বৃহস্পতিবার - মে ৯ - ২০২৪

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ধনীর শহর ডুসেলডর্ফ

ছবিট্রাভেল গে

দীর্ঘ যাত্রাপথে আমার সঙ্গে থাকে বই।  ভ্রমনের সময়  খুব জঠিল বিষয় আমি পড়তে পারি না। এজন্য ব্যাগে থাকে স্মৃতিচারণ, জীবন কাহিনী, ভ্রমন কিংবা গল্প-উপন্যাসের বই । কোলন স্টেশন হতে ট্রেন ছাড়ার দশ মিনিটের মধ্যে ডুবে যাই কবি আল মাহমুদের শৈশব কৈশোর নিয়ে লেখা আত্মজীবনী ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’র পাতায় পাতায়। প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনা, মেদহীন ঝরঝরে গদ্যের স্রোতে আল মাহমুদ আমাকে নিয়ে যায়

ডাকাতিয়া, তিতাস নদী বিধৌত  ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র স্মৃতিধন্য শহরে, যেখানে একসময় ভোর হতো রাগ-রাগিনীর সুরের ঝংকারে।

- Advertisement -

জার্মান ট্রেনের গতির তীব্রতায় মুখের ওপর বই রেখে কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়ি,টেরও পাইনি।সেই ঘুম ভাঙ্গলো বিকেল ৫টায়। চোখ মেলে দেখি ট্রেন ডুসেলডর্ফ হপ্ট বানুফে দাঁড়িয়ে । হপ্ট বানুফ মানে এখানকার প্রধান রেলওয়ে স্টেশন। কম্পার্টমেন্টের  সব যাত্রী নেমে যাবার পর ধীরে সুস্থে ট্রেন থেকে নামি।  প্লাটফর্মে আমার জন্য হাসনাতভাই অপেক্ষা করার কথা। তাকে খুঁজে না পেয়ে ফোন করি। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে জানান,পার্কিং না পাওয়ায় স্টেশনের বাহিরে গাড়িতে অপেক্ষা করছেন।

স্টেশন থেকে বের হতে প্রচন্ড পানির পিপাসা পেল।ওদিকে হাসনাতভাই আমার জন্য অপেক্ষারত, কি করবো অতশত না ভেবে ছোট একটি দোকান হতে পানির বোতল কিনে ফেলি ২ ইউরোতে । এখানে পানির চেয়ে বিয়ারের দাম সস্তা। এক ইউরোতে লার্জ মগে বা ক্যান বিয়ার পাওয়া যায়। দোকান হতে বের হয়ে দেখি হাসনাতভাই গাড়ি নিয়ে হাজির। রাস্তার ওপর গাড়ি থাকায় পিছনে গাড়ির জ্যাম লেগে যাবার আগেই দ্রুত ব্যাকডালায় ল্যাগেজ তুলে দিয়ে গাড়িতে চেপে বসি।

ডুসেলডর্ফ হচ্ছে জার্মানির সপ্তম বৃহত্তম শহর। এর আগেও আমি একবার এ শহরে এসেছিলাম হাসনাতভাইয়ের আমন্ত্রনেই। এবারও  আমার ডুসেলডর্ফে আসা হয়েছে হাসনাতভাইদের সংগঠন ফর বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের আমন্ত্রনে। রানা প্লাজা ট্র‍্যাজেডিতে হতাহতদের চিকিৎসা সহায়তায় সংগঠনটি পাঁচ মেট্রিক টন ঔষধ পাঠিয়েছে। মেডিক্যাল টীম পাঠানোর চেস্টা চলছে।

এছাড়াও তারা প্রতি বছর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি টীম নিয়ে হাসনাতভাইয়ের নেতৃত্বে ঢাকায় যায়। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথভাবে হাতের তালু ও ঠোঠকাটা মানুষের অস্ত্রোপচার ও ঔষুধ বিনামুল্যে বিতরণ করে থাকে। দেশে সংগঠনটির কার্যক্রম গরীব, দুস্থ, অসহায় মানুষের জন্য আশার আলো দেখিয়েছে।

যাহোক ,শহর ছাড়িয়ে হাসনাতভাইয়ের গাড়ি ছুটে চলে। চারিদিকে সুনশান নিরবতা। বিকেলের পড়ন্ত রোদে বিস্তৃন ধু ধু মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে দু’চারটে ছবির মতন বাড়ি ঘর। কি অদ্ভুত ভাললাগায় মন ভরে যায়। এখানে প্রকৃতি তার সমস্ত সৌন্দর্য যেন ঢেলে দিয়েছে। শহর থেকে বের হয়ে হাইওয়ে উঠার আগে চোখে পড়েছে হাইরাইজ বিল্ডিং,শপিংমল।বাড়িগুলোর প্রায়ই বালু এবং চুনাপাথরের তৈরি গোথিক স্টাইল, রোমান স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ।

পনেরো মিনিটের ড্রাইভে আমরা চলে আসি হাসনাতভাইয়ের বাসায়। শহর থেকে একটু দুরেই হাসনাতভাই ডুপ্লেক্স বাড়ি করেছেন। জায়গাটি ঠিক গ্রাম বলা যাবে না। আবার শহর বলাও যাবে না।খুব নিরিবিলি শান্ত একটা পাড়া গাঁ যেন। বাড়ির সামনে ও পিছনে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত চমৎকার এক টুকরো লন আছে। বাগানে বসে বিকালের চা-কফি খেয়ে আমরা বের হয়ে পড়ি রাইন নদী দেখতে। বের হবার সময় কেয়াভাবী রাতের ডিনারের জন্য তাড়াতাড়ি ফেরার অনুরোধ করেন।

ডুসেলডর্ফ আসলেই খুব গোছানো শহর। এটি জার্মানের নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যের রাজধানী । আগে থেকেই জানা ছিল, ডুসেলডর্ফ বানিজ্যিক নগরী কিংবা ধনীদের শহর হিসেবে খ্যাত। এ শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে রাইন ও ডাসেল নামে দুইটি নদী । আয়তনের তুলনায় মানুষের বসবাস খুবই কম, মাত্র ছয় লাখ মানুষের বসবাস।

দশ মিনিটের মধ্যেই আমরা চলে আসি রাইনের পাড়ে। গাড়ি পার্কিং করতে হলো বেশ খানিকটা দূরে। কারন

কয়েক বছর আগে পুরো নদীর পাড় জুড়ে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করেছে সিটি কর্পোরেশন। যাতে মানুষ পায়ে হেঁটে সাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারে। পুরো রাস্তায় মানুষের আনাগোনার পাশে বাইক  এবং স্ট্রোলার দিয়ে পূর্ণ।

নদীর পাশে ওল্ড টাউন। এখানে গড়ে উঠেছে নতুন মিডিয়া হারবার,যা মেডিয়ানহ্যাফেন নামে পরিচিত । মিডিয়া সংস্থাগুলি ছাড়াও রয়েছে ফ্যাশন এবং ডিজাইনের স্টুডিওগুলি। চোখে পড়ার মতন বেশ কিছু নামী দামী রেস্তোঁরা এবং বারও আছে।

রাইন নদীর তীরে পাকা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি আকর্ষণীয় আর্ট গ্যালারী কুনস্ট ইম টানেলের সামনে। অবাক বিস্ময়ে দেখি সম্পুর্ণ ইস্পাতের তৈরী ৫৬৫ ফুট উঁচু রিইনটর্ম, রাইন টাওয়ার নামে যার সমাধিক পরিচিতি। উপর হতে একনজরে দেখা যায় ডুসেলডর্ফ শহর এবং তার চারপাশের দৃশ্য। আরো অবাক বিস্ময়ে থ’ বনে যাই তিনটি বাঁকানো বিল্ডিং দেখে। মনে হচ্ছিল বিল্ডিং তিনটি এক্ষুনি ভুমিশয্যা নিতে যাচ্ছে।  কি অদ্ভুত বাঁকানো স্থাপত্য!

সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা রাইনের পাড় হতে চলে আসি ওল্ড টাউনের একটি বিয়ার কোম্পানিতে। সারা বিশ্ব জুড়ে জার্মান বিয়ারের খ্যাতি। হাসনাতভাইকে অনেক আগে ঢাকায় বলেছিলাম, যদি কখনো ডুসেলডর্ফ আসি, বিয়ার কোম্পানী ঘুরে দেখতে চাই। তিনি সেটা মনে রেখেছিলেন বলেই বিয়ার কোম্পানীতে নিয়ে যান এবং চাক্ষুষ দেখা হলো বিয়ার উৎপাদন প্রক্রিয়া। সেখানে টিউবওয়েলের নব ঘুরিয়ে গ্লাসের বড়  মগে তাজা বিয়ার নেয়া এবং পানের দারুন অভিজ্ঞতা হলো।

পরের দিন সকালে যাওয়া হলো ডুসেলডর্ফের অন্যতম জনপ্রিয় উদ্যান নর্ডপার্কে। নব্বই একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত পার্কটি ডুসেলডর্ফের বৃহত্তম পার্ক । লিলি গার্ডেন এবং জাপানি গার্ডেনের মতো থিমযুক্ত উদ্যান রয়েছে।  হর্স-টেমার্স ভাস্কর্য  এবং অ্যাকোয়াজু ল্যাববেক জাদুঘরও আছে।

সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে চমকে গেলাম। হাসনাতভাইয়ের প্রতিবেশীর বাড়ির সীমানায়, দরোজার সামনে নানানরকম কংকাল ও মুর্তি । কংকালের পাশে বড় বড় দু’চারটে পাকা কুমড়ো। আলো আঁধারে কংকাল দেখে ভয়ে আমার ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা। ছবির মতন এতো সুন্দর বাড়ির সামনে এসব কেন?

হাসনাতভাইয়ের বাড়ির সামনেও একই রকম দৃশ্য। ব্যাপারটি আসলে কি, জানার আগ্রহে জিগেস করি, কংকাল টংকাল এসব কেন ভাই?

ও, আজতো হ্যালোউইন।

হ্যালোউইন আবার কি? এর সাথে কংকালের কি সম্পর্ক?

আমার আগ্রহ ও বিস্ময় দেখে হাসনাতভাই হাসেন।

অপেক্ষা করেন, একটু পরই বিচিত্র পোষাকে, মুখে পেইন্টিং, হাতে ব্যাগ নিয়ে ছেলেমেয়েরা আসবে।

আমার অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হয় না। ৩/৪জন ছেলেমেয়ে হাসনাতভাইয়ের দরোজার সামনে দাঁড়ায়। তাদের প্রত্যেকের হাতেই ছোট কাপড়ের থলি বা ব্যাগ।কেয়াভাবী ও লামিসা বাচ্চাদের মুঠোভর্তি করে চকোলেট দেন।

বাচ্চাগুলো চকোলেট পেয়ে খুশি। তাদের কারো মুখে মুখোশ। কারো মুখে সাদা কালো রঙ লাগিয়ে ভুত সেঁজেছে। ওরা তাদের প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে।সবাই বাচ্চাভুতদের চকোলেট দিচ্ছে।

কিন্তু কেন, পুরো বিষয়টি জানার তীব্র কৌতুহল পেয়ে বসে। সেদিন রাতে ডিনার শেষে গুগল করে হ্যালোউইন সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি।

পশ্চিমা বিশ্বে হ্যালোউইন ( Halloween) সরকারী ছুটিরদিন। যা প্রতি বছর ৩১শে অক্টোবরে পালিত হয়। হ্যালোউইন উৎসব নানান রকম কর্মকাণ্ডের মধ্যে পালিত হয়। যেমন ট্রিক-অর-ট্রিট, ভূতের ট্যুর, বনফায়ার,বিচিত্র পোষাকের পার্টি, আধিভৌতিক স্থান ভ্রমণ, ভয়ের চলচ্চিত্র দেখে ভয় পাওয়া ইত্যাদি।

উৎসবের ঠিক দু’তিন দিন আগ থেকে মানুষজন মুখোশ পরা শুরু করে। বাসা থেকে বের হলেই নজরে পড়বে কোন না কোন জায়গায় অতি ভয়ংকর, আজব পোশাকে পরা কতগুলো ছেলে মেয়ে একসাথে বসে গল্প করছে অথবা হেঁটে যাচ্ছে। মুখতো ওদের দেখাই যাবে না। বরং মুখের উপর থাকবে জীব-জন্তুর মাস্ক, ভূতের মাস্ক।

যদ্দুর জানা যায়, আইরিশ ও স্কটিশ অভিবাসীরা ১৯শ শতকে এই ঐতিহ্য উত্তর আমেরিকাতে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলিও হ্যালোউইন উদযাপন করা শুরু করে। বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকগুলি দেশে হ্যালোউইন পালিত হয়, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,কানাডা , আয়ারল্যান্ড , পুয়ের্তো রিকো, এবং যুক্তরাজ্য। এছাড়া এশিয়ার জাপানে এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডেও হ্যালোউইন পালিত হয়।

ডুসেলডর্ফে আমার শেষের দিন ছিল খুবই ব্যস্ততার।একটি ঔষুধ কোম্পানীসহ ফর বাংলাদেশের সাথে  মিটিং ছিল। খুব সকালেই বাসা হতে বের হই। দশটার মধ্যে মিটিং শেষ করে হাসনাতভাইয়ের সাথে বেলা এগারোটায়  গিয়েছিলাম জার্মানের একটি বিখ্যাত ঔষুধ কোম্পানী পরিদর্শনে।  ফর বাংলাদেশের মাধ্যমে এরা মে মাসেই পাঁচটন ঔষুধ পাঠিয়েছিল, রানাপ্লাজার হতাহতদের জন্য। কোম্পানীর প্রোডাকশান ইনচার্জ ব্যক্তিটি হাসনাতভাই ও আমাকে পুরো ফ্যাক্টরি ঘুরিয়ে দেখান। বিশাল ফ্যাক্টরির সবকিছু হেঁটে দেখা অনেক কস্টের।তাই ফ্যাক্টরীর ভেতরে বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখতে আমাদের ছোট কার ব্যবহার করতে হয়।

ফেরার সময় প্রোড়াকশন ইনচার্জ বারবার বলছিলেন, ‘ আমরা সব সময় বাংলাদেশের মানুষের পাশে আছি, থাকবো।’

দুপুরে হাসনাতভাইয়ের বাসায় লাঞ্চ সেরে আমাকে ছুটতে হয় বার্লিনগামী ইউরো লাইনের বাস ধরার জন্য। জার্মানের ধনীর শহরে তিনটি দিন ব্যস্ততায় কিভাবে যে কেটে গেছে টেরও পাইনি।

- Advertisement -

Read More

Recent