত “স্টকহোল্ডার”।

প্রতিশ্রুত স্থান
স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে পথগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল তাকে “লাইন” বলা হত। পথের নেটওয়ার্কটি ১৪টি আমেরিকার উত্তরের রাজ্য এবং দুটি ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকার উপনিবেশের মাঝ দিয়ে গেছে, আপার কানাডা(অন্টারিও) এবং লোয়ার কানাডায়(ক্যুইবেক)। লাইনের শেষে থাকত “প্রতিশ্রুত স্থান” কানাডা ও উত্তরের রাজ্যে মুক্ত ভূমি ছিল।
যাত্রা যদিও খুবই বিপজ্জনক ছিল। স্বাধীনতাকামীদের ওয়াগন, গাড়িতে, ঘোড়ায় এবং কিছু ক্ষেত্রে ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হতো। কিন্তু আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোড শুধুমাত্র জমির উপর দিয়েই চলে নি, নৌকায করে হ্রদ, সাগর ও নদী পার হত অনেক সময়। তারা প্রায়ই রাতে ভ্রমণ করত এবং দিনে বিশ্রাম করত।

কানাডিয়ান টার্মিনাল
কয়েক দশকের ক্রীতদাস প্রথার সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হতে আনুমানিক ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ স্বাধীনতাকামী কানাডায় প্রবেশ করেছিল। শুধুমাত্র ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ সালের মধ্যে, ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ পলাতক কানাডার দুটি প্রদেশে পৌঁছেছিল। কানাডার দুই প্রদেশ আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোডের প্রধান টার্মিনাল হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতাকামীরা এসে অন্টারিওর বিভিন্ন অংশে চলে গেছে, এর মাঝে নায়াগ্রা জলপ্রপাত, বাক্সটন, চ্যাথাম, ওয়েন সাউন্ড, উইন্ডসর, স্যান্ডউইচ এখন উইন্ডসরের অংশ, হ্যামিল্টন, ব্রান্টফোর্ড, লন্ডন, ওকভিল এবং টরন্টো অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চল যেমন নিউ ব্রান্সউইক, ক্যুইবেক এবং নোভা স্কটিয়াতেও পালিয়ে আসে। এই ব্যাপক অভিবাসনের পরে, কালো কানাডিয়ানরা শক্তিশালী সম্প্রদায় গড়ে তুলেছিল এবং যে যে প্রদেশে বসবাস করেছিল ও কাজ করেছিল তাদের উন্নয়নে অবদান রেখেছিল।
পলাতকদের তাড়া করতে বা তাদের দক্ষিণের মালিকদের কাছে ফেরত দেওয়ার জন্য পিছু ধওয়া করতে সীমান্ত অতিক্রম করে কানাডায় প্রবেশ করেছিল কিছুলোক যদিও তাদের অধিকারের বাইরে ছিল সেটি। এ ব্যাপারে প্রাদেশিক ফ্রিম্যান সংবাদপত্র একটি বিশেষ মামলার বিস্তারিত বিবরণও দিয়েছিল। একজন ক্রীতদাস ধারক এবং তার এজেন্ট আপার কানাডার চ্যাথামে ভ্রমণ করেছিলেন, যেটি একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রীতদাস, কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিদের দ্বারা জনবহুল ছিল।

উত্তরাধিকার

১৮৬৫ সালে মার্কিন সংবিধানের ১৩ তম সংশোধনীতে দাসত্ব প্রথা নিষিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ড রেলরোডের নেটওয়ার্ক চলছিল। স্বাধীনতাকামী, মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ এবং কালো অনুগতদের বংশধররা সমগ্র ব্রিটিশ উত্তর আমেরিকায় বসতি স্থাপন করেছিল।
ক্রীতদাস প্রথা সীমিত বা বিলোপের পেছনে কানাডার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বা মহান অবদান ছিল বলা যায়। ১৭৯৩ সালে আইনের একটি বিধানে কানাডা বলেছিল যে কোনো ক্রীতদাস ব্যক্তি কানাডায় পৌঁছালে সাথে সাথে মুক্ত ব্যক্তি বলে ঘোষনা করা হবে।এমন একটি মানবতাবাদী মহার্ঘ আইন পাশ করার জন্য তদানীন্তন কানাডার সরকারকে অবশ্যই আমরা স্যালুট জানানো চাই।

স্কারবোরো, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent