রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার

ছবিন্যাথানিয়েল বোম্যান

পশ্চিমা দেশে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের বিষয়টি এখন অনেকটা ‘মিথ’-এ পরিণত হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো মানবাধিকার হরণ সংক্রান্ত ঘটনাগুলো শুধু প্রাচ্যের এবং আফ্রিকার কিছু দেশেই ঘটছে। কিন্তু যতই পৃথিবী বিশ্বায়নের দিকে এগিয়ে চলছে ততই বাড়ছে এইসব অন্তর্নিহিত সংঘাত। নিরাপত্তার নামে যে পর্যায়ে তল্লাশি চলছে তা যে কেবল আপত্তিকর এবং অপমানজনক শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে হাস্যকরও বটে।
২০১২ সালের এপ্রিল মাসে বলিউড তারকা শাহরুখ খানকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী সন্দেহে আটক করা হয়। টানা দুইঘণ্টা চলে জিজ্ঞাসাবাদ। শাহরুখ মার্কিন দেশে গিয়েছিলেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট সমাবর্তনে তাঁর বক্তৃতা দেয়ার কথা। কিন্তু এয়ারপোর্টে আটকে পড়ায় নির্ধারিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনঘণ্টা দেরী হয়। শাহরুখ খানকে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের নিরাপত্তা কর্মীদের বেষ্টনী থেকে মুক্ত করার জন্য ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ করতে হয়। শাহরুখ নামকরা সেলিব্রেটি বলেই ঘটনাটা প্রকাশ পেয়েছে। এরকম অনেকেই আছেন যারা নিরাপত্তার নামে হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং অন্তরালে রয়ে গেছেন। ভারতের নামকরা অভিনেতা ইরফান খানকে চতুর্থবারের মত সন্ত্রাসী সন্দেহে মার্কিন বিমানবন্দরে আটক করা হলে তিনি অত্যন্ত ক্ষেপে যান এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
প্রখ্যাত কবি ও লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই প্রসংগে লিখেছেন-‘মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা নামে অধিকারটা আজকাল সব বিমানবন্দরে এসে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। কোনো প্রশ্ন করার উপায় নেই। নিরাপত্তার নামে যখন তখন সারা গায়ে চাপড় মারবে, একই জায়গায় দু-তিনবার বাক্স-প্যাঁটরা খুলতে বলবে, ঘাটাঘাটি করবে, দাড়ি কামাবার পাউচটা তুলে জিজ্ঞেস করবে, এটা কি? পাসপোর্টটা এহাত থেকে ওহাত ঘুরবে, তা নিয়ে চলবে ফিসফাস। প্রশ্ন করলেই যাত্রা বাতিল করে দেবার ক্ষমতা আছে বিমান বন্দর কর্মীদের। যদিও হাইজ্যাকাররা বোমা পিস্তল নিয়ে ঠিকই উঠে পড়ে’।
পশ্চিমা সভ্যতা নিয়ে আমরা যত হৈ চৈ করি না কেন একটু গভীরে গেলেই বোঝা যাবে তার অন্তসারশূন্যতা। এরিক গার্নার জীবিকার জন্য ১৭ জুলাই নিউইয়র্কে স্ট্যাটন আইল্যান্ডের বে স্ট্রিটে বিকেল বেলা খোলা সিগারেট বিক্রি করছিলেন। অকস্মাত চারজন পুলিশ অফিসার তাকে ঘিরে ধরলো। পেছন থেকে অফিসার ডেনিয়েল পেন্টালিও তার গলা চেপে ধরলো। সামনে থেকে অফিসার ডোমিকো বেঁধে ফেললো তার হাত। শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় এরিক গার্নার এগার বার উচ্চারণ করেছিল যে, সে শ্বাস নিতে পারছে না। নির্দয় পুলিশ অফিসারদের কর্ণগুহরে সেই করুণ আকুতি মিনতি কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এরিক। সামান্য সিগারেট বিক্রির অপরাধে মৃত্যুদÐ। লঘুপাপে গুরুদÐ। চিকিৎসকরা একে হত্যাকাÐ বলে বর্ণনা করলেও গ্রান্ডজুরির বিচারে তা গুরুত্ব পায়নি। ৩রা ডিসেম্বর গ্রান্ডজুরি পুলিশ অফিসারদের অভিযুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মার্কিন জনগণ এই রায় মেনে নিতে পারেনি। নিউইয়র্কে এবং আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ।
মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের ফার্গুসন শহরে গত ৯ আগস্ট একটি শপিং মলের সামনে পুলিশ অফিসার ড্যারেন উইলসন ১৮ বছর বয়সী নিরস্ত্র মাইকেল ব্রাউনকে গুলি করে হত্যা করে। গত ২০ নভেম্বর গ্রান্ডজুরি উইলসনকে অভিযুক্ত না করার সিদ্ধান্ত নেন। আরো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ড শহরে। মাত্র ১২ বছর বয়সী তামির রাইসের হাতে খেলনা পিস্তল দেখে পুলিশ অফিসার টিমোথি লোম্যান পরপর দুটি গুলি করে। পরের দিন শিশুটি নিহত হয়।
এই তিনটি ঘটনা নিয়ে জনমনে অসন্তোষ ও গণপ্রতিবাদ হলেও এগুলো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব ঘটনার মধ্যে একটি যোগসূত্র বা মিল রয়েছে। সেটা হল প্রতিটি ক্ষেত্রে পুলিশ অফিসার শেতাঙ্গ এবং নিহত ব্যক্তিটি কৃষ্ণাঙ্গ। বিষয়টি দুইভাবে দেখা যায়। এক. এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে কালো ব্যক্তি মানেই সম্ভাব্য অপরাধী, দুই. বর্ণ বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ। ঘটনা যাই হোক না কেন মানবাধিকার যে পদদলিত হচ্ছে সে কথা না বললেও চলে। আরেকটি বিষয় হল কৃষ্ণাঙ্গ এবং সংখ্যালঘু বর্ণের মানুষরা আইনশৃংখলা বাহিনীর উপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে। এমনকি বিচার ব্যবস্থাও তাদের স্বার্থকে সুরক্ষা করছে কিনা সে ব্যাপারে প্রশ্ন জেগেছে।
কিন্তু মানবাধিকারের প্রাথমিক শর্তই হল ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা করা। কিন্তু নিরাপত্তা রক্ষার নাম করে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে রীতিমতো লোপাট করা হয়েছে। ব্যক্তির যে নিজস্ব কিছু অধিকার রয়েছে তা আজ ধূলায় লুন্ঠিত। নিরাপত্তার খাতিরে ব্যক্তির শালীনতা হরণ করা হচ্ছে। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিরাপত্তা রক্ষার নাম করে ব্যক্তির টেলিফোনে আড়িপাতা হয়, এয়ারপোর্ট বা বিবিধ চেক পোস্টে মানুষের শালীনতা হরণ করা হয়, সেই গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কিভাবে মানবাধিকার রক্ষা হবে?
প্রাইভেসি ভারসেস সিকিউরিটি, এই বিতর্কে আমি যাবো না। যেটি সত্য তা হলো এখন সন্ত্রাসী প্রতিরোধের নামে আরোপিত হয়েছে নানা প্রকার নিয়ন্ত্রণবিধি। ২০০১ সালের ১৩ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রিয়ট আইন পাশ হল। এই আইনে প্রশাসনকে অধিকার দেয়া হল টেলিফোন, কম্পিউটার এবং অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করার। এফবিআইকে অধিকার দেয়া হল সন্ত্রাসের সন্দেহে কোনো প্রচার পত্রিকা, বুক স্টোর থেকে কেনা বই, রেকর্ড, সিডি এসব কেড়ে নেয়া বা বায়েজাপ্ত করার। নিরাপত্তার অজুহাতে মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা লোপাট হয়ে গেল। গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নেমে এলো বিবিধ নিয়ন্ত্রণ বিধি। মার্কিন মুল্লুক পরিণত হল এক আতংকপুরীতে। তাহলে হিউম্যান রাইটসের ক্ষেত্রে প্রাচ্যের পশ্চাৎপদ দেশের সাথে আমেরিকার পার্থক্য রইলো কোথায়?
স¤প্রতি জার্মানির চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মার্কেল মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামাকে ফোন করে জানতে চান যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ) কেন তার ব্যক্তিগত ফোনে আড়ি পেতেছে? সঙ্গত কারণেই ওবামা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এই যদি হয় পশ্চিমা দেশের দুই শক্তিধর রাষ্ট্র প্রধানের কথপোকথন ও জবাবদিহিতার নমুনা, তো বাকীদের অবস্থা কি তা সহজেই অনুমেয়।
এই টেলিফোনে আড়িপাতার বিষয়কে কেন্দ্র করে বিশ্বকে সতর্ক করার জন্য বংশিবাদকের কাজটি করেছেন এডওয়ার্ড। নিরাপত্তার নাম করে মার্কিন নাগরিকদের ই-মেইল ও ফোনে আড়িপাতার খবর ফাঁস করার জন্য স্নোডেনকে অভিযুক্ত করে মার্কিন প্রশাসন।
যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ প্রিজম নামে একটি গোপন প্রকল্প শুরু করে। এই প্রকল্পের কাজ হল জনগণের ব্যক্তিগত কথোপকথনে আড়ি পাতা। সাবেক এনএসএ কর্মী এডওয়ার্ড বিবেকের তাড়ণায় এ তথ্য ফাঁস করে দেন। স্নোডেন বলেন, প্রতিনিয়ত কংগ্রেস তথা মার্কিন জনগণকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন উধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা। স¤প্রতি ওয়াশিংটন পোস্ট ও গার্ডিয়ানের কাছে এনএসএর গোপন প্রকল্পটির বিস্তারিত তথ্য সংবলিত নথি তুলে দেন স্নোডেন। তিনি জানান, ২০১৩ সালের মার্চে কংগ্রেসের এক শুনানিতে ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সির পরিচালক জেমস ক্লাপার জানান, মার্কিন জনগণের ওপর কোনো ধরনের নজরদারি চালানো হচ্ছে না। স্নোডেন বলেন, শপথ নিয়ে জনগণের কাছে এরকম নির্জলা মিথ্যা বলা দেখে বুঝতে পেয়েছিলাম যে, গণতন্ত্র তার পথ হারিয়েছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা আজ বিপর্যস্ত।
নাগরিকদের বেডরুমে যদি সরকার নজরদারি করে তাহলে ব্যক্তির শালীনতা বলে আর কিছু থাকবে না। আমরা ফিরে যাব সেই জঙ্গল বা গুহামানবের অসভ্য জগতে। ব্যক্তির টেলিফোনে আড়িপেতে যদি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা করতে হয় তবে সেই সরকারের গ্রহণ যোগ্যতা হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
অতি স¤প্রতি ৩২টি দেশের সংবাদপত্রের সম্পাদকগণ এবং ৮৩টি দেশের ৫৬০ জন লেখক (বেশ কয়েকজন নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত) একত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যক্তির ওপর নজরদারীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তারা জাতিসংঘের কাছে আহবান জানিয়েছেন যে, আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে নজরদারীর বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষা করা হোক।
প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারী করে ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ অপরাধের সামিল। কোনো ব্যক্তিই রাষ্ট্রীয় নজরদারীর মধ্যে থেকে স্বস্তি পেতে পারে না, তেমনি কোনো সমাজও রাষ্ট্রীয় নজরদারীর অধীনে থেকে গণতন্ত্রকামী হতে পারে না।
অভিযোগ উঠেছে, প্রযুক্তির সহায়তায় নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে বাণিজ্য করছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। আজকের এই ডিজিটাল যুগে নাগরিক স্বাধীনতা লংঘিত হচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মহলের লোভ চরিতার্থ করার জন্য কৌশলে গ্রাস করা হচ্ছে সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা এবং শালীনতা।

- Advertisement -

Read More

Recent