রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী

১৯৯৯ সালের ১ নভেম্বর আমেরিকার বহুলখ্যাত পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি মাঝারি সাইজের সংবাদ প্রকাশিত হয়। সে বছরের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় ৯৫ বছর বয়সে একজন হিন্দু পণ্ডিতের মৃত্যু নিয়ে এই সংবাদ। শিরোনাম ছিল, ‘মহানামব্রত ব্রহ্মচারী ইজ ডেড অ্যাট নাইনটিফাইভ’। পত্রিকাটির অনলাইন সংস্করণে সে-সংবাদটি বর্তমান লেখককে বিচলিত করে। কোনো বাঙালির মৃত্যু নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকাটিতে এতবড়ো সংবাদ সেই বিচলনের কারণ।

- Advertisement -

মহানামব্রত একজন ব্রহ্মচারী বাবাজি। গেরুয়া তাঁর পোশাক। সজ্জা তাঁর তিলক। তিনি ধর্মপ্রচারক। সকল কথা, সকল লেখা এমনকি গবেষণাতেও বৈষ্ণবধর্ম তাঁর প্রধান আশ্রয়। জীবন-আচারে, জীবন-যাপনে এতবেশি ধর্মীয় মানুষকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ না করলেও পছন্দ করতে পারি না। আমার ব্যক্তিগত এই মনোভাবটির পরিবর্তন ঘটলো ২০১৯ সালে। ২৫ ডিসেম্বর মহনামব্রতের জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রতিবারের মতো তাঁর শীষ্য  ও অনুরাগীরা টরেন্টোর বাংলাদেশ-কানাডা হিন্দু মন্দিরে অনাড়ম্বর এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। কিছু বলার জন্য আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো।

যেমনটি আমার ধরন – সেবারও তার কোনো ব্যত্যয় ঘটলো না। ভাবতে শুরু করলাম মহানামব্রত ব্রহ্মচারীকে (১৯০৪-১৯৯৯) নিয়ে। নতুন কী উপস্থাপন করা যায়। সামান্য গভীরে যেতেই আবিষ্কার করে ফেললাম কম-বলা এক তথ্য। বুঝে ফেললাম সবাই যে বলেন স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬৩-১৯০২) পর পার্লামেন্টে অব ওয়ার্ল্ড রিলেজিয়নস-এ দ্বিতীয় যে বাঙালি বক্তা ইনি হলেন মহানামব্রত সেটি তো গোজামিল দেয়া একটি তথ্য। কেননা বিবেকানন্দ যে ধর্মসভায় যোগদান করেছিলেন ১৮৯৩ সালে সেটি ছিল পার্লামেন্ট অব ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস। আর মহানামব্রত যেটিতে যোগ দেন ১৯৩৩ সালে সেটি হলো, ওয়ার্ল্ড ফেলোশিপ অব ফেইথস। তবে দুটি ধর্মসভাই আমেরিকার শিকাগো শহরে হবার কারণে আমাদের মধ্যে তথ্যগত ভিন্নতা কম চোখে পড়ে। চোখে না পড়ার আরও একটি যে কারণ সেটি হলো, বিবেকানন্দ যেমন তাঁর বক্তৃতাতে রীতিমত সাড়া জাগিয়ে দিয়েছিলেন, মহানামব্রত কিন্তু কম যাননি।

তবে এটি সত্য যে ১৯৩৩ সালের সম্মেলনটি ছিল ধর্ম নিয়ে এমন বৈশ্বিক আয়োজনের দ্বিতীয়টি। অন্য আরও যে একটি সত্য আমাদের জানা প্রয়োজন সেটি হল  পার্লামেন্ট অব ওয়ার্ল্ড রিলিজিয়নস-এর দ্বিতীয় আয়োজনটি হয়েছিল ওই শিকাগো শহরেই ১৯৯৩ সালে – অর্থাৎ এক শ বছর পরে। আরও জানিয়ে রাখা যেতে পারে যে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে ওই শিকাগোতেই পার্লামেন্টে অব ওয়ার্ল্ড রিলেজিয়নস-এর নবম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

তবে একটা বিষয় খেয়াল করতে শুরু করলাম যে, বিবেকানন্দের বক্তৃতা যত সহজলভ্য মহানামব্রতেরগুলো তেমনটি নয়। প্রবাসে তো একেবারেই নয়। কিন্তু আমার গবেষণাকর্মে যেমনটি প্রায়শ ঘটে থাকে এক্ষেত্রেও বিশেষ ভিন্নতা ঘটলো না। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম সেই বই, যেটিতে মহানামব্রতের দেওয়া চারটি বক্তৃতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। হাজার পৃষ্ঠার বিপুল আয়তনের সেই গ্রন্থটি ১৯৩৩ সালে অনুষ্ঠিত ধর্মসম্মেলনের পুরো চিত্রটি আমার সামনে তুলে দিল। তখন পর্যন্ত মহানামব্রত ব্রহ্মচারীকে নিয়ে আমার ঔৎসুক তৈরি হয়নি। কেননা ধর্মসভায় দেয়া বক্তৃতাগুলো আমাকে আপ্লুত করতে পারেনি। কিন্তু একটি বিষয় আমাকে চমৎকৃত করলো। যখন জানলাম মাত্র পাঁচ বছর আট মাস সময়ে মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মোট ৪৭৬টি বক্তৃতা করেন। ১৯৩৮ সালে ‘কোস্ট টু কোস্ট লেকচার টুর’-এই তিনি বক্তৃতা করেছিলেন ৩৫৪টি। ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাড়াও ৬৩টি শহরে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন সেবার। আমেরিকা ও কানাডার বিভিন্ন শহরে বক্তৃতা দিয়েছেন।

এ তথ্যটি চমৎকৃত হবার মতো এ কারণে যে, ত্রিশের কোঠায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ যিনি জীবনে প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে এসেছিলেন, তিনি এতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সুধী সমাবেশে কী এমন বক্তৃতা করতে পারেন ভেবে। কী ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্যে সেটা ভেবে বিচলন আসে আমার। নিশ্চয়ই তাঁর বাগ্মিতার কৌশল ছিল অভিনব নইলে তিনি শত শত বক্তৃতা দিলেন কীভাবে? আয়োজকরা তাঁকে ডাকল কেন? তিনি তো উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিদের উদ্দেশে বক্তৃতা করেননি। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভের পর পুরো ১৯৩৮ জুড়ে উত্তর আমেরিকার দূর দূর শহরে তাঁর বক্তৃতার এমন সুযোগ কীভাবে হলো! কিন্তু মর্মাহত বোধ করতে শুরু করলাম এটা ভেবে যে, তাঁর বক্তৃতার অনুলিপিগুলো কোথাও সংগ্রহ করা হয়নি।

ফরিদপুরের ক্ষীণ তনু এই ধর্মযাজককে নিয়ে আমার আগ্রহ অন্যান্য কাজের চাপে থেমে গেলেও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। না যাবার কারণ, ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন গীতা নিয়ে আমার আগ্রহের উল্লম্ফন, তখন গীতার বিপুল সংখ্যক ইংরেজ অনুবাদ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে আমার হাতে আসে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জীবগোস্বামীর দর্শনের উপর পিএইচডি করা মহনামব্রতের ‘গীতা ধ্যান’নামের গ্রন্থটি। সেটির কিছু কিছু জায়গা আমাকে গেরুয়া-পরা এক লেখকের আড়ালে আধুনিকতা ও বৈজ্ঞানিকতার একটি উঁকি সামনে নিয়ে আসে।

গৌরীয় বৈষ্ণব ধারার যে কোনও ভক্তের সাথে কথা হলেই তাঁকে মহানামব্রত ব্রহ্মচারীকে নিয়ে উচ্ছসিত হতে দেখি। তাঁর বক্তৃতা যারা শুনেছেন তাঁদেরকে দেখি মানুষটির পাণ্ডিত্য নিয়ে সগর্বে কথা বলতে। কিন্তু এ প্রশ্ন অবান্তর নয় যে, কেন এত পাণ্ডিত্যের অধিকারী মানুষটির খবর সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছল না। পেছনের কারণ কি শুধু এই যে, ধর্মপ্রচারের যে আশ্রয় সেই আঙিনা ও মহানাম স্থানগুলো থেকেই তাঁর অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয়েছিল?

এবং এমন সময় আমি আবিষ্কার করি সেই উনিশ শ ত্রিশের দশকে মহানামব্রতের আমেরিকা ভ্রমণের সময় তিনি  সক্ষম হয়েছিলেন অন্তত একজন দেশখ্যাত খ্রিস্টান ধর্মবেত্তা এবং একজন আধুনিক আমেরিকান কবিকে প্রভাবিত করতে। ১৮৯৩ সালে পার্লামেন্ট অব ওয়ার্ল্ড রিলিজিওনসের ভেতর দিয়ে বহু ধর্মের মধ্যে সংলাপের যে সূত্র ঘটেছিল, যেটির নতুন রূপ আমরা দেখেছিলাম ১৯০০ সালে ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর রিলিজিয়াস ফ্রিডম বা আইএআরএফ প্রতিষ্ঠার ভেতরে, সেটি যখন ১৯৩৩ সালে ফেলোশিপ অব ফেইথস নামে নতুনভাবে বিকশিত হয় এবং ১৯৩৬ সালে লন্ডনে আরেকটি ধর্ম সম্মেলন করে, তখন মহানামব্রত ব্রহ্মচারী সেই সংগঠনের আন্তর্জাতিক সাধারণ সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং সূচারুরূপে দায়িত্ব পালন করেন। এই প্রসঙ্গে আরও যে তথ্যটি বিশেষ উল্লেখের সেটি হলো মহানামব্রত ব্রহ্মচারী যে ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিতে সুদূর ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকা এসেছিলেন সেই সংগঠনের প্রধান দুই কর্তাব্যক্তির একজন ছিলেন বাঙালি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে বদ্ধপরিকর সেই বাঙ্গালির প্রচেষ্টাতেই আধুনিককালের ‘ইন্টারফেইথ ডায়ালগ’-এর সুচনা।

এভাবেই সর্বধর্ম সংলাপের যে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত সেখানে জড়িয়ে আছে বাঙালিদের নাম যাঁদের স্বল্প কয়েকজনের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন হলেন মহানামব্রত ব্রহ্মচারী। আগামী ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কৃতীসন্তান মহানাম্ব্রত ব্রহ্মচারীর ১১৯তম জন্মদিন। উত্তর আমেরিকাজয়ী দার্শনিক এই বাঙালি ধর্মবেত্তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

- Advertisement -

Read More

Recent