শুক্রবার - মে ৩ - ২০২৪

গীতিকার নুরুজ্জামান শেখ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার লেখা তিশার গাওয়া একটি গানের স্মৃতি

 

বঙ্গবন্ধুর ছবি শিল্পী সব্যসাচী হাজরা

নুরুজ্জামান শেখ বিখ্যাত গীতিকার ছিলেন। বিটিভিতে প্রযোজনা সহযোগী হিশেবে কাজ করতেন ফিরোজ মাহমুদের সঙ্গে।(পরে প্রযোজক হয়েছিলেন।) তাঁর লেখা অনেক গান শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিলো। হাসিখুশি ছোটখাটো মানুষটি ছিলেন খুবই সহজ সরল। চমৎকার সুসম্পর্ক ছিলো আমার সঙ্গে।

- Advertisement -

প্রযোজক ফিরোজ মাহমুদ আমার কোনো অনুষ্ঠানের প্রযোজক না হলেও টিভি ভবনে তাঁর সঙ্গে আমার খুবই সদ্ভাব ছিলো। আমরা প্রচুর আড্ডা দিতাম তাঁর কক্ষে। আমরা মানে আমি ফিরোজ মাহমুদ আর নুরুজ্জামান শেখ।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে বিটিভি পর্দায় বঙ্গবন্ধু উদ্ভাসিত হলেন নতুন উদ্যমে নানান আঙ্গিকে। সেই সময়, এক দুপুরে টিভি ভবনে কাজী কাইউমের সহযোগী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আমার দেখা হলে তিনি বললেন–আরে রিটন ভাই আপ্নেরে কী খোঁজাটাই না খুঁজতাছে নুরুজ্জামান শেখ। চলেন তো আমার লগে!

দোতলায় ফিরোজ মাহমুদের কক্ষের কাছেই দেখা হলো নুরুজ্জামান শেখের সঙ্গে। আমাকে পেয়ে তিনি যেনো বা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার ফুরসত পেলেন। ফিরোজ মাহমুদের রুমে বসেই শুনলাম বৃত্তান্ত। বললেন তিনি–ছোটদের উপযোগী একটা গান দরকার বঙ্গবন্ধুরে নিয়া। তো আমি চেষ্টা কইরা দেখলাম কয়েকবার, কিন্তু কিছুতেই হয় না।

আমি খানিকটা বিস্মিত–হয় না মানে? আপনি মিয়া এতো বিখ্যাত গীতিকার, হয় না আবার কি?

তিনি হাসলেন–হয় না মানে হয় কিন্তু কিছুতেই ছোটদের উপযোগী হয় না। বড়দের হইয়া যায়। তখনই বুঝছি এইটা আপনে ছাড়া হইবো না। আমি আমার চিন্তাটা আপনেরে কইতাছি আপনে লেইখ্যা দ্যান।

–আমি তো অন্য কারো চিন্তা ধার নিয়া গান লিখুম না ভাইজান।

–ভুল বুইঝেন না। আমার চিন্তা ধার নেওনের কথা বলতে চাই নাই। আমি চাইতেছিলাম এমন একটা গান যে গানটা একটা ছোট্ট বাচ্চা গাইবো। যে বঙ্গবন্ধুরে কোনোদিন দেখে নাই। এইরকম সিকোয়েন্সের একটা গান আমারে লেইখ্যা দ্যান ভাই না ভালা…

আমি হেসে ফেললাম–তাইলে ঠিক আছে। হইয়া যাবে। কিন্তু গাইবে কে?

–আছে একজন শিশু শিল্পী। খুব গালো গায়। দেখলে আপনে চিনবেন। কাইলকাই দিয়েন ভাইজান। দুই দিন সময় নষ্ট করছি। হাতে সময় নাই একদম।

আমি হাসতে হাসতে বললাম–আইজকাই পাইবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাইবেন। আমি কাজের ফাঁকে লেইখ্যা ফালামুনে।

শুনে খুব খুশি হলেন নুরুজ্জামান শেখ।

কিন্তু কাজের ফাঁকে না। আমার নির্দিষ্ট কাজটি শুরুর আগেই ফিরোজ মাহমুদের কাছ থেকে এক খন্ড শাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে তাঁর সঙ্গে গরম চায়ের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে কথা বলতে বলতে লিখে ফেললাম গানটা– যাঁর প্রথম স্তবকটা ছিলো এরকম–‘তাঁকে আমি কাছে থেকে দেখিনি/শুধু তাঁর কথা আমি শুনেছি/বাংলাদেশের পাশে/বড় বড় অক্ষরে/ তাঁর নাম আমি লিখে রেখেছি/ সেই নাম প্রিয় নাম শেখ মুজিবর/বঙ্গবন্ধু তিনি শেখ মুজিবর’…।

আমার কাছে কোনো কপি না রেখেই সেটা আমি নুরুজ্জামান শেখের হাতে দিলে তিনি খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন প্রায়–কইছিলাম না ভাই আপনেই পারবেন!আপনে তো ভাই ম্যাজিক দেখাইলেন। বসলেন আর হইয়া গেলো!

ফিরোজ মাহমুদ উত্তেজিত–তরে আমি কী কইছিলাম? কইছিলাম না রিটনরে ধর। এইডা হেরই কাম, তর না।

নুরুজ্জামান শেখকে আমি বললাম, যাক তাইলে হইছে?

তিনি বললেন–হইছে মানে? আরে এইটাই তো চাইতেছিলাম কিন্তু হইতেছিলো না।

এরপর গানটা কে গেয়েছিলো আর কোথায় প্রচার হয়েছিলো কিংবা আদৌ প্রচার হয়েছিলো কি না তা আর জানা হয়নি আমার। তাছাড়া আমি ভুলেও গেলাম গানটার কথা। কারণবিটিভি ভবনে বসে ছোটদের বড়দের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্যে এরকম বহু গান আমি লিখে দিয়েছি তাৎক্ষণিকভাবে। যে গানগুলোর কোনো নমুনা বা চিহ্ন আমি রাখিনি কোথাও। এমন কি শুনিও নি। (রেডিও এবং টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ গীতিকারদের সম্মানী দেয়ার ক্ষেত্রে প্রায় ভিক্ষা দেয়ার একটা ব্যবস্থা কার্যকর রেখেছিলো বলে প্রতিবাদে বিটিভির এনলিস্টেড গীতিকারও হইনি আমি। বিপুল সংখ্যক গান প্রচার হবার পরেও একটা টাকাও নিইনি আমি, সম্মানীর অংকটা এতোই অসম্মানজনক ছিলো।)

এরপর সময় গড়ালো।

স্যাটেলাইট টিভি হিশেবে যাত্রা শুরু করলো চ্যানেল আই ১৯৯৯ সালে। ২০০০ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ০১ থেকে ১৫ আগস্ট পনেরো দিনব্যাপি অনুষ্ঠানমালার পরিকল্পনা করলো চ্যানেল আই। সিদ্ধান্ত হলো একদিন একটা ছোটদের অনুষ্ঠান করবো আমি।

সেই সময় আমাকে খুঁজে বের করলো আনোয়ার। কাজী কাইউমের সহকারী সেই আনোয়ার চ্যানেল আই সিদ্ধেশ্বরী অফিসে আমাকে পাকড়াও করে বললো–ভাই আপনে চ্যানেল আইতে বঙ্গবন্ধুরে নিয়া ছোটদের অনুষ্ঠানটা করতেছেন। সেই অনুষ্ঠানে আপনের লেখা গানটা দিবেন নি? অইযে নূরুজ্জামান শেখরে দিসিলেন, যেইটা শিশুশিল্পী তিশা গাইছিলো। সেই গানের স্পুল আর এডিটেড ভিডিও রেকর্ডটা আছে আমার কাছে। দিমু নি? খুব সময় নিয়া সুন্দর কইরা বানাইসিলাম গানটা। আপনের পছন্দ হইবো।

–আরে মিয়া দিবেন মানে! জলদি লইয়া আসেন।

গানটা নিয়ে এলো আনোয়ার। গানের চিত্রায়নটা পছন্দ হবার মতোই।

চ্যানেল আইয়ের সিদ্ধেশ্বরীর খুবই ছোট্ট একটা স্টুডিওতে আমার উপস্থাপনায় ছোটদের অনুষ্ঠানটা ধারণ করা হয়েছিলো। আমারলেখা ‘সোনার ছেলে খোকা’ বইয়ের ছড়াটা আমি পাঠ করলাম। আমার কণ্ঠকে নেপথ্যে রেখে বইটিতে মুদ্রিত শিল্পী হাশেম খানের আঁকা চাররঙের দুর্দান্তছবিগুলো একের পর এক ইনসার্ট করে করে দারুণ একটা বিষয় দাঁড়ালো। এক পর্যায়ে যুক্ত করলাম শিশুশিল্পী তিশার গাওয়া গানটাও। গানের সুরকার কে ছিলেন সেটা আমি নিশ্চিত নই। সেন্টু হবার সম্ভাবনা। আনোয়ারও এ ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলতে পারলো না। তবে সুর সংযোজন খুব চমৎকার ছিলো নিঃসন্দেহে। আর তিশা গেয়েওছিলো চমৎকার।

সেদিনের ছোট্ট তিশা আজকে অনেক বিখ্যাত অভিনয়শিল্পী, আমাদের দেশের। অনেক শুভকামনা ওর জন্যে। আর বঙ্গবন্ধুর গান গাওয়ার কারণে তিশার প্রতি বাড়তি কিছু মমতা তো আমার থাকবেই।

বন্ধু গীতিকার নূরুজ্জামান শেখের কথা মনে পড়ছিলো খুব। প্রযোজক ফিরোজ মাহমুদকে তাই কল দিয়েছিলাম। অনেক কথা বললাম আমরা নূরুজ্জামান শেখকে নিয়ে। তাঁর অকাল প্রয়াণ নিয়ে। তাঁর যাপিত জীবন নিয়ে। তাঁকে নিয়ে কথা বলতে বলতেই এক পর্যায়ে এলো আমার লেখা গানটার প্রসঙ্গ। এরপর কথা বললাম বন্ধু আনোয়ারের সঙ্গেও।

একটি ঘটনার সঙ্গে কতো ঘটনাই না জড়িয়ে থাকে!

কতো গল্প থাকে এক জীবনে!

কতো গল্প থাকে একটি গল্পের পেছনে!

আমাদের জীবনটা সেই সব ছোট ছোট গল্পেরই সংকলন।

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent