রবিবার - মে ১২ - ২০২৪

কলকাতা সাফ: চোখ বেয়ে শুধুই অশ্রু

সালটা ১৯৮৭। ডিসেম্বরের কনকনে শীতে কলকাতায় তখন তৃতীয় সাফ গেমসের আসর বসছে। পাশাপাশি আমার ক্রীড়া সাংবাদিকতার বয়স কেবল বাড়তে শুরু করেছে। বলা যায় এই গেমস শুরুর মুহুর্তে তখন তা মাত্র তিন বছরে গিয়ে ঠেকেছে। দেশের জাতীয় ক্রীড়া পাক্ষিক ‘ক্রীড়া জগত’ পত্রিকায় তখন নিয়মিত লেখক। ’৮৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত গেমসের দ্বিতীয় আসরটি কভার করার অভিজ্ঞতা অর্জনে ছিলো। খেলাধুলা নিয়ে নিয়মিত আড্ডা তখন ক্রীড়া জগতে। কলকাতা সাফের মাস দুয়েক আগে মিসেস সালমা রফিক, যার কাছে আমার সাংবাদিকতার হাতে খড়ি। তিনি তখন ক্রীড়া জগতের নির্বাহী সম্পাদক। আজ অবশ্য তিনি না ফেরার দেশে। সৃষ্টিকর্তা যেনো তাঁকে শান্তিতে রাখেন। তাঁর স্নেহে আমরা অনেকেই উৎসাহিত হয়েছিলাম এ পেশায় আসতে। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রায় সবাই সালমা রফিককে ‘আপা’ সম্বোধন করলেও আমি ডাকতাম চাচী বলে। সে যাইহোক, সালমা চাচী জাতীয় এ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশীপের একটা এসাইনমেন্ট দিতে গিয়ে হঠাৎ করেই বললেন, ডিসেম্বরে কলকাতায় সাফ গেমস। আমি যাচ্ছি। তুমি যাবে নাকি? আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। তখন পর্যন্ত দেশের বাইরে কোনো আন্তর্জাতিক গেমস কভার করার সুযোগ হয়নি। না হবারই কথা। কারণ আমি তখনও ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিন্যান্সে মাস্টার্স করছি। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়নি। কিন্তু তাতে কী! কলকাতা যাবো সাফ গেমস কভার করতে, এটা তখন আমার কাছে এক বিরাট ব্যাপার। কোনো কিছু না ভেবেই বললাম যাবো। ক্রীড়াজগত অফিসে আর বসে থাকতে পারছিলাম না। কতো তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবো আর প্রথম এ সুসংবাদটা মাকে শোনাবো। এ্যাথলেটিক্সের এসাইনমেন্টটা নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা বাসার পথে। তখন ঢাকা শহরে এতটা ট্র্যাফিক জ্যাম নেই। তাই নয়া পল্টন থেকে রিক্সায় চড়ে লালমাটিয়ায় পৌঁছাতে সময় লাগলো মাত্র বিশ মিনিট। আবেগ আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। মাকে জড়িয়ে ধরে খবরটা জানালাম। সে সাথে বাসার অন্যরাও জানলো। সবার মধ্যে খুশীর একটা ভাব দেখলেও মায়ের চোখে তেমন অনুভূতি চোখে পড়লো না। বরং কপালে কেমন জানি একটা টেনশনের ছাপ। বেশ কিছু প্রশ্ন করা শুরু করলেন। কখন যেতে হবে, কোথায় থাকা হবে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কি- এমন নানা প্রশ্ন। সব শুনে অনুমতি মিলল কলকাতা যাবার।

- Advertisement -

কলকাতা সাফ গেমসের মাসকট

ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ। তারিখটা ঠিক মনে নেই। ঢাকা থেকে সড়ক পথে কলকাতা যাওয়া হবে। প্রায় দু’শো সদস্যের বাংলাদেশ দল। তাই অর্থের সাশ্রয় ঘটাতেই বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন সিদ্ধান্ত নেয়, বিমান নয়, সড়ক পথে পাঁচ বাস রিজার্ভ করে কলকাতা যাবে বাংলাদেশ দল। যে দলের সাথে আমিও যাবো। যাবে আরো বেশ ক’জন সাংবাদিক। এদের মধ্যে ছিলেন দৈনিক বাংলার মাসুদ আহমেদ রুমি, দৈনিক বাংলার বাণীর আতাউল হক মলি­ক, নিউনেশনের আফজাল খান (সংবাদ পাঠক), টাইমসের মঞ্জুরুল হক, দৈনিক সংবাদের অজয় বড়ুয়া, ইত্তেফাকের কাশীনাথ বসাক, চট্টগ্রাম পূর্বকোণের মোশারফ হোসেন প্রমুখ।
সে যাইহোক, ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে শুরু হলো পাঁচ বাস নিয়ে আমাদের যাত্রা। দারুণ রোমাঞ্চকর অনুভুতি তখন আমার। যশোরের বেনাপোল বর্ডার হয়ে কলকাতার পথে ছুটছে আমাদের বাস। আমরা সাংবাদিকরা বিচ্ছিন্নভাবে নানা বাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলাম। প্রায় সাত ঘণ্টা সড়ক ভ্রমণের পর আমরা বেনাপোল বর্ডারে পৌঁছালাম। সেখানেই দেখা মিললো সব সাংবাদিকের। জড়ো হলাম একসাথে। আমরা ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ। তাই সবাই চিনি একে অপরকে। সাংবাদিকদের মাঝে সিনিয়র-জুনিয়রদের সিগারেট খাওয়া নিয়ে কোনো লুকোচুরি কোনো কালেও ছিলো না, এখনো নেই। তাই আমরা যারা ধুমপায়ী তারা এ বিরতিতে ঝটপট সিগারেট ধরিয়ে ফেললাম। আমার চেয়ে বয়সে ঢের সিনিয়র আফজাল ভাইয়ের (আফজাল খান) ফেস ভ্যালুটা সবার চেয়ে বেশী। কারণ নিউনেশন পত্রিকায় ক্রীড়া সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিটিভিতে নিয়মিত সংবাদ পড়তেন। স্বাভাবিকভাবেই একটু গুরুগম্ভীর থাকার চেষ্টা করতেন। বিশেষ করে জুনিয়রদের কাছে। তারপরেও আমাকে সিগারেট খেতে না দেখে পকেট থেকে বেনসনের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট দিলেন। কিন্তু এ কী! বেনসনের প্যাকেটে কম দামি কিছু বগলা সিগারেট। জিজ্ঞেস করলাম আফজাল ভাইকে, বেনসনের প্যাকেটে বগলা কেনো? একটু বোধ হয় লজ্জা পেলেন আমার সামনে। পাশে দাঁড়ানো অজয় দা (অজয় বড়–য়া) বললেন, বুঝলে আফজালের পকেটে পয়সা নেই কিন্তু ভাব আছে। সাংবাদিক, সংবাদ পাঠক, ফেস ভ্যালু বলে একটা বিষয় আছে না? হো হো করে হেসে ফেললেন সবাই। সে সময়ই জানলাম, আফজাল ভাইয়ের এটি আজ নতুন নয়। সব সময়ই বেনসনের প্যাকেটে থাকে অন্য সিগারেট। এটা জানতো নিউনেশনে তাঁর সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুজন। রাস্তায় আরো এ রকম অনেক মজা করতে করতেই সন্ধ্যা নাগাদ আমরা পৌঁছালাম কলকাতায়। পুরো বাংলাদেশ দল গিয়ে উঠলো সে সময় কলকাতার সবচে’ নামকরা ফাইভ স্টার গ্র্যান্ড হোটেলে। আর আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো যুব ভারতীয় ক্রীড়া কমপ্লেক্সের হোস্টেলে। আমার বেডের পাশের বেডে ছিলেন মলি­ক ভাই (মরহুম আতাউল হক মলি­ক)। তিনি ছিলেন একদিকে সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক ফুটবল রেফারী ও ধারাভাষ্যকার। তাঁর মতো এমন গুণী মানুষের কাছে থেকে আমি সাংবাদিকতার অনেক কিছু যেমন শিখেছি, তেমনি শিখেছি জীবন-দর্শনের অনেকটাই। কলকাতায় আমার প্রথম আসা বলে প্রতি রাতেই শুয়ে শুয়ে আমাকে কলকাতার নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। পাশাপাশি ছবক দিতেন, ভুলেও যেনো একা রাস্তায় বের না হই। পাছে আছে বিপদের সম্ভাবনা।
যুব ভারতীয় কমপ্লেক্স থেকে প্রতিদিন সকালে আমরা দল ধরে বেরিয়ে পড়তাম কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে। যেখানে এ্যাথলেটিক্স ও ফুটবলের আসর বসেছিলো। ভলিবল, জুডো, কারাতে, টেবিল টেনিস, কুস্তি, বাস্কেটবল খেলাগুলো হয়েছিলো যুব ভারতীয় ইনডোর ক্রীড়া কমপ্লেক্সে। আর টেনিস ইভেন্টটি যতোটা মনে পড়ে কলকাতার টেনিস ক্লাবে গিয়ে ঠাঁই নিয়েছিলো।
যে কোনো গেমসের মূল আকর্ষন এ্যাথলেটিক্স। দৌড়-ঝাঁপের এ খেলাটিকে বলা হয় ‘কুইন অব দ্য গেমস’। দেশে থাকাকালীন এই ইভেন্টটি আমি সম্ভবত: সে সময়ের ক্রীড়া সাংবাদিকদের মধ্যে সবচে’ বেশী কভার করেছি। তাই এ্যাথলেটদের সম্পর্কে আমার বিস্তর ধারণা ছিলো। সাফের সাত জাতির গেমস শুরু হলো। বাংলাদেশ শিবিরে শুধুই হাহাকার। স্বর্ণের সন্ধান মিলছে না কোনোভাবেই। অথচ ভারত বিভিন্ন ইভেন্টে এক চেটিয়া প্রাধান্য বজার রেখে প্রতিদিনই গড়ে দশটি করে স্বর্ণ জয় করছে। আর আমরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে তা দেখছি। কোনো খেলাতেই কোনো সাফল্য আসছে না। এমন হতাশা নিয়েই কাটলো প্রথম দু’দিন। অবশেষে তৃতীয় দিনে এসে স্বর্ণের মুখ দেখলো বাংলাদেশ। দেশের সে সময়ের দ্রুততম মানব সেনাবাহিনীর শাহ আলম ১০০ মিটার স্প্রীন্টে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকান এ্যাথলেটদের পেছনে হটিয়ে বাংলাদেশ দলের জন্য বয়ে নিয়ে আসলেন প্রথম স্বর্ণ। একই ইভেন্টে শাহানউদ্দিন জিতলেন রৌপ্য। আর সে মুহুর্তটা যে কি আনন্দের, কি স্বস্তির তা বলে বোঝানো যাবে না। বাংলাদেশ দলের যে যেখানে ছিলেন ছুটে আসলেন সল্ট লেক স্টেডিয়ামে শাহ আলমকে অভিনন্দন জানাতে। সবাই মনে মনে নি:শ্বাস ছেড়ে হালকা হলাম। কারণ, ইজ্জত অন্তত: বাঁচলো। স্বর্ণবিহীন খালি হাতে ফিরতে হবে না দেশে। পরের দৃশ্যটি ছিলো আরো আবেগময়, আরো রোমাঞ্চকর অনুভুতিতে সিক্ত। পদক বিতরণী সেরোমনিতে ভিক্টোরি স্ট্যান্ডে তখন বাংলাদেশের গর্বিত সন্তান এ্যাথলেট শাহআলম। পাশেই রৌপ্যজয়ী শাহানউদ্দিন। গলায় স্বর্ণের পদক পড়িয়ে দিলেন ভারতীয় অলিম্পিক এসোসিয়েশনের প্রধান ডালমিয়া। সাথে সাথে বেজে উঠলো বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি …।’ ভিনদেশে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, পুরো শরীরটা যেনো শিহরণে কাঁপছে আর চোখ বেয়ে অঝরে ঝরতে থাকলো কান্না। এ কান্না আনন্দের। এ কান্না অর্জনের। আশেপাশে চোখ পড়তেই দেখি প্রেস বক্সে বসে থাকা আমার সব সহকর্মীরই একই অবস্থা। সবার চোখে পানি। এ যে কেমন অনুভুতি তা বলে বোঝানো যাবে না। এ্যাথলেটিক্সের সেরা ইভেন্ট হিসেবে খ্যাত ১০০ ও ২০০ মিটারে স্বর্ণ ও রৌপ্য জয় করে বাংলাদেশ প্রমাণ করে স্বল্প পাল­ার দৌড়ে বাংলাদেশই দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা।
গেমসের চতুর্থ দিন আবারো স্বর্ণ জয়ের আনন্দ। এবার সাঁতার থেকে দুটি স্বর্ণ। ১০০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে বজলুর রহমান ও তার পরপরই ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে আব্দুস সালাম স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব দেখান। সেবার এ্যাথলেটিক্স ও সাঁতার ছাড়া গেমসের অন্য কোনো ইভেন্ট থেকে বাংলাদেশ দল স্বর্ণের মুখ দেখেনি। কারণ ফুটবলে স্বর্ণ জয়ের আশাটিও নিরাশায় পরিণত হয়। ভারতের কাছে ফাইনালে ১-০ গোলে হেরে। প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ সে ফাইনালটিতে অতিরিক্ত সময়ের খেলায় হেরে বসে বাংলাদেশ। কলকাতায় তৃতীয় এ সাফ গেমস আসরে স্বাগতিক ভারত ৯১টি স্বর্ণ জয় করে পদক তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করলেও বাংলাদেশকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় মাত্র এ তিনটি স্বর্ণ নিয়ে। পাকিস্তান ১৬টি স্বর্ণ নিয়ে দ্বিতীয় ও শ্রীলংকা ৪টি নিয়ে তৃতীয় স্থান লাভ করে। আর বাংলাদেশের ভাগ্যে জোটে চতুর্থ স্থান।
দু’বছর আগে ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে এক সাঁতার থেকেই বাংলাদেশ দল তুলে নিয়েছিলো তিনগুণ স্বর্ণ। সাথে এ্যাথলেটিক্সে তো ছিলোই। তুলনামুলক অনেক বাজে পারফরমেন্স দেখালেও ফূর্তি-ফার্তায় খেলোয়াড়রা কম যাননি। কলকাতার নিষিদ্ধ পল­ী সোনাগাছি থেকে বেরিয়ে আসতেই পুলিশের হাতে কট হয়ে যান আমাদের দীর্ঘদেহী একজন তারকা ফুটবলার ও তার সাথে দুরপাল­ার দৌড়ের একজন এ্যাথলেট। তাৎক্ষণিকভাবে মিডিয়া লুফে নেয় হট সংবাদ হিসেবে। অবস্থা বেগতিক দেখে বাংলাদেশ দলের প্রধান শেফ দ্য মিশন কর্নেল (অব:) ওবায়দুর রহমান বাংলাদেশী সাংবাদিকদের সবাইকে ডেকে নেন গ্র্যান্ড হোটেলে তাঁর রুমে। কর্নেল সাহেব অনেকটা আকুতি-মিনতি করেই অনুরোধ রাখলো আমরা যেনো এ সংবাদের ডেসপাস না দেই। এতে দেশের ইজ্জতের শ্লীলতাহানী ঘটবে। আমরাও মেনে নিলাম তাঁর কথা। কিন্তু দেশে ফিরে সবকটি জাতীয় দৈনিক ফলাও করে প্রকাশ করে বাংলাদেশ ক্রীড়া দলের ব্যর্থতার সংবাদ। পাশাপাশি ঢাকায় ফেরার পথে বনগা হরিদাসপুর চেক পোস্টে বাংলাদেশ দলকে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের আটক রাখার খবরও। খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা এতোটাই শপিং করেছিলো যে, প্রতিটি বাসের ছাদ হয়ে উঠেছিলো পাহাড়সম। পুলিশ বেঁকে বসে এমন মালের বহর দেখে। পরে দলের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি ম্যানেজ করতে সমর্থ হন। ভারতীয় পত্র-পত্রিকা গুলোতেও এ নিয়ে ছাপা হয় সরস প্রতিবেদন। আার খেলোয়াড়-কর্মকর্তারা নানাভাবে ধিক্কার কুড়ালেও বাংলাদেশী সাংবাদিকদের যথেষ্ট রকম সম্মান জানানো হয়েছিলো গেমস চলাকালীন। গড়ের মাঠে সাংবাদিকদের সম্মানে এক নৈশভোজের আয়োজন করে কলকাতা স্পোর্টস জার্নালিস্ট ক্লাব। কলকাতার তখন নামকরা সাংবাদিক আনন্দ বাজারের রুপক সাহা, ইন্ডিয়ান স্টেটসম্যান পত্রিকার শ্যাম সুন্দর ঘোষ সহ চিত্তরঞ্জন দাস, গৌতম ঘোষ দেবাশীষ ভট্টচার্যরা ছিলেন ক্লাবের কর্ণধার। তরুন বয়সে এমন প্রবীন সাংবাদিকদের সান্নিধ্যে কাজ করাটাও আমার জন্য ছিলো অনেক আনন্দের, অনেক প্রাপ্তির।
এদিকে রবীন্দ্র ভারতীয়’তে গেমসে অংশ নেয়া সাতটি দেশের ক্রীড়াবিদদের সংবর্ধনা জানায় পশ্চিমবঙ্গ অলিম্পিক এসোসিয়েশন। নায়ক সৌমিত্র চ্যাটার্জি, প্রতিমা ব্যানার্জী, অপর্না সেন, মান্না দে সহ অনেকেই অংশ নেন মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক এই অনুষ্ঠানে। এতোদিন যাদের নাম শুনেছি, এবার সামনা-সামনি তাঁদের দেখে রোমাঞ্চিত হয়েছি বারবার।
দশদিন ব্যাপী এ গেমসে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক একটি ভেন্যুতে সংবাদ সংগ্রহ করে ক্লান্ত শরীরে যখন মিডিয়া সেন্টারে ফিরতাম তখন সব ক্লান্তি যেনো উড়ে যেতো নিমিষেই। তার নেপথ্যে অবশ্য বিশাল অবদান ছিলো ‘সাফ সুন্দরী’দের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাছাই করা সুন্দরী ছাত্রীদের বসানো হয়েছিলো মিডিয়া সেন্টারে। ওদের দায়িত্ব, সাংবাদিকদের কাজে সাহায্য করা। ইনফরমেশন সাপ্লাই, ফটোকপি করে দেয়া, কিম্বা ফ্যাক্স-টেলেক্সে সংবাদ পাঠাতে সাহায্য করায় ছিলো এ সাফ সুন্দরীদের কাজ। আর এ কাজের এক ফাঁকে কখন যে অন্তরঙ্গ এক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে সাফ সুন্দরী শ্বাসতি দাস গুপ্তার সাথে। প্রতিদিনের দেখা, কথা আমাদের নিয়ে যায় অনেকটাই গভীর বন্ধুত্বের দিকে। কলকাতায় যাবার সময় আমার বোনরা আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিলো, যতোগুলো পারো সুতির শাড়ী কিনে আনবে। কিন্তু মেয়েদের এ বস্ত্রটি কেনার অভিজ্ঞতা আমার কোনো কালেই ছিলো না। সঙ্গত কারণেই গেমসের শেষদিকে এসে শ্বাসতির সাহায্য চাইলাম। কোনো রকমের সুযোগ না দিয়ে বললো আজই যাবো। আমার মাকেও সাথে নেবো। তবে তোমাকে আমাদের বাড়ী যেতে হবে প্রথম। তারপর মাকে নিয়ে শপিংয়ে। আমি অবশ্য চেয়েছিলাম ওকে নিয়ে একা যেতে। কিন্তু রাজী হলো না। অগত্যা মিডিয়া সেন্টারের কাজ সেরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা বালীগঞ্জ। বাড়ীতে ওর বাবা-মায়ের সাথে পরিচয়। টোস্ট বিস্কুট দিয়ে একটু চা। তারপর আবারও ট্যাক্সি নিয়ে শপিংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা। এক রাতে শেষ হলো না কেনাকাটা। পরদিন রাতে আবারো শপিং। তবে এবার ওকে একা নিয়ে। লিস্ট ধরে আমাকে পুরো শপিংটাই করে দিলো শ্বাসতি। রেস্টুরেন্টে আমরা খেলাম, গল্প করলাম। আর ওর জন্য উপহার হিসেবে কিনে দিলাম একটি ভ্যানিটি ব্যাগ।
এবার বিদায় নেবার পালা। পরদিন সকাল ৮টায় যুব ভারতীয় ক্রীড়া কমপ্লেক্স থেকে বাস ছাড়বে ঢাকার উদ্দেশ্যে। রাতেই সবকিছু গুছিয়ে রাখতে হবে। শ্বাসতিকে ওদের বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরে এলাম যুব ভারতীয়’তে। পরদিন সকালে আমরা সবাই ডাইনিংয়ে হাল্কা নাস্তা সেরে নিলাম। বাক্স-পেটরা নিয়ে কমপ্লেক্সের মূল ফটক থেকে বেড়িয়ে আসতেই আচানক আমার সামনে দাঁড়িয়ে শীর্নকায় এক অপরূপা বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্রী। একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে জানাতে এসেছে বিদায়। এতো সকালে শ্বাসতি তুমি? একেবারে নির্বাক হয়ে গোলাপগুচ্ছ আমার হাতে তুলে দিতেই দেখি ওর দু’চোখ ভরে শুধুই অশ্রু…।

মন্ট্রিয়ল, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent