রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

যুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস

হারুন চুপচাপ বসে আছে অনেক উৎসাহ আর অনেক ভালোলাগা যুদ্ধের জন্য কিন্তু ওর কিছুই ভালো লাগছে না। নিজের জীবন সে অকাতরে দেশের জন্য উজাড় করে দিতে পারে। কিন্তু পলাশ, ওর প্রিয় বন্ধু, ওর একমাত্র বন্ধু, ওর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। এভাবে চলে গেল ওর পাশ থেকে। কিছুতেই মানতে পারছে না হারুন। একমুহূর্ত আগেও গুলি চালাতে চালাতে হাসছিল পলাশ। সেই হাসি চোখ থেকে সরাতে পারে না হারুন আর ওর কথা। স্বাধীন দেশের সেই স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ জীবনের সেই ছবি বারবার আনমনা করে দিচ্ছে হারুনকে। পলাশের ইচ্ছা ছিল যুদ্ধ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে পাস করে। পরবর্তী প্রজন্মকে জানাবে যুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আলোকিত করবে শিক্ষার্থীর প্রাণ, আদরে ভালোবাসায় দরদে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করবে প্রজন্ম। ভীষণ মেধাবী ছাত্র পলাশ জীবনে কখনও দ্বিতীয় হয়নি কোনো পরীক্ষায়। অনার্স হয়ে গেছে। এমএ পরীক্ষার আর মাস দুই বাকি ছিল। এরমাঝে লেগে গেল এই যুদ্ধ। হলের সেই ভয়াল কালরাতের বিভীষিকা এখনও তাড়িত করে হারুনকে। শত মৃত্যুর স্তুপে নিজেকে জীবন্ত পেয়ে নতুন জীবন পাওয়ার আনন্দ হয়েছিল। সারারাত আর পরের একটা দিন পুকুরের জলে কোনোমতে নাক ভাসিয়ে কাটিয়েছিল। চারপাশে মিলিটারির আনাগোনার মাঝে। জীবিত টের পেলে মেরে ফেলবে সেই ভয়ে থেমে ছিল যেন নিঃশ্বাসও। পরদিন রাতের অন্ধকারে অচেনা গলি ঘুরে ঘুরে পলাশদের ধানমন্ডির বাড়িতে পৌঁছে হারুন অচেতন হয়ে পড়েছিল বাগানে। তিনরাত অচেতন প্রায় কেটেছে একটা ঘরে। এরপর মানুষের ঝাঁকের সাথে, পলাশদের পরিবারের সাথে ওদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে এসেছে ঢাকা ছেড়ে। হারুন জীবনে কখনো মৃত মানুষ দেখেনি। কোরবানির গরু জবাই দেখেনি। অথচ এমন মানুষের লাশের মাঝে কাটিয়ে গা গুলিয়ে শুধুই বমি করছিল। কাছের বন্ধু পরিচিত ছেলেরা লাশ হয়ে পড়ে আছে। যাদের সাথে সারাদিন পড়ালেখা হাসি-তামাশা ভাব-বিনিময়ে কাটত, তারা সবাই নিথর তাদের বিকৃত দেহ পড়েছিল আশেপাশে রাতভর। মাথাটা ফাঁকা হয়ে যায় যতবার ভাবে। মনে হয় যেন সে বাতাস হয়ে গেছে, মানুষ নাই আর। সেই ভয়ানক রাতের স্মৃতি অস্বাভাবিক করে দেয় হারুনকে। খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। ভয়ে আতঙ্কে যেন সিঁটকে গেছে। চমকে উঠে চারপাশ দেখে ক্ষণে ক্ষণে। পলাশ অসম্ভব যতেœ আগলে রেখেছে হারুনকে। গ্রামের বাড়িতে এসে কিছুটা স্থিরতা পেয়ে ও ঠিক করে প্রতিশোধ নিবে এই হত্যাযজ্ঞের। শান্ত ধীর হারুন জেগে উঠে যেন এক নতুন আগুনে। নিজের মাঝে টের পায় বিশাল পরিবর্তন। ভিতরে কি যেন গজরায় থেকে থেকে। যেন প্রচণ্ড তুফানের আয়োজনে হাঁকে মেঘ গর্জন। পড়ালেখা কবিতা লেখায় সেই শান্ত ধীর দিন আর আরাম দেয় না, ফিরে আসে না ভালোলাগা। একরাতে উল্টে গেছে পৃথিবী হারুণের কাছে। বাবা মা বোন কেমন আছে সেই কুষ্টিয়ায় কে জানে। কীভাবে পৌঁছাবে সেখানে। চুপচাপ হারুণের মুখে কথার খৈ ফোটে। এতদিন আন্দোলন অস্থিরতার মাঝেও নিজের মাঝে বুঁদ হয়ে থাকা হারুন এখন মানুষের সাথে কথা বলে সারাক্ষণ। কে কি ভাবছে, কি হচ্ছে জানার চেষ্টা করে আর কিছুদিনের মাঝে জেনে যায় অনেক মানুষ ওর মতন ভাবছে, এই অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। তাদের একটা দলের সাথে ভিড়ে রওনা হয় হারুন ভারতের উদ্দেশে।
আগের রাতে পলাশকে বলে,
─ আমি কাল চলে যাব।
─ কোথায় যাবি এই যুদ্ধের মাঝে?
─ যুদ্ধ করতে
অবাক হয়ে খানিক তাকিয়ে থেকে পলাশ বলে,
─ আমিও যাব তোর সাথে।
─ কি বলিস তুই? তুই পারবি না।
─ তুই পারলে আমিও পারব।
─ তুই মা-বাবার একমাত্র সন্তান।
─ তুইও একমাত্র ছেলে।
─ আমার মা-বাবার কাছে আমি হারিয়ে গেছি এখন। ওরা জানে না আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি। আমিও জানি না ওদের খবর আর খবর নেবইবা কীভাবে এসময়ে? তার চেয়ে সহজ যুদ্ধে যাওয়া আর আমার কি মনে হয় জানিস পলাশ, আমি জীবন পেয়েছি এই দেশের জন্য নতুন করে। নয়তো আমার মরে যাওয়ারই কথা ছিল।
─ এত কিছু জানি না। তুই যাবি যুদ্ধে, আমিও যাব। জাফর, হাসান, আসিফ, মিলন, বিলু কেউ বেঁচে নাই, আমি ভাবতে পারি না, কেঁদে উঠে পলাশ হাউমাউ করে। আমার বন্ধুদের জীবনের কসম, আমি পাকিদের খেদাব এই দেশ থেকে। আমাদের দেশ বানাব বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ। আবেগে থরথর করে কাঁপে পলাশ। ওর গাল লাল হয়ে উঠে। বড়লোকের আদরের দুলাল এক গ্ল¬াস পানি ঢেলে খাওয়ার দরকার হয় না যার সে করবে যুদ্ধ। খেলাধুলার চেয়ে পড়ালেখায় যার আগ্রহ বেশি, কেমনে সে যুদ্ধের দামামা বাজাবে? হারুন ভাবে কিন্তু বন্ধুর আবেগে বাদ সাধে না। মনে মনে ঠিক করে ওকে লুকিয়ে চুপি চুপি রাতে চলে যাবে। আর খালাম্মাকে বলে রাখতে হবে পলাশকে আগলে রাখার কথা।

- Advertisement -

সবকিছুই ভাবনা মতন ঠিকঠাক করে হারুন। পলাশের মা-বাবার থেকে বাড়ি যাবার কথা বলে বিদায় নিয়ে রাখে সন্ধ্যাবেলা, গভীর রাতে রওনা হয়ে যাবে সে। পলাশের সাথে সারে যত জীবনের কথা। এ জীবনে আর কখনো দেখা হবে কিনা কে জানে? রাতে খেয়েদেয়ে শুতে যায় দু’জন। মাঝ রাতে বেরিয়ে পড়ে হারুন আগে থেকে ঠিক করে রাখা কয়েকজনের সাথে রওনা হওয়ার জন্য। নদীপাড়ের দিকে হাঁটে নিজেকে আড়াল করে অন্ধকারে তাড়াতাড়ি। নৌকায় পৌঁছে অবাক হয়ে দেখে পলাশ বসে আছে নৌকায় আগে থেকেই। আকবর ভাইকে বলে,
─ ওকে নিও না। পলাশ এসে বলে,
─ ভাবিস না হারুন, আমি বুঝেছিলাম তুই আমাকে ফেলে আসবি। তাই আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করেছি। মা-বাবাকেও বলে এসেছি। লুকিয়ে আসি নাই। আমারও দায়িত্ব আছে দেশের জন্য। শুধু তোর একার না। চলো আকবর ভাই দেরি করো না।
যেন নিজের হাতে নেতৃত্ব নিয়ে নেয় পলাশ হঠাৎ করে। সেই ভোর রাতে নতুন এক পলাশের দেখা মেলে। বই-খাতায় মুখ গুঁজা পলাশ না। লড়াকু সাহসী, তেজি অসম্ভব সম্ভাবনার এক যুবক। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে পলাশ। নৌকায় ভেসে যেতে যেতে পরবর্তী সব পরিকল্পনা করে ফেলে। যুদ্ধে অনেক নতুন কিছু প্রয়োজন হবে। কীভাবে কী হবে ওরা জানে না কিছু; কিন্তু পলাশ যেন জানে শুধু একবার পৌঁছানোর অপেক্ষা একটা বিন্দুতে, তাহলে সেখান থেকে একটা নতুন পথের চলা শুরু হয়ে যাবে। আর সে পথে কীভাবে চলবে যেন ওর ভিতর থেকে কেউ বলে দিচ্ছে ওকে।

১.
রঙিন সূর্যটাকে ছিনিয়ে আনব হাতের মুঠোয়
এই রক্তগঙ্গা নদী শ্রাবণ বরিষনে হবে শুদ্ধ
সবুজ মাঠের আঁচল পেতে গরম ভাত বাড়বে
সন্তানের সুখে মাস্বাধীন বাংলাদেশে।
২.
আঙিনায় ছড়ানো ধান খুটে খাবে শালিক চড়ুই
মুখর শিশুদের উচ্ছ¡াস খেলবে চারপাশে
অভাবে কাঁদবে না চারুলতা বা হৈমন্তী, সালেহা আলেয়া
আকর্ণ হাসি ছড়িয়ে থাকবে সারাক্ষণ স্বাধীন বাংলাদেশে।
৩.
আতসবাজির হুলে­ার-আনন্দ গ্রামবাংলার উৎসব
পিঠাপুলি সৌরভ সবুজ শ্যামল সুখের বসবাস
লাল শাপলার স্নিগ্ধতায় হাসবে কিশোরী
কাশফুল প্রান্তর রৌদ্রালোকে ভয়হীন স্বাধীন দেশে।

দ্রুম দ্রুম অজানা আওয়াজ কেড়ে নেয় ঘুম কেড়ে নেয় প্রাণ
দাউ দাউ আগুনে জ্বলে সাজানো সংসার
নির্মল নীল আকাশ ঢেকে দেয় ধোঁয়ার কুণ্ডলী
নিঃশ্বাসে বিষ অজানা ধাতব।

করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, পেশওয়ার পাঞ্জাবের
মরুময় জীবনে তোমরা কখনও করোনি স্নান
কাটনি সাঁতার আপন মনেঝিলাম বিপাশার সুশীতল জলে?
ভেজনি জোছনায় দোলনচাঁপার ঘ্রাণে ?
নির্দয় সীমার হৃদয় তাই কাঁপে না কারবালা প্রান্তরে
রুক্ষ মাটির প্রান্তর দেয়নি তোমাদের বোনের আদর
ভায়ের ভালোবাসা মায়ের সোহাগ?
রক্তাক্ত এই হাতে কেমনে ধরবে বধূর হাত?

আনমনে একে একে কবিতা লিখে যাচ্ছে নৌকায় বসে পলাশ। আগামী স্বাধীন দেশের স্বপ্ন ওর চোখজুড়ে। সুখের পটভূমি রচনা করছে আপনমনে ভয়ের আতঙ্কের এক সীমানায় বসে। যে কোনো সময় বিপদ আসতে পারে, কোনোদিক থেকে জানা নেই। এক মুহূর্তে ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারে নৌকায় লুকানো এতগুলো মানুষের। সে দিকে কোনো ভ্রƒক্ষেপ নাই পলাশের, ও আপন মনে এঁেক যাচ্ছে ওর পরিপাটি বাংলাদেশের ছবি।
হারুন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ও পলাশের মতন এমন ভাবতে পারে না। ওর গায়ে কাঁটা দিয়ে মনে হয় সেই অমানবিক সব মৃত্যু। সন্ধ্যাবেলায় কত উত্তেজনা কথা বিতর্কইয়াহিয়া, ভুট্টো, মুজিব নিয়ে। হলের ডাইনিংয়ে খেতে বসে। সৌরভের প্রেমের কাহিনী কোনোা। বিয়ে হয়ে যাবে ওর প্রেমিকার যদি সে একটা কিছু না করতে পারে, তাই নিয়ে বিকালে উৎকণ্ঠায় কেটেছে ওর। হারুণের সাথে পরামর্শ করছিল কি করা যায়। এখনও ছাত্র, পড়া শেষ না হলে চাকরি না পেলে কি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া যাবে? খেয়ে উঠে ওরা হলের সামনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল। তখনও শুনতে পাচ্ছিল ছেলেদের স্লোগান।
ভোরে সৌরভকে দেখেছে রক্তাক্ত চিৎ হয়ে পড়ে আছে সব স্বপ্ন নিয়ে, ঘুমিয়ে গেছে চিরতরে। হৃৎপিণ্ডের জায়গায় বিশাল ক্ষত, রক্ত উপচে পড়ে লাল হয়ে গেছে সবুজ ঘাস। ওর প্রেমিকা কেমন আছে? ও কি সৌরভের উপর অভিমান করে বিয়ে করে ফেলবে অভিভাবকের পছন্দের ছেলেকে? শিমুল নেচে-গেয়ে অভিনয় করছিল ইয়াহিয়া ভুট্টোর, ছেলেরা হেসে গড়িয়ে যাচ্ছিল খাওয়া বাদ দিয়ে। সেই মজা হাসি মাত্র ঘণ্টা কয়েকের ব্যবধানে কেমন বদলে গেল। প্রাণহীন দেহ নিয়ে পড়ে রইল সবাই। হারুন নিজের গায়ে চিমটি কাটে, ও কি আসলে বেঁচে আছে? প্রায়ই ওর মনে হয় ও আসলে বেঁচে নেই। মনে হয় ও বাতাস হয়ে ভাসছে।

খানিকটা স্বাভাবিক হলেও বিভীষিকাময় সে রাতের স্মৃতি কেড়ে নেয় ওকে জীবন থেকে।
পলাশ এতটা মৃত্যু দেখেনি হারুণের মতন। ওরা সারারাত খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। আর শুনেছে গোলাগুলির শব্দ, আগুন জ্বলা। দু’বার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাদে উঠে গিয়েছিল তখন দেখেছে আগুনের খেলা। অন্ধকার রাত্রির বুকে দাবানলের মতন জ্বলছে আগুন এখানে ওখানে। আকাশের বুকে মাঝে মাঝে আলোর ফুলকি ধেয়ে আসছে।

বুকের ভিতর এমনভাবে মুচড়াচ্ছে ভেতর থেকে সব যেন উগলে আসছে বমির ভাব কিন্তু কিছু পেটে নাই, বমি হবে কেমনে। থেকে থেকে ওয়াক ওয়াক শব্দ তুলছে হারুন। চোখ দুটো মরিচ লাগার মতন জ্বলছে আর রক্তজবার মতন লাল হয়ে আছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে হারুণের। অথচ বসে আছে শব্দহীন। পেছন থেকে কেউ একজন হারুনের কাঁধে হাত রাখে। খানিক পরে সে হাত সঞ্চালিত হতে থাকে হারুনের কাঁধে পিঠে খুবই নম্রভাবে। অনুভূতিহীন শক্ত হয়ে যাওয়া স্নায়ু ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসে যেন। একভাবে বসে থাকা হারুন পাশ ফিরে তাকায়, দেখে পাশে একটি মেয়ে বসে আছে যে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে গভীর মমতায়। ভাবলেশহীন দৃষ্টি মেলে রাখে মেয়েটির মুখে। কোনো কিছুই কাজ করে না ওর মাথায়। হারুণের সমস্ত অনুভব যেন ভিতরে গুমরে মরছে, কিছুতেই কোনো কিছু প্রকাশ করতে পারছে না।
একটু কাঁদো হারুন, ভিতরের কষ্টগুলো ঝরিয়ে দাও। এভাবে বসে থাকলে কি চলবে। তোমাকে যে আবার অ্যাকশনে যেতে হবে। পলাশ চলে গেছে কিন্তু আরো পলাশদের যে তোমাকে বাঁচাতে হবে, হারুন শক্ত হও জাগো, উঠো। এভাবে বসে থাকলে চলবে না। মেয়েটির কথা হারুণের ভিতরের ভয়ানক শক্ত পাথরটাকে হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে, নড়ে উঠে, ধসে পড়তে থাকে বানে ভেসে যাওয়া নদীপাড়ের মতন, কান্নার মতন হেঁচকী উঠতে থাকে কয়েকবার। এরপর নিস্তেজ হয়ে ঢলে পরে হারুন একপাশে ।

প্রচণ্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে হারুণের। অচেতনতার ভিতর প্রলাপ বকছে। খুঁনসুটি করছে ছোট বোনের সাথে। অভিমান করছে মার সাথে। বাবাকে বলছে, রাগ না করতে আর কয়টা দিন অপেক্ষা করো বাবা আমি আসছি। ক্রমাগত উল্টাপাল্টা বকে যাচ্ছে হারুন। ঠাণ্ডা পানির পট্টি দেয়া ছাড়া আর কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ঔষধও নাই, পথ্যও নাই। রোগীর জন্য যে খাবার দরকার তেমন কিছুই নাই। জাউভাতের দু-চামুচ মুখে দিচ্ছে মাঝে মাঝে বহু কষ্টে। তবুও দুইদিন পর চোখ তুলে তাকাল হারুন। স্বাভাবিক সুস্থ, পাশে বসা সামিয়াকে দেখে অবাক হলো ভীষণ।
─ আপনি?
─ যাক বাবা বাঁচালেন।
─ কেন?
─ এই যে সুস্থ হয়ে উঠলেন।
─ কী হয়েছিল আমার?
─ ভীষণ জ্বর। তিন দিন প্রায় অচেতন অবস্থা।
─ কোথায় আমি? আপনি এখানে কীভাবে? অবাক হারুন জানতে চায়। কিছুই মনে পড়ছে না ওর।
─ সে অনেক কথা, ধীরে ধীরে মনে পড়বে, মনে করার জন্য অস্থির হওয়ার কিছু নেই। চুপ করে শুয়ে থাকুন। শরীরের উপর দিয়ে তো অনেক ধকল গেল। আমি আসছি।
শোয়া থেকে আস্তে আস্তে উঠে বসে হারুন। মাথার ভিতর দপদপ করছে, শ্বাস টানছে জোরে জোরে। খানিক পরে সুস্থির হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়। ভাবতে চেষ্টা করে কী হয়েছিল?
মনে পড়ছে ধীরে, ঝাপসা, ছায়াছায়া।
এক বাটি মুড়ি এককাপ চা এনে হারুনের সামনে রাখল মেয়েটি।
─ আপনি সামিয়া চৌধুরী তাই না?
─ চিনতে পারলেন খুশি হলাম।
─ চিনতে না পারার কি আছে, আপনার মতন মেয়ে কি সচরাচর দেখা যায়? আপনাকে আমরা সবাই মিলে পছন্দ করতাম, হাসে হারুন।
─ সবাই !
─ কী আর করা বলেন, ক্লাসে পাঁচটি মেয়ে তার দুইজন বিবাহিত। একজন খালাম্মা। একজন সদা গম্ভীর। বাকি একমাত্র আপনি। সবাই আপনাকে নিয়েই কাড়াকাড়ি করত। হাসতে থাকে হারুন আপন মনে।
─ হাসছেন যে?
─ নিজের সৌভাগ্যের কথা ভেবে।
─ হুম, আচ্ছা আপনি ভাবতে থাকেন। দেখি আমি আপনার জন্য খাওয়ার কি ব্যবস্থা করা যায়, ক’দিন প্রায় না খেয়ে আছেন।
─ তবু একটু যদি বলতেন এখানে কীভাবে এলাম।
─ সামিয়া ভালো করে তাকায় হারুনের দিকে। এখনই ভয়াবহ অবস্থাটা মনে করে দেওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না।
হারুন আবার বলে,
─ কিছু বলছেন না যে, এটা কি আপনার বাড়ি?
সামিয়া ভাবে যে ভয়াবহ অবস্থার জীবন এখন না বলে কি হবে। কথাবার্তা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে তাই বলে,
─ না আমার বাড়ি না। আপনারা একটা অপারেশনে গিয়েছিলেন, তুমুল বৃষ্টির রাত ছিল। পলাশ আপনার বন্ধু, পাশ থেকে গুলি লেগে শহীদ হয়। এরপর আপনি উন্মাদের মতন ঝাঁপিয়ে পড়েন।
─ হুম মনে পড়ছে।
─ চুপচাপ শুয়ে থাকুন, আমি আসছি।
─ কিন্তু যাওয়ার আগে একটু বলে যান আমরা কোথায়, কি অবস্থায় আছি ? ছি ছি আমি এমন জ্বর বাঁধিয়ে বসে থাকলাম আর সবাই কই?
─ আছে ধারে-কাছেই কোথাও। খুব নিরাপদ নই আমরা। আজও আপনার জ্ঞান না ফিরে এলে এখান থেকে যে কোনো উপায়ে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হতো এমন কথা বলে গেছে শিবু গত পরশু। আজ বিকালের মধ্যে এসে পড়বে। তার আগে দেখি খাওয়াটা শেষ করে ফেলি।
─ আপনি কীভাবে এখানে?
─ পরে কথা হবে।
সামিয়া ঘর থেকে চলে যায়।
হারুন ধীরে ধীরে উঠে দরজার কাছে হেঁটে যায়। ধড়ফড় করছে বুক। ভীষণ দুর্বল শরীর। খোলা হাওয়ায় লম্বা নিঃশ্বাস নেয়। দরজার পাল­¬া ধরে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে দেয় দূরে। রোদের আলোয় পুড়ছে বাইরের পৃথিবী। ঘন গাছগাছালি-ঘেরা বাড়ি, নিঃশব্দ যেন বিরান ভূমি, কাক পর্যন্ত ডাকছে না এই জৈষ্ঠ্যের দুপুরে। থমথমে একটা ভাব চারপাশে। খোলা উঠান, অদূরে টিনের চালার ঘর, মাঝখানে টানাঘর কয়েকখানা, বেশ বনেদি বাড়ি মনে হয়। এক পা, দু’পা করে বাইরে বের হয় হারুন। থেমে থেমে হাঁটে। আগের মতন অতটা দুর্বল লাগছে না। এ বাড়ির মানুষগুলো কই? হারুন এখানে কেমনে এলো মনে করার চেষ্টা করে। সামিয়া কোনোদিকে গেল? উঠানে নেমে এসে দাঁড়ায় হারুন। রোদের আলোয় তাতান ঝাঁজ অনুভব করে শরীরে। গোসল করতে ইচ্ছা করে ওর। এদিকটা বাড়ির সামনের দিকে মনে হয়। একটু হেঁটে দুই ঘরের মাঝখানে একটা চিকন রাস্তা দিয়ে পিছনে চলে আসে বাড়ির। প্রচুর গাছপালার সাথে গোলাঘর, রান্নাঘর, কলপাড় দেখতে পায়। সামিয়া রান্নায় ব্যস্ত। অনভ্যস্ত খড়ির চুলার ধোঁয়ায় চোখ লাল। হারুন রান্নাঘরের দাওয়ায় গিয়ে বসে,
─ কি করছেন? চমকে তাকিয়ে হারুনকে দেখে আশ্বস্ত হয় সামিয়া।
─ ওহ আপনি, মাগো যা ভয় পেয়েছিলাম, উঠে এসেছেন কেন?
─ মনে হচ্ছিল একটু গোসল করি। কিন্তু আপনার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আপনাকে সাহায্য করি, কি রাঁধছেন ?
এমন কিছু না, যা পেয়েছি সব ঢেলে দিয়ে খিচুড়ি, হয়ে গেছে প্রায়। গোসল করলে যান চটপট করে আসুন, ঐদিকে টিউবওয়েল আছে। হাঁটতে পারবেন অতদূর?
─ পারব। এখন একটু ভালো লাগছে। শক্তিও পাচ্ছি।
চলুন আমি আপনাকে দেখিয়ে দেই আর শুকনো কাপড় দেই।
─ জলদি করেন আর দেখবেন চুলায় ধোঁয়া যেন না হয়।
─ আচ্ছা, সামিয়া নিঃশব্দ পায়ে দ্রুত ভিতরের ঘরে ঢুকে যায়। খানিক পরে একখানা টাওয়েল আর একটা লুঙ্গি নিয়ে আসে। হারুনকে নিয়ে যায় কলপাড়ে, এক বালতি পানি সাবান রাখা একপাশে।
─ আপনি জলদি গোসল সারেন। ঠাণ্ডা লাগে না যেন আবার।
─ যান আপনি রান্না দেখেন আমি আসছি।

গায়ে পানি ঢালতেই, শিরশির করে উঠে প্রথমে শরীর। দু মগ পানি ঢালার পর আরাম লাগে। রোদে রাখা পানি অতটা ঠাণ্ডা না কিন্তু পানি ঢালার শব্দ হচ্ছে তাই শব্দ না করে গোসল করার জন্য আস্তে আস্তে পানি ঢালে হারুন যতটা সম্ভব শব্দ না করে। কোথায় কি অবস্থায় আছে কিছুই জানা নেই। যে কোনো সময় সামনে যমের মতন মিলিটারি দেখতে পাবে বলে ভয় হতে থাকে। সামিয়ার জন্য আরো বেশি ভয় লাগছে। মেয়েটা এভাবে আয়োজন করে রাঁধতে না বসলেই পারত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সামিয়া চৌধুরী, স্মার্ট সুন্দরী পড়–য়া মেয়ে এভাবে খড়ির চুলায় রান্না করছে, স্বচক্ষে না দেখলে জীবনে হারুন বিশ্বাস করত না। বাঙালি সব মেয়েই কি মায়ের জাত। কতকিছু বদলে দিল এই যুদ্ধের হাওয়া। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোসল শেষ করে হারুন।
গা মুছতে গিয়ে টের পায় মিষ্টি একটা গন্ধ টাওয়েলে। এটা কি সামিয়ার টাওয়েল! তাই হবে হয়তো। তাড়াহুড়ায় নিজের টাওয়েলটাই এনে দিয়েছে সামিয়া। ভালোলাগার এক বোধ খেলা করে হারুনের দেহজুড়ে। গোসল করে বেশ ঝরঝরে লাগছে।
চটপট লুঙ্গি আর টাওয়েল ধুয়ে উঠানের টানা তারে মেলে দিয়ে বালতিটা পানিতে ভরে রেখে রান্নাঘরে যায় হারুন।
লাল চোখ মেলে সামিয়া বলে,
─ হলো? আসেন খেয়ে নেন।
─ আপনি?
─ আমিও খাব।
দুজনে নিঃশব্দে খেতে থাকে। একসময় হারুন বলে,
─ আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে।
─ আমারও।
─ আসলে চারপাশের খবর, কোনো গ্রামে আছি, মিলিটারি এখানে এসেছে কি না কিছুই জানি না তো।
─ শিবু বলেছিল মিলিটারি এসেছিল গ্রামে। বেশি লোকজন ছিল না, সবাই আগেই পালিয়ে ছিল। দু’এক ঘর মানুষ ছিল আর বাইরে থেকে আগত কিছু মানুষ ছিল তাদের কিছু মারা গেছে একরাতের তাণ্ডবে, যারা ছিল তারাও চলে গেছে গ্রাম ছেড়ে। মিলিটারিরা আরও ভিতরের দিকে গেছে। যে রাস্তা দিয়ে বর্ডার ক্রস করতে হবে সেদিকে। তাই তোমাকে আর আমাকে নিয়ে ঐদিকে যাওয়ার চেয়ে এখানে রেখে যাওয়াটা নিরাপদ মনে করেছে। গত রাতে অনেক গোলাগুলির শব্দ শুনেছি। শিবু বলেছিল ওরা অপারেশন চালিয়ে এলাকা শত্র“মুক্ত করে আমাদের নিতে আসবে।
─ যখন বলেছে তখন আসবে।
─ আজ রাতটা আমরা ওদের জন্য অপেক্ষা করি। তবে এই বড় বাড়িটি ছেড়ে আমাদের ছোট কোনো আস্তানায় মাথা গুঁজতে হবে। যদি মিলিটারি আসে তবে এই বড় বাড়িটাই ওদের টার্গেট হবে প্রথমে।
রান্নাঘর গুছিয়ে সামিয়া বলল, আমি চটপট একটু গা ধুয়ে আসি। গরমে অতিষ্ঠ লাগছে।
─ ঠিক আছে।
গোসল করে খেয়ে শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে, শক্তি পাচ্ছে হারুন। ভিতরের ঘরে ফিরে এসে চারপাশে চোখ বুলাল। কার বাড়ি, কারা থাকত। সব সাজানো পড়ে আছে। কাচের আলমিরার মাঝে চিনামাটির বাসন। আলনা থেকে কয়েকখানা কাপড় বের করে একটা মাপ মতন পাজামা পেয়ে গেল। সেটা পরে নিল, সাথে হাফ হাতা একটা শার্ট। আরো কখানা কাপড়ের পুঁটলি বাঁধল। পাশে বড় বড় টিনের কৌটায় মুড়ি পেল, একটা চাদরে বেঁধে নিল তাও। শিবু যদি এসে যায় ভালো, নয়তো অন্য আস্তানা খুঁজে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। আশেপাশে কি কোনো লোকজন নাই। এত সুনসান নীরবতা? কোথায় কোনো গ্রামে আছি কিছুই বুঝতে পারছি না। শিবু ভালোয় ভালোয় চলে আসুক। আমার কী হয়েছিল, এখানে কেমন করে এলাম কিছুই মনে পড়ছে না। অস্থিরতায় একটা টেবিলের উপর রাখা কিছু বইখাতা উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে হারুন। কলেজে পড়ত কেউ এই বাড়ির। নাম লেখা আছে মোঃ আবদুল হাসিম। প্রথম বর্ষ। রোল নং ৩২। একখানা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই, দুটি কবিতার বই, পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইংরেজি অভিধান। কবিতার বই দু’খানির সাথে সাদা খাতা আর বলপেনটা ঝুলায় ভরতে ভরতে পলাশের কথা মনে পড়ে হারুনের। খাতাভর্তি কবিতা লিখছিল পলাশ।
চুল মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে সামিয়া। নতুন বেশের হারুনের দিকে অবাক চোখে তাকায়।
হারুন সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,
─ মোঃ আবদুল হাসিম।
─ কে?
─ এই যে তোমার সামনে দাঁড়ানো।
─ ও তাই নাকি ?
─ হুম, এই বাড়ির ছেলে।
─ আচ্ছা বাবা, মোঃ আবদুল হাসিম, আমরা এখন কি করব বলত? সামিয়াও মজা করে।
─ আমরা শিবুর জন্য অপেক্ষা করব। এরমাঝে তুমি আমাকে বলো আমরা এখানে কীভাবে এলাম? আমার কিছুই মনে পড়ছে না।
─ মোঃ আবদুল হাসিম, তুমি তো এ বাড়ির ছেলে এখানেই ছিলে।
─ তা ঠিক, তুমি এখানে কীভাবে?

টরন্টো, কানাডা

 

- Advertisement -

Read More

Recent