রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

মানিক রতন শিল্পী এনামুল কবির


বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় গিটারে প্রথম তাঁর বাদন শুনি৷ সে অনেক অনেকদিন আগের কথা। মনে আছে সেই বাদন বহুদিন আমার কানে অনুরণিত হয়েছে। তারপর শুনলাম ট্রেনে। দেশাত্মবোধক গান অথবা রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে গিটার বাদন। এতো নিপুণ, এতো প্রাণস্পর্শী, এতো সুর সঙ্গতিপূর্ণ! যিনি বাজাচ্ছেন তিনি যে ওস্তাদ শিল্পী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এনামুল কবির তাঁর নাম। আরেকটা নাম আছে, বাবা রেখেছিলেন : মানিক। তিনি সত্যিকার অর্থেই আমাদের দেশের সঙ্গীতের জন্য মানিক রতন।
এনামুল কবির স্ত্রী ও পুত্র বিয়োগের শোক কাতরতা কাটাতে একমাত্র কন্যার আমন্ত্রণে কয়েকদিনের জন্য কানাডা বেড়াতে এসেছিলেন। আমি তাঁকে স্বাগত, শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাতে দেখা করতে গিয়েছিলাম তাঁর কন্যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের খ্যাতিমান শিল্পী নাহিদ কবির কাকলির বাসায়। রাত গভীর হয়ে গিয়েছিল। তখন তাঁর জন্য নিয়ে যাওয়া আমার হাতে ফুলের তোড়া দেখে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। খুশিতে শিশুর সারল্য তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল। আমাকে তিনি স্নেহসিক্ত বন্ধনে আলিঙ্গন করেছিলেন। তাঁর স্নেহের সেই মাধুর্য এখনো আমি অনুভব করি।
এনামুল কবিরকে চাক্ষুষ দেখার আগেই আমাদের পরস্পর কথা হয়েছিল। তাঁর উপস্থিতির স্বভাবগত একটি অবয়ব আমি কল্পনায় এঁকে রেখেছিলাম। যে মধুরিমার আবহে একটি পরিবেশ সহজ ও সংস্কৃতিলগ্ন হয়ে ওঠে, মধুময় হয়ে ওঠে, ব্যক্তি এনামুল কবির যেন সেরকম মানুষ হবেন; এই ছিল আমার কল্পনায় আঁকা ছবির মানুষ। বাস্তবে সেই মানুষকে দেখে, কাছে পেয়ে আমি যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম। ব্যক্তি আমি দূরবর্তী সূর্যের আলোর মতো চোখ ধাঁধানো আলোকিত মানুষ থেকে অন্তরের আলোয় দ্যুতিমান মানুষের কাছে যেতে স্বস্তিবোধ করি। খ্যাতির প্রাবল্যে জন কোলাহলে পূর্ণ কেউ নয়, বরং সাধনায় রত ধ্যানমগ্ন একাকীত্বের আড়ালের মানুষের কাছেই ছুটে গিয়েছি জীবনভর। এনামুল কবির শিল্পের শুদ্ধতার সাধনায় রত তেমনি একজন ধ্যানমগ্ন সাধক। অথচ তিনি পারিপার্শ্বিকতায় গভীরভাবে সচেতন। সচেতন তাঁর সময়ের সাথে। সংস্কৃতির সাথে। এমনকি সময়কে নিয়ন্ত্রণকারী রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে। যে অন্তঃসারশূন্যতার কুহকে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তার সর্বমানবিকতার আবাহনকে ভুলতে বসেছে, এনামুল কবির সেই আবাহনকে ফেরাতে সচেতনভাবে সচেষ্ট আছেন, তাঁর আয়ত্তের অধীন কাজগুলো সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে।
এতোকিছু মাথায় নিয়েও শিল্পী এনামুল কবির একজন জীবনবাদী মানুষ। একজন নিষ্ঠাবান ধার্মিক মানুষ। স্রষ্টার কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে নিবেদিতপ্রাণ মানুষ।
অথচ আশ্চর্যরকম সত্য যে, এনামুল কবিরের ভিতরে এক চিরদিনের শিশুর বসবাস৷ নিষ্পাপ শিশুর সারল্য তাঁর হৃদয়মন জুড়ে৷ সহজ ও সস্নেহ শ্রদ্ধার সম্পর্ক রক্ষায় তাঁর অসামান্য ভূমিকা আজকাল আর দেখা যায় না আমাদের এই যান্ত্রিক জীবনযাত্রায় প্রাত্যহিক যাপনে। তাঁর রসপূর্ণ মধুর স্বভাব যে কোন মানুষের কাছেই তিনি খুব দ্রুত নিজেকে মেলে ধরতে পারেন। স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন।
বাংলাদেশের দেশাত্মবোধক গানের স্বরলিপি রচনায় তাঁর অবদান অসামান্য। চিরায়ত বাংলা গান, রবীন্দ্রনাথের গান, বাংলাদেশের শিল্পীদের কণ্ঠে আধুনিক ও চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গানের সুরে গিটার বাদনে এনামুল কবির যে অবদান রেখেছেন, তার কদর বা মূল্যায়ন করবেন লক্ষকোটি শ্রোতা। কিন্তু রাষ্ট্রেরও দায় আছে এই মহৎপ্রাণ শিল্পীকে কালাতিপাত না করে সম্মান দেখানো, পদক দিয়ে ঋণ স্বীকার, স্বীকৃতি জানানো। শিল্পী এনামুল কবিরের একাশিতম জন্মদিনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কাছে এই আমার একান্ত আবেদন।
মানিক রতন শিল্পী এনামুল কবিরের জন্মদিনে আমার অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
শুভ জন্মদিন।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent