রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

বন্ধুদের যুক্ত করা

ছবিউইলিয়াম জাস্টিস বিন ভাগোসালে

ওইদিন সন্ধ্যায় নাসিরের বাসায়। দাওয়াত ছাড়া যাওয়া যায় তেমন বাসার একটা বাসা নাসিরের। রবিবার। ছুটির দিন। সাধারণত আমরা রবিবারে ব্যাডমিন্টন খেলি, কিন্তু ওইদিন খেলোয়াড় সঙ্কটের কারণে খেলা হলো না। তার পরিবর্তে বাসায় ইয়োগা আর অ্যারোবিক্স করলাম, সেটাও ইফতারের আগে। নাসির আগেই বলে রেখেছিল যে রক্তের সুগার মাপবে, সেজন্য সুগার মাপার যন্ত্রপাতিসহ হাজির। সর্বশেষ খেয়েছি সন্ধ্যা ৭টায়, সেই হিসেবে ৯টায় রিডিং নেওয়া হলো। ৪.২। এটা অবিশ^াস্য। কিন্তু ডিজিটাল ওই মিটার যা দেখাচ্ছে তাকে অস্বীকারই বা করি কীভাবে? গতকাল যে চিতই পিঠা খেলাম, সেগুলো গেল কোথায়?

নাসিরের রিডিং ৫ এর ঘরে, তাতেই সে খুশি। কতমাস ধরেই না চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কোনোভাবেই ৭-এর নিচে নামে না। সব শুনে নাসির বলল, “আমি আসলে পুরোপুরি মেনে চলিনি। ধর, সকালে বøুবেরি দিয়ে স্মুদি খেতাম, দুপুরে ডিম ছিল, আর বিকালে যা যা বলছ তাও।”

- Advertisement -

বললাম, “সকালেরটাই আসল। বুলেটপ্রæফ কফি খেতে অসুবিধা কী?”

: সেটা তো অফিসে গিয়ে খাই।

: তাহলে সকালে স্মুদি খাওয়া বাদ দাও আপাতত। আর কদিন পরে ফ্যাট মেটাবলিজম শুরু হলে সকাল দুপুর বাদ, তখন ফাস্টিং, মানে একবেলা খাওয়া। ইচ্ছে করলে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং দিয়ে শুরু করতে পারো। সন্ধ্যায় খেয়ে পরদিন দুপুর পর্যন্ত না খেয়ে থাকা।

গল্প করতে করতে ভাবির হাতে বানানো চা চলে আসে, সাথে বাদাম। আগে বাদামের জায়গায় জর্দা সেমাই, মিষ্টি বা নুডলস আসতো। আর রঙ চা ভুলেও না। ঘন লিকারের দুধ চায়ের মজাই ছিল অন্যরকম। ভাবির শরীরে নানা অসুখ ঘর বেঁধেছে, সেগুলো নিয়ে ডাক্তার আর হাসপাতালের মধ্যে ছোটাছুটি লেগেই আছে। তার মধ্যে আর্থাইরাইটিস একেবারে ভয়ঙ্করভাবে চেপে ধরেছে। বললাম, ভাবি শুরু করে দেন। বলতে বলতে আমার ডান হাতের মধ্যমা আঙুলটা দেখিয়ে বললাম, “অনেকদিন থেকে সেখানে আর্থারাইটিস ঘর বেঁধেছে, ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম, বলেছে, আর্লি-আর্থারাইটিসের লক্ষণ, বয়সকালে আঙুল কেটে ফেলতে হতে পারে। তো অনেক দিন ধরে সেটা চেপে গিয়েছিলাম, আর মাঝে মাঝে আঙুলের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। গত কয়েকদিনের রোজায় সেই আর্থারাইটিস হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।”

সকলে অবাক। আমার হাতের আঙুলে জেঁকেবসা আর্থারাইটিসের খবর কেউ-ই জানতো না, অবাক হওয়ার কারণ সেটাই। এমন নিশ্চিত প্রমাণকে কীভাবে হাজির করি, ওটাতো গায়েব!

কেবল আর্থারাইটিস না, শরীরের অনেক অনেক জটিল রোগ যেমন আলঝাইমার বা ডিমন্যাশিয়ার গ্রাস থেকে শরীরকে ঠিক করে যে প্রক্রিয়া তার নাম অটোফ্যাজি। শরীরে অপ্রয়োজনীয়, ক্ষয়ে যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষগুলো যে প্রক্রিয়ায় নিজেকে নিঃশেষ করে নতুন নতুন কোষের জন্মের জন্য পথ খুলে দেয়, তাকে বিজ্ঞানীরা অটোফ্যাজি বলে ডাকে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ২০১৬ সালে জাপানের বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি অহসুমি এই বিষয়ে নোবেল পুরষ্কার পেলে বিশে^ নতুন করে তা আলোচনার জন্য সামনে চলে আসে। ১৯৭৪ সালে বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান দ্যা ডুভে কর্তৃক শরীরের কোষে লাইসোসোম আবিষ্কারের ফলশ্রæতিতে নোবেল প্রাপ্তির পরে বিষয়টিকে যারা আরও অনেক দূর এগিয়ে নেন, অহসুমি তাদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে বহু বিজ্ঞানী, বিশেষ করে পার্কিনসন, আলঝালমাইরা, টাইপ-২ ডায়াবেটিসসহ মানুষের শরীরের বার্ধক্যজনিত নানা রোগ নিয়ে কাজ করছে, এমন ডাক্তার কিংবা বিজ্ঞানীদের কাছে অটোফ্যাজি এক আগ্রহের বিষয়। পুষ্টিকর খাবার, স্বল্পাহার, রোজা বা উপবাস, হালকা শরীরচর্চা ইত্যাদি নানা বিষয় অটোফ্যাজিতে ভূমিকা রাখে। এ নিয়ে বিস্তারিত বলা যাবে। আপাতত, বন্ধুদের কীভাবে আমাদের এই নতুন কার্যক্রমে যুক্ত করেছি, সেটাই বলি।

নাসিরের ওখান থেকে বাসায় ফিরে মনে হলো রেড ডিয়ারে বসবাসরত বন্ধু মিজানকে খবর দেওয়া দরকার। ওর বউ, মানে আমাদের ছবি ভাবি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। উচ্চ রক্তচাপও আছে। আর মিজানের শরীরে যে কতকিছু বাসা বেঁধেছে, তার হিসাব কে রাখে। ইতোমধ্যে সারা ভাবীর কল্যাণে আমার ও নাসিরের পরিবর্তন বিষয়ে মিজান ও ছবি ভাবী খানিকটা জেনে গেছে। ফোন দিতেই ওপাশ থেকে মিজানের প্রশ্ন, “তোমরা নাকি ভাত-টাত খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ? কী খাচ্ছ তাহলে?”

: ঠিকই শুনেছ। আর খাই হলো বাতাস!

: আরে ঠাট্ট না, সিরিয়াস। শুনলাম তোমাদের সুগার লেভেল ৫-এর ঘরে। তোমার ভাবীর অবস্থা তো ভালো না। মনে হচ্ছে ইনসুলিন নিতে হতে পারে।

: আচ্ছা ঠিক আছে। তা আমরা যা যা করেছি, সেটা তোমাকে টেক্সট করে দিচ্ছি। পড়ার পরে প্রশ্ন থাকলে ফোন দাও।

ফোনে পুরো তালিকাটা টেক্সট করে দিলাম। পাঁচ মিনিট হয়নি, এর মধ্যেই মিজানের ফোন।

: বুলেট কফি বানাতে যে বাটারের কথা লিখেছ, তা কি যে কোনো বাটার হলেই হবে? নাকি অর্গানিক লাগবে?

: যেকোনো বাটারেই হওয়ার কথা। তবে, ঘাস খাওয়া গরু থেকে পাওয়া অর্গানিক বাটারের দাম একটু বেশি রাখলেও ভেজাল টেজাল নেই।

: আর এক্সট্রা ভার্জিন নারিকেল তেল, সেটা কই পাওয়া যায়?

: সুপারস্টোরে পেতে পারো, তা না হলে কস্টকো। আমরা অবশ্য অ্যামাজনে অর্ডার দিয়ে এমসিটি তেল কিনে এনেছি।

: এমসিটি?

: হ্যাঁ, অলিভ অয়েল বা এক্সট্রাভার্জিন নারিকেল তেলের চেয়ে ওটা বেশি ভালো তেল। বিশেষ করে, মগজের জন্য এটা নাকি টনিক। রিভিউতে তাই পড়লাম।

এভাবে মিজানের কাছে বিস্তারিতভাবে সকল কিছু বলার পরে মনে হলে, আর যাই হোক মিজান অন্তত নিজ থেকে কোনো কারিকেচার চাপিয়ে দেবে না। কিন্তু বিধি বাম। তিনদিন পরে ফোন দিয়ে প্রথমেই যা শুনলাম, তাতে চক্ষু চরকগাছ― তারা দুপুরে ডিমের সাথে রুটি খাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে।

: কেন রুটি কেন?

: খালি খালি ডিম খেতে তো ভয় লাগে। রক্তে কোলেস্টরেল বেড়ে যাবে না?

: চর্বি খেলে কোলেস্টরেল বাড়তে পারে, তবে এটা তো ভালোটা। ভালো কোলেস্টরেল ছাড়া শরীরকে রক্ষা করবো কীভাবে? রুটি-মুটি খেয়ে পেট ফুটা করছ, এখন সেই পথ দিয়ে ব্যাকটেরিয়া ঢুকে পড়ছে শরীরে, বডির ইমিউন সিস্টেম তো ভালো খারাপ বাছবিচার করে না।

: তাহলে কি রুটি খাবো না?

: না, কখনোই না, বিশেষ করে দুপুরবেলা তো নয়-ই। আমাদের শরীর ঠিক হয়ে গেলে তখন সন্ধ্যার দিকে একটা-দুটা খেতে পারি। শুনতেছি গম হচ্ছে চিনির মতোই ক্ষতিকর। তবে, কার্ব খেলে সন্ধ্যার খাবারে ফ্যাট অবশ্যই বাদ দেব। কারণ হচ্ছে, কার্ব হজম করতে যে ইনসুলিন বের হয়, তার উপস্থিতিতে ফ্যাট হজম হয় না। যুক্তিটা হচ্ছে ফ্যাটের সাথে প্রোটিন চলে, কিন্তু কার্ব না; আবার কার্বের সাথে প্রোটিন চলে, তখন অবশ্য প্রোটিন খাওয়া বেশি হয়ে যায়। যেমন, তোমাকে যদি রুটি মাংস খেতে দেওয়া হয় তো গোগ্রাসে গিলতে পারবে, কিন্তু খালি মাংস দিলে কয়েক টুকরো খাওয়ার পরে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে। একইভাবে, মাছের ঝোল দিয়ে অনেক ভাত খাওয়া যায়, কিন্তু খালি মাছ ২/৩টার বেশি সম্ভব হয় না।

এভাবে মিজানের পরে আমাদের তালিকায় যুক্ত হয় মির্জা সেলিম। তার আগে জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে এখানকার বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের ভোটের দিনে আমাদের শুকিয়ে যাওয়া দেখে অনেকেই আগ্রহভরে আমাদের জীবনযাপন নিয়ে জানতে চায়। আমরাও যতটুকু পারি, মানুষকে বলার চেষ্টা করি। খানিকটা শোনার পরে কেউ কেউ “ও, এটা তো কিটো ডায়েট” বলে মন্তব্য করলে তার জবাবে আমরা বলি, “না রে ভাই, এটা কিটো না। আমরা মূলত ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করছি।”

: আজকে কি ফাস্টিং?

: না, আজ দুপুরে নানরুটি কাবাব খেয়েছি।

: এতে করে সমস্যা হবে না?

: কিছুটা হবে হয়তো। তবে, আমাদের কলিজা হচ্ছে দক্ষ ম্যানাজার। উল্টোপাল্টা খাওয়া সত্তে¡ও এতদিন ধরে সেই তো সকল ধকল সামলিয়েছে। কাজেই, মাঝে মধ্যে ধকল না দিলে সে তো ধকল সামলানোর কথা ভুলেই যাবে।

এই কথাগুলোই ঘুরে ফিরে আসে হার্ভার্ডের অধ্যাপক ড. ডেভিড সিনক্লেয়ারের লেখা ’লাইফ স্প্যান, হোয়াই উই এইজ অ্যান্ড হোয়াই উই ডোন্ট হ্যাভ টু’ গ্রন্থে বা তার নেওয়া নানান পডক্যাস্ট বা ইউটিউব ভিডিও গুলোতে। যদিও অনিয়মগুলো বেশিরভাগই অনাহার, অর্ধাহার কিংবা শরীরকে উষ্ণতা বা চরম ঠান্ডার মুখে ফেলে দেওয়া সংক্রান্ত এবং কোনোভাবেই তা বাজে খাবার খেয়ে কোষ নষ্ট করা সংক্রান্ত না। এসব নিয়ে পরে বিস্তারিত বলা যাবে। আপাতত, খাবার নিয়ে কী কী অনিয়ম করে ফেলেছি তার একটা খতিয়ান দেই।

১৮ তারিখের কথা আগেই বলেছি। এক সপ্তাহে বাদে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের নবনির্বাচিত কমিটির শপথ ও বার্ষিক সাধারণ সভা। এদিন মার্লবরো সেন্টারে এখানকার বাংলাদেশিদের উপস্থিতি ছিল বাঁধভাঙা। প্রথমবারের মতো দুটো প্যানেলের মধ্যে ভোটের প্রতিযোগিতা হওয়ায় নির্বাচনটি হয়ে উঠেছিল প্রাণবন্ত এবং তার রেশটা এসে পড়েছিল এজিএম-এ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আগে-পরে রাতের খাবার, তাতে খাসির মাংসের রেজালা, ভেজিটেবল, পোলাও এবং সালাদ। পোলাও বাদ দিয়ে মাংস, ভেজিটেবল আর সালাদ খেলাম। পরিবেশক হা করে তাকিয়ে থাকে। ভাবখানা এমন, খায়া খায়া ডাইবেটিস বানাইছেন মিয়া, এখন মজলিসে আইসা ভাব মারেন। আমি কিছু বলি না। ধৈর্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি সেই কবে! তা কে জানতো যে, কিছুক্ষণ পরে চমচম আর কালোজাম দেখে সেই ধৈর্যে ইস্তফা দিয়ে ৪টা মিষ্টি খেয়ে ফেলব। একে কপাল বলে মানতে রাজি নই। ইচ্ছে করলে মিষ্টি না খেয়ে থাকতে পারতাম। কিন্তু মনে হলো, খেয়ে পরীক্ষাটা নেওয়া দরকার। সকালে সুগার মেপে দেখব।

সকালে সুগারের রিডিং পেলাম ৫.৮।

বউ বলল, তুমি বেশি শুকিয়ে গেছ। মাঝে মধ্যে ভাত-রুটি খাওয়া উচিত।

বলেই ক্ষান্ত হলো না। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে দেখি পরাটা আর গরুর মাংসের সিনা। মাঝারি সাইজের মাংসের টুকরোগুলো ভুনা করে রান্না। তৃপ্তি করে খেলাম। পরদিন শুক্রবার দুপুরে খিচুরি। সেই ভুনা মাংস দিয়ে। লতা এসেছিল। প্রথমে দুই টুকরো মাংস নিলেও পরে তাতে আরও টুকরো যুক্ত হয়। আসলে রান্নাটা ছিল ভিন্নস্বাদের। আর আমি মনে হয় হিসাব ছাড়া খেলাম। রাতে রক্তচাপ মেপে দেখি ১৬০-এর উপরে। কয়দিন ধরে ১২০-এর নিচে থাকাতে রাতের ওষুধের একটা ডোজ বাদ দিয়েছিলাম, সকালের দুটো খেতাম কেবল। তাতে রক্তচাপ বাড়েনি, কিন্তু গরুর মাংস রক্তের সাথে শত্রæতা শুরু করে দিলে আমার আর কী করার থাকে।

ক্যালগেরি, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent