রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

কানাডার রিমেম্ব্রেন্স ডে-র পপিফুল-ব্যাজ-এর বাংলাদেশ যাত্রা


কানাডায় এসেছি ২০০২ এর আটাশে মার্চ।
কানাডায় আমার প্রথম বিস্ময় ছিলো আকাশ থেকে ঝরে পড়া ফুলের পাপড়ির মতো হালকা হালকা বরফের ফুল দর্শন। বরফের ফুলগুলো উড়ে উড়ে এসে আলতো করে বসে পড়ছিলো আমার হাতের ওপর, মাথার ঝাঁকড়া চুলের ওপর, গায়ের লম্বা ওভারকোটের ওপর।
কানাডায় আমার প্রথম ভালো লাগা ছিলো টিউলিপ ফেস্টিভালে হাজার হাজার টিউলিপ ফুল দর্শন, একই বছর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এর আগে টিউলিপ ফুল আমি দেখেছিলাম অমিতাভ-রেখার সিলসিলা সিনেমার কল্যাণে। নেদারল্যাণ্ডস-এর সারি সারি অপরুপ টিউলিপ ফুলের বাগানে চিত্রায়িত অমিতাভ-রেখার গান ‘দেখা এক খাব তু ইয়ে সিলসিলে হুয়ে’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিয়াম। সেই টিউলিপ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ হলো কানাডায় এসে। কানাডায় প্রতি বছর মে মাসে টিউলিপ ফেস্টিভাল হয়।….
…..কানাডায় আমার প্রথম প্রাণিত হবার বিষয়টি ছিলো সে বছর ১১ নভেম্বর রিমেম্ব্রেন্স ডে-র আনুষ্ঠানিকতার একটি দৃশ্যমান অনুষঙ্গ–টকটকে লালরঙা পপিফুলের ব্যাজ। রিমেম্বারেন্স ডে উপলক্ষ্যে কানাডিয়ানরা এই ব্যাজটি বক্ষে ধারণ করে নভেম্বরের ০১ তারিখ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত।
গতকাল ছিলো ১১ নভেম্বর। কানাডা এই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদায় পালন করে। এই দিনটি কানাডায় পালিত হয় ‘শহিদ স্মরণ দিবস’ হিশেবে। কানাডায় এই দিবসটিরই নাম ‘রিমেম্ব্রেন্স ডে’। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কানাডার যে সমস্ত বীর (সৈনিক) রণাঙ্গণে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে ফেডারেল সরকার দিবসটিকে ছুটির দিন হিশেবে ঘোষণা দিয়েছে। সরকারী ভবনগুলোয় এই দিনে কানাডার পতাকা উত্তোলিত থাকে।এই দিনে অটোয়ার ডাউন টাউনে পার্লামেন্ট ভবনের বিপরীত সড়কে স্থাপিত বিশাল আকারের নান্দনিক ‘ওয়ার মেমোরিয়াল’ ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হয় কানাডিয়ানরা। এই ভাস্কর্যের সামনে এসে অবনত মস্তকে শহিদদের প্রতি রাষ্ট্রীয় ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। সেনাবাহিনীর একটি দল এসময় বিউগলে করুণ সুর বাজিয়ে তৈরি করেন শোকের আবহ। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে নিরবতা পালনের মাধ্যমে সমবেত জনতা স্মরণ করে তাঁদের বীর শহিদদের, যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত আজকের কানাডা। আমেরিকাও এই দিবসটি পালন করে তবে দিবসটি সেখানে পালিত হয় ‘ভ্যাটারান্স ডে’ হিশেবে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিক্ষণকে রিমেম্বারেন্স ডে হিশেবে উদযাপন করা হয়ে থাকে, কানাডায়। সময়টা ছিলো ১৯১৮ সালের একাদশতম মাসের একাদশ দিবসের সকাল ১১টা। ইংরেজিতে ওরা বলেন– on November 11th at 11am in 1918 (the eleventh hour of the eleventh day of the eleventh month)।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কানাডার একলক্ষেরও কিছু বেশিসংখ্যক সৈনিক(পদাতিক-নৌ ও বায়ু) জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। হিশেবটা এরকম–প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪-১৯১৮, শহিদ সংখ্যা ৬৬ হাজার ৬৫৫ জন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ১৯৩৯-১৯৪৫, শহিদ সংখ্যা ৪৪ হাজার ৮৯৩ জন।
এই হিশেবের সঙ্গে পরবর্তীতে যুক্ত করা হয় (Boer War 1899-1902) বোয়ের ওয়ার এবং কোরিয়ান ওয়ার(korean war 1950-1953)কেও। প্রথমটিতে নিহতের সংখ্যা ২৪৪ জন এবং দ্বিতীয়টিতে ৫১৬ জন। এরপর অতিসম্প্রতি শান্তিরক্ষাকালে (peace keepers) নিহত ১২২ জন, আফগানিস্তানে নিহত ১৫৮ জন সৈনিক এবং (isis) আইসিস লড়াইতে নিহত ০১ জন সৈনিককেও এই হিশেবের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে উদ্যোগী হয়েছেন কর্তৃপক্ষ। যদিও আফগানিস্তানে নিহতদের এই তালিকায় আনার ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত দ্বিমত রয়েছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে কানাডার কোনো যুদ্ধ সংগঠিত হয়নি। ওটা ছিলো এটাক বা আক্রমণ। আমেরিকার জবরদস্তিমূলক চাপপ্রয়োগের কারণে কানাডা আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আক্রমণ করতে গিয়েছিলো আফগানিস্তান। ওয়ার আর এটাক কখনো একই অর্থ বহন করে না। করতে পারে না। আমার এই মতের সঙ্গে মিল পেলাম এবার সিবিসি রেডিওর একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে একজন সৈনিকের ভাষ্যে। যাঁর দাদা অংশ নিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে, বাবা অংশ নিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এবং দাদা ও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি নিজেও বেছে নিয়েছেন সৈনিকের জীবন, তিনি বলছিলেন–‘আফগানিস্তানে নিহত কানাডিয়ান সৈনিকদের সঙ্গে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত কানাডিয়ান সৈনিকদের এক কাতারে ফেলাটা অন্যায়। দুটোকে এক করে দেখার কোনো মানে নেই।’
ওই সৈনিক আমার মনের কথাটিই বলেছেন। একদল লড়াই করেছে সভ্যতা ও বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও মুক্তির লক্ষ্যে, আরেকদল আক্রমণ করেছে আরেকটি দেশে গিয়ে, নিজের ক্ষমতার বিস্তার ঘটাতে। আমি স্মরণে আনতে পারি–আমেরিকা ইরাক আক্রমণে কানাডাকেও সঙ্গে যেতে চাপ প্রয়োগ করছিলো। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্রেচেন সংসদে সরাসরি সম্প্রচারিত বক্তৃতায় অত্যন্ত যৌক্তিক ও জোড়ালো ভাষায় বলেছিলেন–কানাডা ইরাক আক্রমণে অংশ নেবে না।
কানাডার এই দুঃসাহসকে বেয়াদবি হিশেবে গ্রহণ করেছিলো আমেরিকা। পরবর্তীতে কড়ায় গণ্ডায় এর খেসারত দিতে হয়েছিলো কানাডাকে। বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলো কানাডা, আমেরিকার শয়তানীতে। আমেরিকার ইশারায় কানাডার গোমাংসে ‘ম্যাড কাউ’ আবিস্কার করেছিলো বিশ্বখাদ্য সংস্থা। ফলে কানাডার বৃহৎ রফতানীপণ্য ‘বিফ’-এর রফতানী বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো।
সামারে পর্যটন মৌসুমে নায়েগ্রা ফলস্‌-এ মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ সার্স আবিস্কার করেছিলো ওরা। ফলে সে বছর নায়েগ্রা ছিলো পর্যটকহীন। দৈনিক পাঁচশ ডলারের ডাবল হোটেলরুমে আমি নিজেই থেকেছি মাত্র ৮০ ডলারে। বানোয়াট অভিযোগে আমেরিকার এই দুটি নোংরা আক্রমণে কানাডার অর্থনীতি হয়ে পড়েছিলো মহাবিপদগ্রস্ত। অনেকেই তখন ক্রেচেনকে দুষেছেন। আমেরিকা সব সময় কানাডাকে তাদের অধীনস্ত বা বাধ্যগত ছোটভাই ভাবতে পছন্দ করে।
রিমেম্ব্রেন্স ডে বিষয়ে ফিরে আসি।
যুদ্ধে আত্মদানকারী শহিদদের স্মরণ করতে রক্তলাল পপিফুলের ব্যাজটি বুকে(পোশাকে)ধারণ করার এই আইডিয়াটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছিলো। আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো–এই ঘটনাটি বাংলাদেশেও ঘটতে পারে। আমরা আমাদের তিরিশ লক্ষ শহিদের স্মরণে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ০১ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর এবং ০১ মার্চ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত লাল সবুজের একটা ব্যাজ ব্যবহার করতে পারি।
বাংলাদেশে এই বিষয়টির প্রচলনের ক্ষেত্রে দু’জন মানুষের নাম আমার মনে এলো। একজন সাগর ভাই অন্যজন বাচ্চু ভাই। চ্যানেল আই-এর ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। সাগর ভাই ও বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে টেলিফোনে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলাম। তাঁরা আগ্রহ দেখালেন। আমি নমুনা হিশেবে এক ডজন পপিফুলের ব্যাজ কিনে ডাকযোগে পাঠিয়ে দিলাম বাংলাদেশে।
অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ থেকে অটোয়াসহ কানাডার ব্যস্ত শপিংমলগুলোয় একটি টেবিল পেতে অনেকগুলো পপিফুলের ব্যাজ নিয়ে বসে থাকেন অশীতিপর বৃদ্ধ অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরা। তাঁদের পরনে থাকে সেনাবাহিনীর স্যুভেনির পোশাক ও ক্যাপ। ছোট্ট বাক্সে কিছু পয়সা রেখে ব্যাজগুলো সংগ্রহ করা যায়। কেউ এক ডলার কেউ পাঁচ ডলার কেউবা কিছু ভাংতি কয়েন দিয়েও ব্যাজ সংগ্রহ করে। প্রথমদিন আমি দুটো ব্যাজ কিনেছিলাম আমার আর শার্লির জন্যে। পরদিন ওই বুড়োকে গিয়ে যখন বললাম আমি আরো এক ডজন কিনতে চাই বুড়ো তখন খুবই অবাক–কালই না কিনলে! এক ডজন নিয়ে কী করবে? কাউকে দেবে?
আমি সেই ঝলমলে বুড়োকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার গল্পটা বললাম। আমাদের তিরিশ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগের কথা বললাম। বৃদ্ধ সেনাসদস্যের চোখ খুশিতে চকচক করে উঠলো যখন তিনি শুনলেন আমি এগুলো বাংলাদেশে পাঠাবো এবং আগামীতে এর আদলে আমরাও শহিদ স্মরণে ব্যবহার করবো একটা লালসবুজ ব্যাজ, তখন সেই সৈনিকের চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। বুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গ করমর্দন করলেন। তারপর বললেন–এক ডজন কেনো, তোমার যতো খুশি নাও। আমি দশ ডলারের একটা নোট বক্সে ঢুকিয়ে এক ডজন ব্যাজ কিনে নিলাম।
বাংলাদেশে পাঠাতে গিয়ে আমি ছোট্ট একটা ভুল করে বসলাম। চিঠিটা সাগর ভাইয়ের ঠিকানায় না পাঠিয়ে পাঠালাম বাচ্চু ভাইয়ের ঠিকানায়। কী কারণে জানি মনে হলো–চ্যানেল আই একটা জনপ্রিয় বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। প্রতিদিন চ্যানেল আইয়ের ঠিকানায় গাদা গাদা চিঠি আসে। অনেক চিঠির ভিড়ে আমার চিঠিটা না আবার হাত ছাড়া হয়েযায় সাগর ভাইয়ের। তারচে বাচ্চু ভাইয়ের বাড়ির ঠিকানায় পাঠানোই ভালো। ওটা তাঁর হাতে পৌঁছুবেই। ফোনে বাচ্চু ভাইয়ের পুরানা পল্টনের বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে একটা খামে পত্রিকার কিছু কাটিংস, এক ডজন ব্যাজ এবং বাচ্চু ভাই ও সাগর ভাইকে লেখা একটা যৌথ চিঠি ‘জরুরি ডাক’ হিশেবে পাঠিয়ে দিলাম বাংলাদেশে। সপ্তাহ দুয়েক পরে ফোন করলাম বাচ্চু ভাইকে। তিনি জানালেন, এখনও পাইনি। মাস দুয়েক পর তিনি কানাডার সেইন্ট ক্যাথেরিনে দিনু বিল্লাহর বাড়িতে বেড়াতে এলেন। আমি মহা উচ্ছ্বাসে সঙ্গে ফোন করলাম দিনু বিল্লাহর ফোনে। কুশল বিনিময়ের পর বাচ্চু ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম আমার পাঠানো চিঠির প্রসঙ্গে। এবং এ বিষয়ে তিনি কী পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটাও জানতে চাইলাম। প্রথমে বাচ্চু ভাই আমার চিঠির প্রসঙ্গটি মনেই করতে পারলেন না। তারপর আমার নানান সূত্রের অবতারণার ফলে তাঁর স্মৃতি কাজ করলো–হ্যাঁ পেয়েছিলাম মনে হয় তোর চিঠিটা। তুই এক কাজ কর, আবার পাঠা। আমি মনে হয় ওটা হারিয়ে ফেলেছি।
আমি বললাম, জ্বিনা, আপনাকে আর পাঠাচ্ছি না। তবে কাজটি আমি করবো। এবং সেটা সাগর ভাইয়ের সহায়তা নিয়ে।
বাচ্চু ভাইয়ের কথায় আমার বুঝতে অসুবিধে হলো না যে তিনি ব্যাপারটাকে গুরুত্বই দেননি। অথচ আমি মনে করেছিলাম এটা তাঁর কাছে অনেক গুরুত্ব পাবে!
বাচ্চু ভাইয়ের কাছে গুরুত্ব না পাওয়া আমার সেই চিঠির একটা ফটোকপি সেদিন খুঁজে পেলাম।
কী লিখেছিলাম সেই চিঠিতে–সেটায় একটু চোখ বোলানো যাক। লিখেছিলাম–
[ ”জনাব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ এবং জনাব ফরিদুর রেজা সাগর
প্রিয় বাচ্চু ভাই/সাগর ভাই
শুভেচ্ছা। টেলিফোনে কথা বলে সেদিন কী যে ভালো লেগেছে! কতোদিন আপনাকে, আপনাদের দেখি না! কবে দেখা হবে?
প্রতি বছর ১১ নভেম্বর শহিদদের স্মরণে কানাডা ‘রিমেম্ব্রেন্সডে’ পালন করে। নভেম্বরের ০১ তারিখ থেকে কানাডার লেখক-শিল্পী-সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মী–এক কথায় সব শ্রেণীর সচেতন নাগরিকরা শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লাল রঙের একটি বিশেষ স্মারকচিহ্ন বা ব্যাজ ব্যবহার করে। কানাডার সবক’টা টিভি চ্যানেলের সকল এনাউন্সার উপস্থাপক নিউজ কাস্টার এবং টক শো-তে অংশগ্রহণকারীরাও কানাডার পপি ফুলের আদলে গড়া লাল রঙা ব্যাজটি ব্যবহার করে। এমনকি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার লোগোর পাশেও ছাপা হয় স্মারকচিহ্নটি। এই চিহ্নটি তাঁরা বুকে(পোশাকে) ধারণ করেই যাবতীয় পারিবারিক এবং অফিসিয়াল কর্মকাণ্ডে শরীক হয়। আমি মনে করি বাংলাদেশেও এমনটি হওয়া উচিৎ। আপনাদের অসাধারণ সাঙ্গগঠনিক দক্ষতা এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার যুগোপযোগী সাপোর্টে বাংলাদেশে এই অভ্যাসটি চালু হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনা শুধু হৃদয়ে নয়, শরীরেও ধারণ করা জরুরি। কানাডায় দুটি ব্যাজ এক ডলারে বিক্রি হয়। নমুনা হিশেবে কয়েকটি পাঠালাম আপনাদের জন্যে। ক্যানাডিয়ানরা লালের কালো কিংবা সবুজ ব্যবহার করে। এই জিনিসটিই আমরা আমাদের পতাকার সঙ্গে রিলেটেড করে সবুজের মধ্যে লাল ব্যাবহার করতে পারি। আদলটি হুবহু না করে সামান্য পাল্টাতেও পারেন। শ্রদ্ধেয় শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী, হাশেম খান কিংবা রফিকুন নবীর পরামর্শ নিলে সবচে ভালো হয়।
আপনাদের দুজনার যৌথ উদ্যোগে স্মারকটির কয়েকলাখ কপি তৈরি হতে খুব একটা সময় লাগার কথা নয়। টোকেন মূল্য হিশেবে একটাকার বিনিময়ে জনসাধারণের কাছে বিতরণ করা যায়। অবশ্য প্রথম প্রথম বিনে পয়সাতেই দিতে হবে।
সাংস্কৃতিক জোটের চারদিনব্যাপি অনুষ্ঠানমালায়(ঢাকার বাইরেও) এবং চ্যানেল আই-তে পরিকল্পনাটির প্রাথমিক বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় রইলাম। আপনারা উদ্যোগ নিলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
ভালো থাকুন। সুন্দর থাকুন।
শুভকামনাসহ
লুৎফর রহমান রিটন ১৪ নভেম্বর ২০০৩, অটোয়া” ]
চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে ২০০২ থেকে ২০০৭ এর অক্টোবর পর্যন্ত আমি ছিলাম ‘বাংলাদেশের পাসপোর্ট বিহীন’। কানাডার বাংলাদেশ দূতাবাসকে বহুবার অনুরোধ করেও নাগরিক অধিকার হিশেবে আমি আমার প্রাপ্য একটি সবুজ পাসপোর্টটিপাচ্ছিলাম না। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পারমিশন না পাওয়ার অজুহাতে আমাকে পাসপোর্ট দেয়া হচ্ছিলো না। ২০০৭-এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলে বিশেষ ব্যবস্থায় কয়েক ঘন্টার নোটিশে দ্রুত একটি পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছিলো আমার নামে, অটোয়া হাইকমিশন থেকে। সে বছর নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি আমার প্রার্থিত সবুজ পাসপোর্টটি হাতে পেয়েই রওনা হয়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে! সাড়ে ছয় বছর পর আমি অবশেষে আমি বাংলাদেশে নিজের দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে যাবার সৌভাগ্য অর্জন করলাম।
বাংলাদেশে যাবার সময় রক্তিম ব্যাজটির কয়েকটি নমুনা সঙ্গে নিতে ভুলিনি।
সিদ্ধেশ্বরীতে চ্যানেল আইয়ের কার্যালয়ে সাগর ভাইকে সেই ব্যাজটি দেখালাম। আমার পরিকল্পনাটি পছন্দ করলেন সাগর ভাই। একটি অনুষ্ঠানের সূত্রে সেদিন শিল্পী হাশেম খানও উপস্থিত ছিলেন তখন চ্যানেল আইতে। সাগর ভাইয়ের কক্ষে আমি আর হাশেম ভাই দীর্ঘক্ষণ এটা নিয়ে আলোচনা করলাম। হাশেম ভাই শাদা কাগজে কয়েকটা স্কেচ করে দেখালেন কী রকম হতে পারে পরিকল্পিত ব্যাজটির আকার ও আকৃতি। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো–হ্যাঁ চ্যানেল আইতে ডিসেম্বর এবং মার্চে ঘোষক-উপস্থাপক-সংবাদ পাঠক-আলোচক ও অতিথিদের বুকে এই ব্যাজ পরিয়ে দেয়া হবে।
অতঃপর সাগর ভাইয়ের নির্দেশ ও তরিৎ পদক্ষেপে চ্যানেল আইয়ের শিল্প নির্দেশক ও সেট ডিজাইনার চারুর কর্মতৎপরতায় একদিন পরেই আমাদের হাতে চলে এলো অনেকগুলো লালসবুজ ব্যাজ। ০১ ডিসেম্বর ২০০৭ থেকে বাংলাদেশের টিভি দর্শকরা নতুন একটি অনুষঙ্গ যুক্ত হতে দেখলেন চ্যানেল আইয়ের পর্দার কুশীলবদের বুকে। আর সেটি হচ্ছে লালসবুজ একটি ব্যাজ, আমাদের পতাকার রঙে ও আংশিক আদলে নির্মিত। টিভি পর্দায় অনেক নতুন কিছুর প্রথম সংযোজনের কৃতিত্বের ইতিহাস রয়েছে চ্যানেল আইয়ের। সেই ধারাবাহিকতায় এটিও একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
দর্শকরা লক্ষ্য করবেন, মার্চের০১ থেকে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস এবং ডিসেম্বরের ০১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পর্যন্ত সময়কালে চ্যানেল আইয়ের ঘোষক-উপস্থাপক-সংবাদ পাঠকসহ টকশোগুলোয় অংশগ্রহণকারী সবার বুকেই কানাডার পপিফুলের আদলে নির্মিত একটা সুদৃশ্য লাল সবুজ ব্যাজ দৃশ্যমান থাকে।
আমার স্বপ্ন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অমর শহিদদের স্মরণে অন্যান্য চ্যানেলগুলোতেও উদ্যোগটির প্রতিফলন ঘটবে একদিন। বিজয় ও স্বাধীনতার মাসে আমাদের দেশের সকল শ্রেণিপেশার সকল নাগরিকও একদিন তাঁদের বুকে(পোশাকে) লালসবুজকে প্রতিফলিত করবেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনা শুধু হৃদয়ে নয়, শরীরেও ধারণ করা জরুরি।
কিছু কিছু প্রেম শুধু অনুভবের নয়, কিছু কিছু প্রেমের দৃশ্যমানতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিছু কিছু ভালোবাসাকে অন্তরে ধারণ করে শুধু উচ্চারণ করলেই হয় না, সেই ভালোবাসার একটা দৃশ্যরূপও থাকতে হয়।

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent