রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

বাঁচো আনন্দে

ছবিহিমেশ রিভেরা

রুশদী ও নাহিদ বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে ভালো বন্ধু,বন্ধুত্ব থেকে এক সময় তা ‘বিশেষ’ সম্পর্কে রুপ নেয় এবং লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করে এবং এরপর দুজনেই চাকরি সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
ঢাকা শহরে নিজেদের মত করে ছিমছাম সাজানো ফ্লাটে দুজনে চাকরির পাশাপাশি যতটুকু সময় পায় সুখ স্বপ্ন আর রঙ্গিন আগামির ছবি এঁকে চমৎকার সময় পার করে তারা। কখনো ব্যালকনিতে বসে চাঁদনী রাতে ভালোবাসার কথায় মেতে ওঠে,আবার কখনো বেসুরো গলাতেই কেউবা গেয়ে ওঠে আমরা দু’ জনা স্বর্গ খেলনা গড়িবো না ধরনীতে অথবা অন্যজন কবির ভাষায় বলে ওঠে তোমার আমার এই যে প্রনয় নিতান্তই এ সোজাসুজি!!
কল্পনা আর স্বপ্নে ভাসতে ভাসতে তারা সিদ্ধান্ত নেয় কানাডা আসবে। তাদের বন্ধু বান্ধব অনেকেই অষ্ট্র্বেলিয়া,কানাডা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলে গেছে কেউবা Immigration এর জন্য Apply করেছে। তাই **রু-না’র ইচ্ছে Immigrant হয়ে কানাডা আসার।
কানাডায় আসার জন্য IELTS সহ বিভিন্ন আনুসঙ্গিক কার্যাদি শেষ করে Apply করার প্রায় তিন বছর পর দুজনেরই Visa হয়ে যায়। স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নেয়ার আনন্দে আত্মহারা দুজনেই,কাঙ্খিত স্বপ্ন আল্লাহ পূরন করেছেন। আর সেই খুশীতে দুজন শুকরিয়া নামাজও আদায় করে।
রুশদীর এক মামা থাকেন British columbia province এর Vancouver এ,নিজের মামা না হলেও ছোট বেলা থেকে এত যাতায়াত তাই কোনভাবেই দুরের কেঊ মনে হয়নি। এই মামা হচ্ছেন রুশদীর খালার দেবর।যেহেতু নতুন দেশ নতুন পরিবেশে যাচ্ছে কাছের কেউ থাকলে তো ভালোই হয়। সেই মামাকে ফোন করে খুশীর খবর জানানো হয়,এবং এও জানানো হয় টিকেট কাটা হলে মামাকে জানানো হবে কবে কখন তারা কানাডা আসবে। মামা বলে কখন পৌঁছাবে সব যেনো বিস্তারিত জানিয়ে দেয় তাহলে নির্দিষ্ট সময়ে Airport থেকে তাদেরকে বাসায় নিয়ে আসবে।
**রু-না’র বাড়িতে খুশী আর আনন্দের জোয়ার। তারা দুজনেই বাবা মা আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে কানাডা আসার আগে কয়েকদিন কাটানোর জন্য ঢাকা থেকে বরিশাল যায়। বরিশাল সদরেই দুজনের বাড়ি,এক বাড়ি থেকে আরেকজনের বাড়ির দুরত্ব পায়ে হেঁটে গেলে ১০/১২ মিনিট। দুইজনের বাড়িতেই কয়েকদিন ধরে উৎসবের আমেজে নিজেদের বাড়ির লোকজন ছাড়াও পরিচিত আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে অনেক মজার সময় পার করে তারা ঢাকায় ফিরে আসে।
ঢাকায় ফিরে টিকেট করা,বিভিন্ন কেনা কাটা করা-বিশেষ করে শীতের দেশে প্রথম যাচ্ছে তাই বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে মোটা জ্যাকেট,সোয়েটার সহ জরুরী জিনিষ পত্র কিনে নেয়। আবার যেহেতু মামার বাসায় উঠবে তাই মামা,মামী,মামাতো দুই ভাইয়ের জন্যও এটা সেটা কেনে। বিদেশ বিভূঁইয়ে কাছের লোক থাকা যে কত ভালো তা ভেবে দুজনেই খুব নিশ্চিন্ত। নির্দিষ্ট দিনে দুজনের বাবা মা সহ রুশদীর ভাইবোন এয়ারপোর্টে ওদেরকে বিদায় দিতে আসে এবং এক আবেগ ঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয় ওদেরকে প্লেনে তুলে দিতে এসে।
**রু-না যে সময়টা Immigration cross করে প্লেনের ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে সে সময় ওদের সঙ্গে দেখা হয় আর এক Batch mate দম্পত্তি-আশফাক ও রীতার। বেশ অনেকদিন যোগাযোগ ছিলোনা। পুরনো অনেক স্মৃতিচারন,গল্পের মাঝে জানা গেলো কানাডা একই শহরে ওরাও যাচ্ছে।
আশফাক জানালো যেহেতু তাদের পরিচিত তেমন কেউ নাই, পাড়ার এক বড় ভাই-শফিক নাম পরিবার নিয়ে Vancover এ থাকেন সেখানেই উঠবে। রুশদীও মামার কথা বলে। গল্প করতে করতেই প্লেনে ওঠার সময় হয়ে যায়।
দীর্ঘ প্লেন যাত্রা শেষে মধ্য রাত্রে সবাই যখন Vancouver airport এ পৌঁছায় তখন ভীষন ক্লান্ত। Immigration এর ঝামেলা শেষে Luggage নিয়ে চার জনই নতুন দেশে পৌঁছানোর একটা অন্য রকম অনুভূতি ও উত্তেজনা নিয়ে সামনে এগোতে থাকে এবং দেখে বেশ কয়েকজনের মাঝে Welcome to Canada লেখা বেলুন আর ফুলের তোড়া নিয়ে আশফাকের পাড়ার সেই বড় ভাই শফিক হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাদের দিকে তাঁকিয়ে আছে। আশফাক বড় ভাইকে জড়িয়ে কুশল বিনিময় করার পর একে একে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং রুশদীর কাছে শফিক জানতে পারে তার মামা তাকে নিতে আসবে।
**রু-না খুঁজতে থাকে মামাকে।প্রায় ২০/২৫ মিনিট পার হয়ে গেলে মামার দেখা না পেয়ে শফিকের ফোন থেকে মামার নম্বরে ফোন দেয়,কিন্তু কেউ ই ফোন ধরে না। মামার নাম শুনে শফিক চিনতে পারলো না,বললো এখন তো অনেক বাঙ্গালী তাই হয়তো। তবে রুশদীদের অসহায়,অপ্রস্তুত এবং ইতস্তত ভাব দেখে শফিক বলে যতক্ষন আপনার মামা না আসছে আমরা অপেক্ষা করবো।মনে করেন আমি আপনার বড় ভাই।
অপেক্ষায় থাকতে থাকতে প্রায় দেড় দুই ঘন্টা পেরিয়ে যায় এবং মামা বা কাউকে না পেয়ে শফিক বলে যদি কিছু মনে না করেন সবাই আমার ওখানে চলেন,হয়তো আপনার মামা কোন ঝামেলায় পড়েছে আর যদিও রুশদী আপনার কাছে ঠিকানা আছে কিন্তু এখন প্রায় রাত তিনটার মত বাজে এত রাত্রে যাওয়া ঠিক হবে না। তার থেকে কালকে ঘুম থেকে উঠে যোগাযোগ করা যাবে আর আমি যেহেতু আশফাকদের আসা উপলক্ষ্যে দুদিন ছুটি নিয়েছি,তেমন হলে পৌঁছে দিয়ে আসবো।
অত রাত্রে শফিকের বাসায় পৌঁছে শফিক আর শফিকের বৌয়ের আতিথেয়তা আর তদারকীতে মুগ্ধ হয়ে যায় সবাই। কিন্তু **রু-না’র মধ্যে এক ধরনের খারাপ লাগা নিয়েই ঘুমাতে যায়।
পরের দিন অনেক বেলা করে সবার ঘুম ভাঙ্গে। নাস্তা সেরে চা খেতে খেতে শফিকের বৌ আর এক মাত্র মেয়ে রাহিবা’র সঙ্গে অনেক গল্প হয়।রাহিবা’র জন্ম কানাডায় হলেও খুব ভালো বাংলা বলতে পারে,বাংলা গানও শিখছে। শফিক মেয়েকে উচ্ছাস ভরা কন্ঠে সবাইকে একটা গান শোনাতে বলে।মেয়েটাও কী লক্ষ্মী সঙ্গে সঙ্গে গান গেয়ে শোনায়। **রু-না বুঝতে পারে খুব একটা আন্তরিক আর চমৎকার পরিবার শফিকের।স্বামী স্ত্রী দুজন এমন ব্যবহার করছে মনে হচ্ছে কত দিনের চেনা। নতুন দেশে এত বড় একটা বিপদের সময় পাশে দাঁড়ানোর জন্য শফিক সহ সব্বাইকে বারবার কৃতজ্ঞতা জানায় রুশদী।
আবারও কয়েকবার মামাকে ফোন করে কিন্তু আগের রাতের মতই কেউ ফোন ধরে না। রুশদী’র মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হালকা রসিকতার সুরে শফিক বলে এত অস্থির হচ্ছেন কেনো,আমাদেরকে ভালো লাগছে না!! এখানে থাকেন যে কয়দিন ইচ্ছা,আপনাদের পেয়ে কী যে ভালো লাগছে-ছোট বেলায় আব্বা আম্মাকে দেখেছি বাসায় মেহমান এলে কেমন খুশী হতো!
যা হোক বিকেলের দিকে নাহিদকে অন্য সবার সঙ্গে রেখে শফিক রুশদীকে সঙ্গে নিয়ে মামার দেয়া ঠিকানা Burnaby’র দিকে যায়।আশফাক রুশদীকে উদ্দেশ্য করে বলে,আমি আর বাসায় থেকে কি করি? আমিও তোদের সঙ্গে যাই।তিনজনই বেরিয়ে পড়ে। শফিকদের বাড়ি Richmond এলাকায় হলেও সেখান থেকে অতটা দুরের পথ না,Gps দেখাচ্ছে ৩৪ মিনিট। যা হোক গাড়িতে বিভিন্ন আলাপ এবং নতুন শহর দেখতে দেখতে মামার দেয়া ঠিকানায় পৌঁছে বাসার দরজায় Bell চাপার অনেকক্ষন পর এক চাইনিজ বয়স্ক পুরুষ দরজা খুলে দেয় এবং জানায় মামার যে নাম বলা হচ্ছে এ নামে কেউ এখানে থাকেনা।আশে পাশের কাউকে তারা এ নামে চেনে না,কথায় কথায় এও জানায় এখানে তারা প্রায় ২১ বছর ধরে আছে এবং মোটামুটি অনেককেই তারা চেনে।
কী অবস্থা রুশদীর তা সহজেই অনুমান করা যায়!!
রাগে দুঃখে অপমানে শফিকের বাসায় পৌঁছে রুশদী ওর মাকে ফোন দিয়ে সব ঘটনা বলে এবং তারপর ফোন দেয় খালাতো ভাই কে যার নিজের ছোট চাচা এবং রুশদী যাকে মামা বলে।কানাডা পৌঁছানোর বিস্তারিত সব শুনে খালাতো ভাই বলে-ভাইয়া ছোট চাচার কাউকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার সাহস নাই। দেশে যখন চাচা ছিলো শুধু চাচীর কারনেই আমাদের সঙ্গে তেমন যাতায়াত ছিলো না। চাচীর বাড়ির আত্মীয় স্বজন ছাড়া কাউকে চাচী পছন্দ করে না। চাচী দেশে থাকতে প্রায়ই বলতো আমি শ্বশুর বাড়ির লোকজন পছন্দ করি না। তোমার সঙ্গে যা হয়েছে আমরা জানতাম এমন কিছু হতে পারে,তারপরও ভেবেছিলাম এত বড় দেশে,এত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে হয়তো চাচীর কোন পরিবর্তন হয়েছে। আসলে কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা একটু অমানবিক,অবিবেচক আর স্বার্থপর টাইপের- এরা আছে বলেই কিছু কিছু ভালো মানুষের খোঁজ পাওয়া যায় যেমন তুমি শফিক ভাইয়ের দেখা পেয়েছো।

আসলে দেশের বাইরে কিংবা দেশে যেখানেই বলি না কেনো শফিকদের সংখ্যাই বেশী এবং হয়তো সে কারনে বিদেশ বিঁভূইয়েও সবাই মিলে মিশে আত্মীয় বন্ধু ভেবে সুন্দর আনন্দময় দিন যাপন করে। বিপদে আপদে সব সময়ই এক জনকে আরেক জনের পাশে পাওয়া যায়।দুই এক জন এরকম মামা সব জায়গাতেই আছে।একটা গান আছে না-বলো জীবন কি সুন্দর হতো এমন,যদি একটুও ব্যাথা নাহি থাকতো!!

- Advertisement -

**রু=রুশদী
**না= নাহিদ
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বন্ধুরা ওদের দুজনকে রুনা বলেই ডাকতো।

- Advertisement -

Read More

Recent