শনিবার - মে ১৮ - ২০২৪

যে ছিলো আমার স্বপনচারিণী

(রবীন্দ্রনাথের গানের নেপথ্য গল্প)
১১ অক্টোবর ১৮৯৫ সাল। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বেশ ঝক্কি ঝামেলা গেছে। গ্রামের কৃষকদের নিয়ে সভা ছিল নিচতলার কাচারী বাড়ির বৈঠক খানায়। সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই রবি বাবুর কানে ভেসে এলো নায়েব মশাইর ঘোষণা- জমিদার বাবু শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ মহাশয় কাচারী বাড়িতে আগমন করবেন। প্রজা সকল সম্মানপূর্বক দন্ডায়মান হও। সেরওয়ানী, উত্তরীয় আর পাগড়ী পরিহিত রবীন্দ্রনাথ বৈঠক খানায় প্রবেশ করলেন। মেহগনী কাঠের তৈরী কারুকাজ করা লাল রং এর গদিযুক্ত একটি প্রাচীন আমলের কেদারা এগিয়ে দেয়া হলো, যেখানে জমিদার বাবু আসন গ্রহণ করবেন।
ঘরে ঢুকেই রবি বাবু বেশ বিরক্ত হয়ে ইশারায় বলরামকে কাছে ডাকলেন। তারপর লঘুস্বরে বললেন- বলরাম, এই কেদারাটি এখানে কেন ?
নায়েব মশাই পাশেই ছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন- বাবু, আপনার পূর্ব পুরুষরা এই কেদারায় আসন গ্রহণ করেই কাচারী বৈঠক পরিচালনা করতেন।
রবীন্দ্রনাথ নায়েব মশাইর দিকে একবার তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে বিরক্তির চিহ্ন স্পষ্ট। তিনি বলরামকে নির্দেশ দিলেন কেদারাটি সরিয়ে নেয়ার জন্য। তার বদলে জল চৌকিতে আসন পেতে বসলেন। তারপর উপস্থিত সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, আপনারা সকলে বসুন।
তিনি প্রজাদের অভাব অভিযোগের ফিরিস্তি শুনলেন। খরা মৌশুম, সেচের অব্যবস্থা, ইত্যাদি নানা কারনে এবার ফসল ভালো হয়নি। অতএব, খাজনা আদায়ে ঘাটতি পড়বে। বৈঠক শেষে তিনি আজ মধ্যাহ্নে অন্ন গ্রহণ করলেন না। দ্বিতল বারান্দার আরাম কেদারায় কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন খেয়াল নেই। বলরামও এসে বাবুকে আর বিরক্ত করে নি। ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে বলরাম এলো প্রদীপ জ্বালাতে। বাবু সাধারণত মধ্যাহ্নের পর এক গেলাস নিম পাতার রস পান করেন। আজ ঘুমিয়ে পড়ার কারনে বাবু সেই তেতো রস পান করতে ভুলে গেছেন।
বলরাম সে কথা মনে করিয়ে দিতেই বাবু বললেন- তোমার এই বাসি রস নিয়ে যাও। তুমি বরং দার্জিলিং থেকে আনা চা পাতার টাটকা গরম জলে এক চামচ মধু মিশিয়ে নিয়ে এসো। কিছুদিন আগেই জগদিশ বাবু কোলকাতা থেকে এক বাক্স দার্জিলিং চা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন। রবি বাবু সেই চায়ের গন্ধ খুব পছন্দ করেন। সিরামিকের ওপর জাপানি ঢং এর নকশা করা একটি বিশেষ পেয়ালা আছে। বলরাম সেই পাত্রে বাবুর জন্য পেয়ালা ভরে চা দিয়ে গেলেন।
নিভৃতচারী রবীন্দ্রনাথের কাছে খাজনা আদায়ের এই জমিদারী খুব একটা পছন্দের কাজ নয়। গ্রাম গঞ্জে কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের জন্য লোক শাসানো আর বলপ্রয়োগ তিনি অপছন্দ করেন। কিন্তু বাবা মশাইর আদেশ অমান্য করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রথম দিকে জ্যোতি দাদাই জমিদারী দেখাশোনা করতেন। তখন জ্যোতি দাদার সাথে দু একবার শিলাইদহে এসেছিলেন। তাঁর হাতেই রবির জমিদারীতে হাতে খড়ি। পরবর্তীতে জ্যোতি দাদা নাটক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এখন রবির ওপর শিলাইদহের জমিদারী দেখাশোনার দায়িত্ব এসে পড়েছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রবি বারান্দায় রেলিং ঘেষে দাঁড়ালেন। এখান থেকে আকাশের তারা আর পদ্মার জল দুটোই দৃশ্যমান। রবির যখন বারো বছর বয়স তখন বাবা মশাইয়ের সাথে বোলপুর হয়ে দার্জিলিং এবং হিমালয়ে ভ্রমণে যান। সেই সময় আকাশের তারা বৃন্দের সাথে পরিচয় ঘটে। বাবা মশাই তাঁকে লুব্ধক আর কালপুরুষ চিনিয়েছিলেন।
বাবা মশাই বলেন জ্যেতিষশাস্ত্রে কালপুরুষ নিয়ে এক অদ্ভুত কুসংস্কার আছে। কিংবদন্তীও বলা যায়। কাল পুরুষের প্রভাবে নাকি মানুষ গৃহত্যাগী হয়। আজ সেই কথা মনে পড়ে গেল। এই নির্জন কুঠি বাড়ির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রবির নিজেকে ভীষণ একা মনে হচ্ছে।
একমাত্র নতুন বৌ ঠাকুরনই রবিকে রবির মতো করে চিনতো। জ্যোতি দাদা তখন নাটক নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। বিনোদিনী তখন থিয়েটারের নায়িকা। এই সময়ে নতুন বৌ ঠাকুরনের সাথে রবির বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সাহিত্যে বৌ ঠাকুরনের প্রবল অনুরাগ ছিল। বাংলা সাহিত্যের বই তিনি যে কেবল পড়তেন সময় কাটাবার জন্য, তা নয়। তা যথার্থই তিনি মন দিয়ে উপভোগ করতেন। সাহিত্যে তাঁর রসবোধও ছিল গভীর। বিহারীলালের কবিতা তাঁর বিশেষ পছন্দের। বৌ দিদির এই পক্ষপাতিত্ব নিয়ে রবির কিঞ্চিত ইর্ষা বোধ ছিল। তবে রবি যেদিন নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতা টি বৌঠানকে শোনান সেদিন রবির কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছিল বৌঠানের চোখ মুখে।
জ্যোতিদাদার অবহেলা কিনা জানি না, বৌ ঠাকরুন অভিমান এবং হতাশা নিয়ে অনন্তযাত্রা করেন। সেই থেকে রবি একেবারে একা। মাঝে মধ্য ইন্দিরাকে চিঠি লিখেন, কিন্তু তা কেবল মনের মধ্য জমে থাকা ভাব প্রকাশের জন্য। রাত এখন অনেক গভীর হয়েছে। এই নিভৃত পল্লীর কুঠিবাড়িতে একমাত্র ঝি ঝি পোকার ডাক ছাড়া সব কিছুই সুনসান। রবি বারান্দার দরজার সিটকিনি লাগিয়ে ঘরে ঢুকলেন। প্রদীপের আলোটা টিম টিম করে জ্বলছে। কামরার মাঝখানে দাড়িয়ে রবি দেয়ালে একটা ছায়া দেখতে পেলেন। তাঁর কানে দূর থেকে যেন ভেসে আসছে একটি আইরিশ মেলোডির সুর।
Ye banks and braes o’ bonnie doon
How can ye bloom sae fresh and fair?
How can ye chant ye little birds
And i sae weary full o’ care?
Ye’ll break my heart ye warbling birds
That wanton through the flowery thorn
Ye ‘mind me o’ departed joys
Departed, never to return!
এতোক্ষনে তাঁর ভুল ভাংলো। এটাতো আসলে আইরিশ নয়, স্কটিশ গানের সুর। লুসি স্কটের কণ্ঠে তিনি শুনেছেন। রবির জীবনে প্রথম বিদেশিনী বান্ধবী লুসি স্কট। ১৮৭৯ সাল, আঠারো বছরের রবীন্দ্রনাথ তখন লন্ডনে। বাবা মশাইয়ের ইচ্ছা তিনি কনিষ্ঠ পুত্রকে ব্যারিস্টারি পড়াবেন। মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের অফিসার। স্নেহের আড়ালে দাদার মৃদু অভিযোগ রয়েছে- রবিটা এতো অন্তর্মুখী আর চুপচাপ স্বভাবের হয়েছে যে তাকে নিয়ে ভারি মুশকিল। কোলকাতার স্কুলে না পড়ুক কিন্তু ঠাকুর বংশের তো একটা মান মর্যাদা আছে। শুধু গান আর কবিতা লিখলেই হবে! যে করেই হোক রবির এই আড়ষ্ঠতা ভাংতে হবে।
তাই লন্ডনে যাবার আগে রবিকে পাঠানো হলো বোম্বাই শহরে। সেখানে রয়েছে তাঁর বন্ধু ডাঃ আত্মারাম পান্ডুরঙের সদ্য বিলেত ফেরত কন্যা অন্নপুর্না। ডাক নাম আন্না। রবির বয়স সতেরো আর আন্নার বিশ। চঞ্চলা, চপলা, মায়াবী সুন্দরী আন্নার ইংরেজি উচ্চারণ আর ভাষায় ভালোই দখল। বিলেতি আদপ কায়দাও রপ্ত করেছে। প্রথম আলাপেই আন্না রবিকে বললো- রবি, তুমি আমাকে আনা বলে ডাকবে, কেমন !
সকাল সন্ধ্যা আনার সান্নিধ্যে ইংরেজি ভাষা চর্চায় রবির আড়ষ্ঠতা কেটে যায়। শুধু তাই নয় তাদের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষায়িত্রীর ভূমিকা পাল্টে যেয়ে এক নিবিড় বন্ধুত্ব তৈরী হয়। আনার চটুলতায় রবি বেশ আমোদিত হয়। চার মাস আনাদের বাড়ীতে থেকে রবিকে আবার ফিরে যেতে হবে। তারপর বিলেত যাত্রা।
ফেরার সময় আনা রবির দিকে তাকিয়ে বললো- আমার একটা কথা রাখবে ?
– কি ?
– তুমি কোনদিন দাড়ি রেখো না।
– কেন একথা বললে ?
আনা সলাজ চোখে বললো –
– বোকা ছেলে! এটাও বোঝ না। তোমার মুখের রূপ যেন ঢাকা না পড়ে, এই জন্য।
মুহুর্তেই রবির সম্বিত ফিরে এলো। সে স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পেল পিয়ানো। সেখানে বসে আসে লুসি স্কট। তার দক্ষ অঙ্গুলী চালনে ভেসে এলো সেই স্কটিশ গানের সুর
You remind me of departed joys
Departed, never to return!
রবি সেই সুরে রচনা করলো তার নিজস্ব লিরিক-
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে
বহে কিবা মৃদু বায়
তটিনীর হিল্লোল তুলে
কল্লোলে চলিয়া যায়
পিক কিবা কুঞ্জে কুঞ্জে
কুউহু কুউহু কুউহু গায়
কি জানি কিসের লাগি
প্রাণ করে হায় হায়!
লুসি পিয়ানো বাজাচ্ছে, রবি সেই সুরে তাল মিলিয়ে বাংলা গান গাইছে। গানটা শেষ হতেই লুসি উঠে এসে রবির গালে বসিয়ে দিল চুমু। রবিকে লুসি রবিন বলে ডাকতো।
– হাউ সুইট, রবিন! প্লিজ টিচ মি ইওর বেংগলি লিরিকস।
আজ থেকে সতের বছর আগে লুসির সাথে রবির শেষ দেখা। এক পড়ন্ত বিকেলে লুসিদের বাড়ির বাগানের ব্যাক ইয়ার্ডে রবি আর লুসি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সেদিন ভিভিয়ানের সাথে রবিকে ঘনিষ্ঠ হয়ে একান্তে আলাপ করতে দেখে লুসির খুব অভিমান আর র্ঈষা হয়েছিল। তাই রবি যখন লুসিকে থিয়েটারে যাবার আমন্ত্রণ জানায়, তখন লুসি মুখ ঘুরিয়ে বললো, আমি কেনো তোমার সাথে যাবো? গিভ মি ওয়ান রিজন?
রবি বললো, কারন আমি অন্যদের মতো না।
লুসি বললো, তাই নাকি! রিয়েলী! অন্যদের মতো না মানে কি?
লুসি তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে বললো, আচ্ছা, বলো তো আমার চোখের রং কি?
রবি বললো, প্রথম দৃষ্টিতে তোমার চোখের মণি বাদামী রঙের মনে হয়। কিন্তু যখন সেই চোখে বিকেলের আলো এসে পড়ে তখন তা হয়ে যায় কিছুটা লালচে। কিন্তু খুব কাছে থেকে তাকালে মনে হয় স্বচ্ছ মধুর রং। আর যখন তুমি আকাশের দিকে তাকাও তখন সেখানে এসে পড়ে একটা নীল আভা। আ ব্লুয়িশ শেড। এবং সেটাই আমার সবচে প্রিয় রঙ।
রবি একটু হেসে বললো, আমি কি ঠিক বলেছি?
লুসি রবির বাক চতুরতাকে সর্ম্পূণ অগ্রাহ্য করে বললো, আমি তো জানি শুধুই বাদামী।
রবি বললো, তুমি ভুল জানো। নিজের চোখ তো সে প্রতিবিম্বে দেখে। আয়নায় কি সব রঙ ধরা পড়ে?
তাহলে সেদিন তুমি আমার কাছ থেকে পালালে কেন?
রবি ভিভিয়ানের সাথে পার্টির আলাপের ব্যাপারটা কিছুটা আচ করতে পারে, বুঝতে পারে লুসির অভিমানের কারণ।
রবি বললো, পালাই নি তো। তোমার কাছ থকেে একটু লুকিয়ে ছিলাম।
লুসি বললো, না তুমি বানিয়ে বলছো। এই সব তোমার কথার জাদু, চাতুরী।
রবি বললো, দেখো শীত কালে যখন তুষার পড়ে কিংবা বসন্তে যখন একরাশ গাছের পাতা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে থাক, তখন মন হয় উদাসী, বিষন্ন। আবার সামারে যখন সেইসব গাছে না না রঙের ফুল ফোটে, পাতার রং পাল্টে যায়, তখন পৃথিবী হয়ে ওঠে রঙিন। এই যে মনের রঙ পাল্টে যায়, এটাকে তুমি মনের চাতুরী বলবে?
লুসি একমনে রবির কথা শুনছিল। রবি যখন কথা বলে তখন তাঁর চোখ থেকে চোখ সরাতে পারে না। সব অভিমান ভুলে রবির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ মুখে ফিরে আসে উচ্ছলতা।
লুসি বললো, চলো রবিন, আজ আমি তোমাকে পিয়ানোতে একটা গানের সুর শোনাবো। সেই সুরে তুমি লিরিক্স সাজাবে। এটা রবি আর লুসির এক মজার খেলা।
আজ এতোদিন পরে এই নিভৃত নির্জনে লুসি ফিরে এসেছে। রবির সামনে দাড়িয়ে আছে। রবিকে সে অনুযোগের স্বরে বলছে
– ডারলিং রবিন! উড ইউ রাইট এ সং ফর মি? ওনলি ফর মি !
আই ওয়ান্ট টু হিয়ার ইউর ভয়েস!
ভুতগ্রস্থের মতো নিথর দাড়িয়ে আছেন রবি। লুসি বলছে- রবিন, তুমি আমার কোমরে হাত রাখো। কামঅন, এসো আমরা ট্যাংগো ড্যান্স করি, আর্জেনটেনিয়ান ড্যান্স। লুসি রবির কাঁধে তার বাঁ হাত রাখলো । আর তার ডান হাতে তুলে নিলো রবির বাঁ হাত । এসো আমরা তোমার গানের ছন্দে পা মিলাই ।
রবি তাঁর ছায়াসঙ্গির সাথে পা মিলাতে মিলাতে খাম্বাজ রাগ আর কির্তনের সংমিশ্রনে রচনা করলেন এক তন্ময়তার সুর, লঘু চালে।
আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী
তুমি থাক সিন্ধু পারে
ওগো বিদেশিনী
তোমায় দেখেছি শারদ প্রাতে
তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে
তোমায় দেখেছি ….
হৃদি মাঝারে
ওগো বিদেশিনী
আমি আকাশে পাতিয়া কান
শুনেছি শুনেছি তোমারি গান
আমি তোমারে সঁপেছি প্রাণ
ওগো বিদেশিনী …
লন্ডন শহরের ধুসর মেঘলা শীতল আবহাওয়া রবির ভালো লাগতো না। তাই তাঁর আর ব্যরিষ্টারী পড়া হলো না। দেশে ফিরে আসার পর বাবা মশাই রূষ্ট হলেন, বিরক্তও বটে। শেষমেষ রবিকে পাঠিয়ে দিলেন শিলাইদহ, শাজাদপুর আর পতিসরের জমিদারী দেখাশোনা করার কাজে।
১৮৭৯ সালের পর লুসি স্কট আর কখনো ফিরে আসেনি রবির জীবনে। রবি প্রায়ই শুনতে পান বিদায় বেলায় লুসির সেই কণ্ঠস্বর-
– ইউ আর রিয়েলি গোয়িং, আরন্ট ইউ ?
ও যে মানে না মানা। মুখপানে চেয়ে বলে না না না। আখি ফিরাইলে বলে না না না…
এই ঘটনার এগারো বছর পর ১৮৯০ সালে রবি আবার বিলেত যান। সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ লন্ডন পৌঁছান। পরের দিন ১১ সেপ্টেম্বর গিয়েছিলেন লুসিদের পৈতৃক বাড়িতে। বাড়ীর পরিচারিকা জানালেন যে লুসি এই বাড়িতে আর থাকেন না। কেউ জানে না লুসির ঠিকানা।
ইউরোপ যাত্রীর ডায়েরিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন- একবার ইচ্ছে হল, অন্তঃপুরের সেই বাগানটা দেখে আসি। আমার সেই গাছগুলো কত বড় হয়েছে। আর সেই ছাদের উপরকার দক্ষিণমুখো কুঠরি, আর সেই ঘর …
কিন্তু লুসিই যখন নেই, নিরুদ্দেশ, তাহলে শুধু শুধু বাগান আর ঘর দেখে কি হবে। অগত্যা ফিরে গেলেন রবি।
১৯২৪ সাল ১১ নভেম্বর। রবীন্দ্রনাথ জাহাজে করে চলেছেন পেরুর উদ্দেশ্যে। পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে যাত্রীবাহী জাহাজ। আর্জেন্টিনার কাছাকাছি এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথ। সেই যাত্রায় রবীন্দ্রনাথের সংগী ছিলেন লেনার্ড এলমহাষ্ট। অসুস্থতার কারনে যাত্রা বিরতি নিতে হলো। বুয়েনাস আইরেসে আশ্রয় নিলেন প্লাজা হোটেলে। সেখানে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে আসেন নারীবাদী লেখিকা এবং সুর (SUR) পত্রিকার সম্পাদিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তিনি বেশ বিচলিত হলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের জন্য প্লাতা নদীর পাশে মনোরম পরিবেশে একটি বাড়ি ভাড়া করলেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গেলেন সেই সুরম্য ভবনে।
ইতিমধ্যে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ ইংরেজি ছাড়াও স্পানিশ এবং ফরাসী ভাষায় অনুদিত হয়েছে। ভিক্টোরিয়া সেই কাব্য গ্রন্থের অনুবাদ পড়েছেন। ওকাম্পোর জীবনে বিচ্ছেদের এক কঠিন সময়ে এই গ্রন্থের কবিতা পড়ে তিনি পেয়েছেন এক ধরনের শান্তি। সেই মুগ্ধতার কারনেই কবির প্রতি তাঁর এই অনুরাগ। রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার নাম রাখেন বিজয়া। রবির বয়স তখন ৬৩ আর ওকাম্পোর ৩৪। কিন্তু তাতে কি ? দুইজনার মাঝে গড়ে ওঠে এক প্লেটোনিক রোমান্টিক সম্পর্ক। পড়ন্ত বয়সের এই মানস প্রিয়াকে কবি উৎসর্গ করেন তার সেই গান ‘ওগো বিদেশিনী’।
গবেষণা সহকারী :
শিবু কান্তি ঘোষ
তথ্য সূত্র:
অভিজিৎ রায়
রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
ডকুমেন্টারি: রবীন্দ্রনাথ, ঋতুপর্ণ ঘোষ
ছিন্ন পত্র, ইউরোপ যাত্রীর ডায়েরি
এবং রবীন্দ্র রচনাবলী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- Advertisement -

Read More

Recent