রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

নীল নদে আসওয়ান বাঁধ

প্রায় সব ভাষাতেই নীল নদ নিয়ে গল্প কবিতা লিখেছেন সাহিত্যিকেরা। ইতিহাসের পাতায় এ নদী খ্যাত হয়েছে অনেক কারণে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ নদীর আলাদা গুরুত্ত্ব রয়েছে। আব্রাহামিক রিলিজিয়নের বিশ্বাস অনুযায়ী ফেরাউন ডুবে মরেছিলো এ নদীর জলে। এগারোটি দেশ পাড়ি দিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম নদীর খেতাব পেয়েছে আফ্রিকার নীল নদ। কেনিয়া, উগান্ডা আর তানজানিয়ার মধ্যবর্তী ভিক্টোরিয়া হ্রদের পানি নীল নদ হয়ে পতিত হয়েছে ভূমধ্যসাগরে। পতনের আগে বিদায় সংবর্ধনা পেয়েছে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার নগরীর কাছে। প্রায় পৌনে সাত হাজার কিলোমিটার পথ পেরোবার পর আলেকজান্দ্রিয়াই নীল নদের শেষ নাগরিক ঠিকানা।
এমন ঐতিহাসিক নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের ইতিহাসটাও বেশ বড়। একাদশ শতাব্দীতে ফাতিমিদ খেলাফতের সময় মিশরে প্রবল বন্যা হয়। খলিফা আল-হাকিম বি-ওমারাল্লাহ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সেসময় ইরাকের বসরা শহরে ছিলেন বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ ইবনে আল-হেতাম। পশ্চিমা বিশ্বে যাঁকে আলহাজেন নামে ডাকা হয়। ইবনে আল-হেতাম পলিম্যাথ, পদার্থবিজ্ঞান এবং প্রকৌশলবিদ্যায় তখনকার বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। খলিফা সমন জারী করে তাঁকে কায়রো নিয়ে এলেন। খলিফা চাইলেন বাঁধ বানিয়ে নীলনদের পানি আটকাতে। আল-হেতাম নদী জলের উৎস প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেন। ভিন্ন মৌসুমে জলের উচ্চতা, নদীর গভীরতা, স্রোতের বেগ এবং ভূ-প্রকৃতিগত অসংখ্য ডাটা সংগ্রহ করলেন। সেগুলোর গাণিতিক বিশ্লেষণ করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন এমন প্রমত্তা নদীকে বাঁধ দিয়ে আটকানো যাবেনা। খলিফা তাঁর মাঠ পর্যায়ের তথ্য উপাত্ত এবং বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনায় কনভিন্সড হয়ে বাঁধ নির্মাণের চিন্তা থেকে সরে দাঁড়ান।
যে জাতি যান্ত্রিক সহায়তা ছাড়া পিরামিডের মতো আশ্চর্য স্ট্রাকচার তৈরী করেছিলো, তাঁরা সেসময় নীলনদে বাঁধ বানাতে পারেনি। ভাবলে রীতিমত খটকা লাগে। বিজ্ঞানী, গণিতবিদ এবং প্রকৌশলী হিসাবে আল-হেতামকে দূর্বল মনে হয়। কিন্তু আসলে কি তাঁর ডাটা এনালাইসিস ভুল ছিলো? মোটেও নয়। তিনি জলস্রোতের গতি প্রকৃতি বিবেচনা করে এবং তৎকালীন নির্মাণ প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা ভেবে বাঁধ নির্মাণের সাহস করেননি। এই নদীতে বাঁধ নির্মাণ কতোটা কঠিন, সাড়ে আটশো বছর পর সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের কথায় সেটা বোঝা গিয়েছিলো। ১৯৬৪ সালে নীলনদের উপর বাঁধ নির্মাণ চলাকালে ক্রুশ্চেভ সাইট ভিসিটে এসেছিলেন। তিনি ভয়ঙ্কর নির্মাণ পদ্ধতি দেখে বলেছিলেন, এ নদীতে বাঁধ হলে সেটিই হবে বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য!
মিশরের প্রেসিডেন্ট তখন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ গামাল আব্দেল নাসের। বাংলাদেশে যাঁকে জামাল আব্দুল নাসের নামে সবাই চেনে। সময়টা তখন কোল্ড ওয়ার বা শীতল যুদ্ধের। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই পরাশক্তি। নীলনদের উপর বাঁধ হবে আর পরাশক্তি হয়ে চুপচাপ বসে থাকবে দুই মোড়ল? তাই কি হয়? না, দুই মোড়লের কেউই চুপ থাকেননি। নাসেরকে ফুঁসলিয়েছেন দলে টানতে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন ডুইট আইসেনহাওয়ার। সেক্রেটারি অব স্টেট অর্থাৎ পররাষ্ট্র মন্ত্রী জন ফস্টার ডালাসকে দিয়ে প্রস্তাব দিলেন মিশরকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হবে যদি নীলনদের বাঁধ নির্মাণে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা বাহিনীকে তদারকি এবং প্রশিক্ষণের জন্য রাখা হয়। সাথে ২৭০ মিলিয়ন ডলারের অর্থ সহায়তা। ইঙ্গো মার্কিন জোট তখন ভীষণ সন্তুষ্ট এবং আশাবাদী নাসেরের ব্যাপারে। কেনোনা আরব ইসরাইল কনফ্লিক্ট নিরসনে নাসের বিরাট ভূমিকা রেখেছেন।
ইঙ্গো মার্কিন প্রস্তাবে রাজি হননি মিশর রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দেল নাসের। বরং আলোচনায় ডাকলেন সোভিয়েত ইউনিয়নকে। সে আলোচনাকেও বলা হয়েছিলো কনসালটেশন বা পরামর্শ আলোচনা। মোড়লদের আধিপত্য মেনে নেননি তিনি। কমিউনিজম, ক্যাপিটালিজম এবং ইম্পেরিয়ালিজমের বিরুদ্ধে তিনি নিজেকে নিউট্রালিস্ট বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।
নীলনদের উপর বাঁধ হবে। সারা বিশ্বে সাজ সাজ রব। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হয়েছে বছর দশেক হলো। নয়া চীনের সমাজতান্ত্রিক সরকারকে মেনে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর মিত্ররা। গামাল আব্দেল নাসের স্বীকৃতি দিলেন। তুরস্ক ইরাক তাকিয়ে রইলো যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। এরপরও কিভাবে যুক্তরাষ্ট্র নীলনদের বাঁধে অর্থ যোগাতে চায়? এর সাথে আবার জড়িয়ে গেলো চেকোশ্লোভাকিয়ায় অস্ত্র বিক্রয়ের বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন তাঁদের বরাদ্দ ফিরিয়ে নিলো। বাঁধ নির্মাণের ফান্ড নিয়ে ঘোলাটে অবস্থা!
জুন ১৯৫৬। দাবার ঘুঁটি উল্টে গেলো। সোভিয়েত ইউনিয়ন মাত্র ২% সুদে ১.১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ প্রস্তাব করলো মিশরকে। জুলাই ১৯, ১৯৫৬ যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ঘোষণা এলো, বর্তমান প্রেক্ষাপটে নীলনদের উপর উচ্চ বাঁধ নির্মাণ আর্থিকভাবে লাভজনক নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র অর্থায়ন থেকে বিরত থাকছে। যদিও এই ঘোষণায় বাঁধ নির্মাণে কিছু যায় আসেনি।
জুলাই ২৬, ১৯৫৬। নাসের আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেন। বেসরকারি মালিকানাধীন সুয়েজ খালকে রাষ্ট্রীয়করণ করেন। ঘোষণা দেন, এ খালের আয় থেকে বাঁধ নির্মাণে অর্থ সহায়তা দেয়া হবে। অক্টোবরের শেষে সুয়েজ যুদ্ধ শুরু হলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং ইসরাইল সুয়েজ খাল এবং সিনাই পার্বত্য উপত্যকা দখল করে। কিন্তু জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মজার ব্যাপার হলো, দখলদারিত্বের ইতিহাসে জায়গা দখলমুক্ত করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র একযোগে মিশরকে সমর্থন করেছিলো। তাও আবার সুয়েজ খালের মতো সোনার ডিম পাড়া হাঁসের জন্য!
১৯৫৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সুস্পষ্ট ঘোষণা দিলো নীলনদের উপর আসওয়ান বাঁধ নির্মাণের। যার অফিসিয়াল নাম হলো আসওয়ান হাই ড্যাম। এই হাই ড্যাম বা উচ্চ বাঁধ নাম হওয়ার পিছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। নীল নদের উপর এটিই একমাত্র বাঁধ নয়। একাদশ শতাব্দীতে প্রকৌশলী আল-হেতাম সরেজমিনে যে জরিপ শুরু করেছিলেন, তা আর থেমে থাকেনি। বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নিয়েছে শাসক গোষ্ঠী। তবে সফল হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ব্রিটিশ প্রকৌশলীরা। ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার উইলিয়াম উইলককস আসওয়ান লো ড্যাম ডিজাইন করেন। তাঁর সহযোগী ছিলেন প্রকৌশলী স্যার বেঞ্জামিন বেকার এবং প্রকৌশলী স্যার জন এয়ার্ড। আসওয়ান লো ড্যাম নির্মাণে কন্ট্রাক্টর ছিলো স্যার জন এয়ার্ড মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান জন এয়ার্ড এবং কোং।
মিশরের নীল নদের উপর প্রথম বাঁধ ছিলো আসওয়ান লো ড্যাম। নাম শুনেই বোঝা যায় এটির উচ্চতা কম। নদীর তলা থেকে মাত্র ২২ মিটার বা প্রায় ৭২ ফুট। ইটের তৈরী গ্র্যাভিটি বাট্র্রেস প্রযুক্তির বাঁধ। নির্মাণ কাজ চলছিলো হয়েছিলো ১৮৯৮ থেকে ১৯০২ সাল পর্যন্ত। কাগজে ৪ বছর মনে হলেও আসলে ৩ বছরে নির্মাণ শেষ করে। কেনোনা মাঠের নির্মাণ শুরু হয় ১৮৯৯ সালে। পিরামিড নির্মাতাদের একটা বাঁধ নির্মাণে বেশী সময় লাগার কথা নয়। সে সম্মানটুকু তাঁরা বজায় রেখেছে।
লো ড্যাম উচ্চ করার জন্য দুইবার উদ্যোগ নেয়া হয়। ১৯০৭ — ১৯১২ সালে উচ্চতা বাড়ানো হয় ৫ মিটার বা প্রায় ১৬ ফুট। ১৯২৯ — ১৯৩৩ সালে বাড়ানো হয় আরো ৯ মিটার বা প্রায় ৩০ ফুট। এতে রিভারবেড থেকে বাঁধের উচ্চতা ৩৬ মিটার বা ১১৮ ফুট হলেও ১৯৪৬ নীল নদের ভয়াবহ বন্যায় প্রায় জল উপচে বাইরে গড়ানোর অবস্থা তৈরী হয়। সেসময়েই সরকারের কাছে স্বতন্ত্র হাই ড্যামের জরুরী প্রয়োজন পড়ে।
তবে এ সময়কালে রাজতান্ত্রিক সরকারের কাছে জনগণের প্রাধান্য কমে আসছিলো। জনগণের স্বপ্ন পূরণে আরেকটি বাঁধ নির্মাণের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি বাদশাহ ফারুক সরকারের। মিশর ও সুদান সাম্রাজ্যের তৎকালীন মালিক মোহাম্মদ আলী ডাইনেস্টির শেষ সম্রাট বাদশাহ ফারুক।
গ্রীস—মিশর বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী অ্যাড্রিয়ান ডেনিনোস নীল নদে বাঁধ নির্মানের পরিকল্পনা ও গবেষণা করে রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন বাদশাহ ফারুকের কাছে। সেটি ১৯৫২ সালে ঠিক বিপ্লবপূর্ব মুহূর্তে। এটি ছিলো মিশর কেন্দ্রিক অর্থাৎ মিশরের স্বার্থ বিবেচনা করে। বাদশাহর তা পছন্দ হয়নি। তিনি বরং পছন্দ করলেন ব্রিটিশ প্রকৌশলী হ্যারল্ড এডউইন হার্স্টের দেয়া আরেকটি রিপোর্ট। যেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে বাঁধ হবে এমন জায়গায় যেখানে রিজার্ভার থাকবে ইথিওপিয়া এবং সুদানে। প্রকৌশলী হার্স্ট তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং থিওরিতে ঠিক ছিলেন। কেননা মিশরের তুলনায় ইথিওপিয়া এবং সুদানে এভাপরেশন রেট (জল বাষ্পীয় করণের হার) কম। তবে তাঁর রাজনৈতিক থিওরী ঠিক ছিলোনা। মিশরের মানুষকে বঞ্চিত হতে হতো।
১৯৫২ সালের এক সামরিক ও রাজনৈতিক যৌথ অভ্যুত্থানে বাদশাহ ফারুকের পতন ঘটে। বিপ্লবী সরকারের দুই কর্ণধার মেজর জেনারেল নাগিব এবং জননেতা গামাল আব্দেল নাসের সবচে’ বেশী গুরুত্ত্ব দেন বন্যা নিয়ন্ত্রন, কৃষি ও সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন এবং বিদ্যুত উৎপাদন। এর লক্ষ্য ছিলো ইউরোপের রেঁনেসার আদলে মিশরে শিল্প বিপ্লব ঘটানো। এরই ধারবাহিকতায় আসওয়ান লো ড্যামের ৬ কিলোমিটার উজানে ১৯৫৮ সাল নাগাদ সোভিয়েত সহায়তায় বাঁধের প্রকৌশল পরিকল্পনা ও নকশা তৈরীর কাজ শুরু হয়।
নকশা তৈরী করেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিখ্যাত হাইড্রোপ্রজেক্ট ইনস্টিটিউট এর প্রকৌশলীরা। তাঁদের সহায়তা করেন মিশরের স্থানীয় বহুসংখ্যক পুরকৌশল ও পানিসম্পদকৌশল প্রকৌশলী। চূড়ান্ত নকশা হাতে আসার পর কন্ট্রাকটর নির্মাণ কাজ শুরু করে ১৯৬০ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি প্রোজেক্ট টেকনিশিয়ান এবং হেভী ইক্যুইপমেন্টসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে। মিশরের পক্ষ থেকে প্রধান কন্ট্র্যাক্টর হিসাবে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ত্ব পালন করে ‘ওসমান আহমেদ ওসমানস আরব কন্ট্র্যাক্টর।‘ প্রায় ২৫ হাজার মিশরীয় প্রকৌশলী এবং কারিগরী শ্রমিক এ নির্মাণ যজ্ঞে নিয়োজিত ছিলো।
১৯৬০ সালের কোনো এক শুভ সকালে গ্রাউন্ড ব্রেকিং হয়। তারিখটি ছিলো ৯ জানুয়ারী। বাঁধের মূল অংশ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৬৪ সালে। এরপর বাকী থাকে বাঁধের কারণে আটকে থাকা পানি সংরক্ষণের কাজ। সেই রিজার্ভার অংশ এবং বাঁধের ওয়াল ফিনিশিং কাজ শেষ হতে চলে যায় আরো ৬ বছর। ১৯৭০ সালের ২১ জুলাই বাঁধ চালু করার পর্যাপ্ত কাজ সম্পন্ন হয়। তবে বিদ্যুত উৎপাদনের টারবাইনগুলো পর্যায়ক্রমে কমিশনিং করা হয় ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত। রিজার্ভার পূর্ণ ধারণক্ষমতা অর্জন করে ১৯৭৬ সালে।
বাঁধ নির্মাণের কারণে কৃত্রিম যে রিজার্ভর তৈরী হয় তা বিশাল এক হ্রদের সমান। কাশ্পিয়ান হ্রদ বা সুপিরিয়র হ্রদের সমকক্ষ না হলেও জল ধারণের ক্ষমতা ১৩২ ঘন কিলোমিটার। ১০ কোটি ৭০ লক্ষ একর জমির উপর এক ফুট উচ্চতায় পানি রাখলে যতো পানি হবে, ততো পানি ধরে রাখতে পারে এই হ্রদ। মিশরীয়রা এর নাম দিয়েছে তাঁদেরষমহান নেতা গামাল আব্দেল নাসেরের নামে। ইংরেজিতে এই হ্রদের নাম নাসের লেক। গুগল ম্যাপে নাসের লেক লিখে সার্চ দিলে সরাসরি এর অবস্থান এবং আপেক্ষিক আয়তন দেখা যায়।
লেক নাসের অর্থাৎ আসওয়ান বাঁধের জল সংরক্ষণাগারের ক্ষেত্রফল (ভাষানুক্রমে আয়তন) ৫,২৫০ বর্গ কিলোমিটার। যা মালদ্বীপের আয়তনের সাড়ে ১৭ গুন। একদিকে এর সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ৫৫০ কিলোমিটার, অন্যদিকে সর্বোচ্চ প্রস্থ ৩৫ কিলোমিটার। পানির গভীরতা সর্বোচ্চ ঢলের সময় ১৩০ মিটার বা প্রায় ৪৩০ ফুট। সমূদ্রপৃষ্ঠ হতে স্বাভাবিক গড় উচ্চতা ১৮৩ মিটার বা প্রায় ৬০০ ফুট।
আসওয়ান বাঁধ প্রায় ৪ কিলোমিটার লম্বা। তবে চওড়া কতোখানি তা উপর থেকে বোঝার উপায় নেই। পানির তলায় এর প্রস্থ কিলোমিটারের কাছাকাছি। পাক্কা ৯৮০ মিটার। উপরের পুরুত্ব বোঝা যায়। অর্থাৎ বাঁধের উপর রাস্তার প্রশস্ততা ৪০ মিটার বা প্রায় ১৩০ ফুট। বাঁধটি উচ্চতায় ১১১ মিটার। ফুটের মাপে ৩৬৪ ফুট, যা প্রায় ৩৬ তলা ভবনের সমান উঁচু।
আসওয়ান বাঁধের মূল তিনটি উদ্দেশ্য ছিলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ এবং বিদ্যুত। বিশাল রিজার্ভার লেক নাসের অতিরিক্ত পানি ধারণ করায় মিশর বন্যা থেকে রক্ষা পায়। নীল নদের গতিপথ এবং এর সৃষ্ট বদ্বীপের অববাহিকায় ৩ লক্ষ ৩৬ হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি। যায় পুরো আয়তন বাংলাদেশের আয়তনের সোয়া দুইগুনের চেয়েও বেশি। এই ব্যাপক বিস্তৃত এলাকায় সেচ সরবরাহ চলছে আসওয়ান বাঁধের কল্যানে। যেখানে বছরে একটি ফসল ফলানো কঠিন ছিলো, সেখানে সব জমি গড়ে দুইটি করে ফসল ফলাচ্ছে। কৃষি পরিসংখ্যানের চুলচেরা গাণিতিক হিসাবে বছরে ১.৮ ফসল।
বিদ্যুত উৎপাদনেও সফল এই বাঁধ। ১৮০ টি স্লুইস গেট এই বাঁধে। গেট খুললেই বানের পানির মতো উচ্চগতিতে আপস্ট্রিম থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে ডাউনস্ট্রিমে। মোট ১২ টি টারবাইন বসানো আছে। একেকটির ধারণ ক্ষমতা ১৭৫ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে সংস্থাপিত অবস্থায় উৎপাদন ক্ষমতা ২১০০ মেগাওয়াট।
মিশর কাঙ্খিত তিনটি খাতের বাইরেও নৌপথ, পর্যটন এবং কর্মসংস্থান খাতে সাফল্য পায়। তবে বাঁধ নির্মাণের চিরন্তন ক্ষতিকর বিষয়গুলি এড়াতে পারেনি। মানব সভ্যতার কাছে সৃষ্টিকর্তার বিরাট এক উপহার নদী। প্রকৃতির সুন্দরতম দৃশ্য নদী। নদীর নিজস্ব একটি ধারা রয়েছে যা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। এ গতিধারার বিরুদ্ধে নদীর জল আটকে মানুষ বাঁধ নির্মাণ করে। প্রকৃতি তখন নিজে থেকে খানিকটা প্রতিশোধ নেয়। আসওয়ান বাঁধের বেলাতেও এটি প্রযোজ্য হয়েছে। বাঁধের প্রভাবে মিশরের কিছু এলাকা এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় প্রায়শই বন্যা হয়। বাঁধ নির্মাণের পর খোদ মিশরেই অনেক এলাকা ডুবে যায়। প্রায় ১ লক্ষ মানুষকে স্থানান্তর করে অন্যস্থানে পুনর্বাসন করা হয়।
অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন চিরকালে বিলীন হয়ে যায় প্লাবিত জলের গর্ভে। ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী এলাকায় নতুন করে ভূমিধ্বশ হয়। ভূমির লবনাক্ততা বাড়ে। ভূগর্ভস্থ জলের লবনাক্তায় জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব দেখা যায়। নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। বাঁধ নির্মানে তাৎক্ষণিক সাফল্য ভবিষ্যতে অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশল গবেষণা হয়তো নির্মাণ পরবর্তী ক্ষতি কমাতে সাহায্য করতে পারে। তবে সকল গবেষণা হতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে যা প্রায় অসম্ভব। কেনোনা সবদেশেই বাঁধ নির্মাণের মূল পরিকল্পনা প্রণীত হয় রাজনীতিবিদদের মস্তিষ্কে। প্রকৌশলীরা কেবল তা বাস্তবায়ন করেন।

- Advertisement -

ব্রামটন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent