শনিবার - জুলাই ২৭ - ২০২৪

দেরি না করে ৯১১ এ কল দিলাম

খারাপ কিছু একটা যদি শিওর হওয়া যেত তবে আমি এক্ষুনি ৯১১ এ কল দিয়ে সাহায্য চাইতাম

একটা ইউনিট পরিদর্শন শেষে করিডোর দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আরেক ইউনিটের দরজা প্রায় ইঞ্চি পাঁচেকের মতো খোলা। ওটা পেরিয়ে কিছুক্ষন এগোনোর পর কিছু একটা সন্দেহ হতে থেমে গিয়ে আবার ব্যাক করে এসে দরজার ফাঁকা অংশ দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি একজন মানুষের মাথার পেছনের অংশ দেখা যাচ্ছে। মাথাটা দরজার চৌকাঠের ফাঁকা অংশের সাথে স্পর্শ করে আছে, মেঝের ওপর উপুড় হওয়া।

সন্দেহ হলো এটা কি রাবারের কোনো পুতুল? কানাডিয়ানরা আবার ভয়ংকর রসিক। হ্যালোইনে রাবারের রক্তাক্ত হাত গাড়ির পেছনে ঝুলিয়ে রাস্তার মানুষকে ভয় দেখায়। অনেকসময় রক্তাক্ত অন্ডকোষ ঝুলিয়ে রাখে। এভাবে আশপাশের এপার্টমেন্টের মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে না তো? দরজা যাতে সামান্য খোলা থাকে, সেজন্য একটা জুতো দেয়া চৌকাঠ আর দরজার মাঝে।

- Advertisement -

আমি সাবধানে আস্তে কয়েকবার ডাকলাম। কারণ ঘুমাতেও পারে। অনেকসময় এরা বাতাস চলাচলের জন্য এভাবে জুতো, স্যান্ডেল দিয়ে দরজা খোলা রাখে। দরজাটা আবার ভেতর থেকে একটা চেইন দিয়ে আটকানো; তাই ঠেললেও ইঞ্চি ছ’য়েকের বেশি খুলছে না। এসব চেইন বাইরে থেকে হাত ঢুকিয়ে কোনোভাবেই খোলা যায় না।

উপুড় হয়ে শোয়া বৃদ্ধ মানুষটার শুধু মাথা আর ঘাড় দেখা যাচ্ছে। কোনো নড়াচড়া নেই। বুঝবার উপায় নাই সে নি:শ্বাস নিচ্ছে, কি না। মাথায় পাতলা সাদা কিছু চুল। ঘাড়ের চামড়া কুঁচকানো। ডাক দিলাম, দরজা ধাক্কাধাক্কিও করলাম। কিন্তু সাড়া নাই।
আমি কনফিউজড হয়ে তিনটা ভিন্ন এঙ্গেলে ছবি তুলে রাখলাম মোবাইলে। নিচে পার্ক করা গাড়িতে গিয়ে বসলাম। শিওর না হয়ে প্যারামেডিক্স কিংবা পুলিশকে কীভাবে কল দিব? এমন হতে পারে গরমের কারণে দরজা খুলে ঘুমাচ্ছে? তাছাড়া বৃদ্ধ বয়সে অনেককেই দেখেছি মরার মতো ঘুমাতে, হাজার ডাকলেও উঠে না। আমি পূর্বেও নিজে ক’একবার, কয়েকটা ইউনিটের দরজা নক করে সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে দেখি কেউ বিছানায় ঘুমাচ্ছে। কাছে গিয়ে ডেকেছি; তবুও ঘুম ভাঙেনি। আর বেশি ডিস্টার্ব করিনি। তাদের বুক উঠানামা করছিলো বিধায় চিন্তার কিছু ছিল না।

খারাপ কিছু একটা যদি শিওর হওয়া যেত, তবে আমি এক্ষুনি ৯১১ এ কল দিয়ে সাহায্য চাইতাম। আবার তার গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা-ধাক্কি করতেও ভয় লাগছিল, কারণ যদি অস্বাভাবিক কোনো মৃত্যু-ট্রিত্যু হয়ে থাকে, তখন ফরেনসিক এভিডেন্স এর প্রয়োজন থাকবে। আমার হাতের ছাপ দেয়াটা কী ঠিক হবে?

মনের মাঝে খচ খচ করতে লাগলো। আরেকবার ফিরে গিয়ে আরও জোরে দরজা ধাক্কালাম, চিৎকার দিলাম। না, কোনো সাড়াশব্দ নেই। ঘটনা সুবিধার নয়!

দেরি না করে ৯১১ এ কল দিলাম।

তারা শুনে বলল- আচ্ছা, আমরা এম্বুলেন্স পাঠাচ্ছি, পুলিশও যাচ্ছে।

আমার সুইপারভাইজারকে ঘটনা বলতেই উনি বললেন, তুমি ওখানেই থাকো; যতক্ষন লাগে। পুলিশ আসলে তারপর স্থান ত্যাগ করবা, আমাকে আপডেট করবা।

আমি গাড়ির মধ্যে মিনিট দশেক পুলিশ আর প্যারামেডিক্স এর অপেক্ষায় থাকার পর ইমারজেন্সী রেস্পন্স থেকে ফোন- শোনো, আমাদের সব ইউনিটগুলো ব্যস্ত। আমরা আরেক পেশেন্টের কাছে আছি, পনেরো মিনিট লেইট হতে পারে।
কী সর্বনাশ! ইমার্জেন্সিতে আজ এ অবস্থা!

দুটো পুলিশ গাড়ি আসলো আরও মিনিট পাঁচেক পর। আমি তাদের বিল্ডিঙের প্রধান ফটক খুলে দিয়ে পেছন পেছন গেলাম। পুলিশও কনফিউজড, অনেক্ষন ধরে ডাকাডাকি করলো। তারপর হাত ঢুকিয়ে চেন খোলার চেষ্টা করতে লাগলো। ডাকাডাকি, ধাক্কাধাক্কির পর হতাশ হয়ে কিছু একটা দিয়ে দরজা খুলে বডিটাকে মেঝেতে ঠেলে ভেতরে গিয়ে পালস চেক করতে লাগলো। এ অবস্থায় প্যারামেডিক্স এর লোকজনও এসে হাজির। তাদের লক্ষ্য করে পুলিশ বলল, তাড়াহুড়ার কিছু নেই..।

বুঝলাম, সব শেষ!

একজন অতীব সুন্দরী মহিলা পুলিশ জিজ্ঞাসা করলো, তুমি এসে কেমন দেখেছিল?

– আপনারা যেরকম এসে দেখেছেন, ঠিক সেরকম।

আমি টেকনিক্যালি সংক্ষেপে উত্তর দিচ্ছিলাম। মোবাইলে তোলা ছবিগুলো তারা নিলো। আমার আইডি চেক করে, ফোন নাম্বার আর যাবতীয় তথ্য নিয়ে বলল- আচ্ছা, তুমি যেতে পারো।

সুপারভাইজারের পরামর্শে আমাদের হাউজিঙ অফিসের নিজস্ব সিকিউরিটির লোকজন না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। লোকটা কি শেষ পর্যন্ত চেস্টা করেছিল বাঁচবার জন্য? দরজা পর্যন্ত এসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল?

এরকম আসলে কানাডাতে খুব কমন।

শেষ বয়সে অনেক মানুষ হয়ে পড়েন খুব একা। একদম অচল হয়ে গেলেও কেউ দেখতে আসে না। সবাই নিজ কাজে ব্যস্ত। হয়তো দিনে একবার করে PSW [পার্সোনাল সাপোর্ট ওয়ার্কার] আসেন, কিংবা কয়েকদিন পরপর, যখন প্রয়োজন। হাউজিঙ এর অনেক কলিগের কাছে শুনেছি এরকম অভিজ্ঞতার কথা; তারা চাবি দিয়ে রুম ইন্সপেকশনে গিয়ে দেখে গলিত লাশ, শরীরে পোকার লার্ভা কিলবিল করছে।

দেশটা উন্নত হলেও এই একাকিত্ব শেষ বয়সে খুব অসহায় করে ফেলে। আমাদের বাংলাদেশর মতো অনুন্নত দেশগুলোতে এখনও মানুষের মাঝে মায়ার বন্ধন দৃঢ়। এদের যে বন্ধনে দৃঢ়তা নেই, তা বলছি না। সমস্যা হলো এদের পরিবারের মধ্যে যৌথভাবে থাকার ব্যাপারটা খুব কম। আবার অনেকের সত্যি কেউ নেই!

এসব দেখে খুব চিন্তা লাগে। আমাদের পরিণতিও কি এমনটাই হবে? বাচ্চা কাচ্চারা হয়তো অন্য প্রভিন্স কিংবা আমেরিকাতে কোনো আকর্ষণীয় বেতনের চাকরি নিয়ে চলে যাবে? সে সম্ভাবনা ৮০%! তখন আমাকে, আমাদের কারা দেখবে? PSW?
সব দেশের সমাজ ব্যবস্থায়ই ভালো-মন্দ দিক আছে। যারা প্রবাসে থাকেন, তারা দয়া করে সবার সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখবেন। মানুষ মানুষেরই জন্য।

মহান সৃষ্টিকর্তা যেন সবাইকে সম্মান দিয়ে শেষ বয়সে নিজের কাছে টেনে নেন।

- Advertisement -

Read More

Recent