সোমবার - মে ২০ - ২০২৪

হার্ভার্ড অধ্যাপক ডেভিড সিনক্লেয়ার

ডা জাহাঙ্গীর কবীর

আগেই যেমনটা বলেছি, অর্থাৎ ইউটিউবের পর্দার অন্তরালে চলতে থাকা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর কল্যাণে ডাক্তার জাহাঙ্গীরের ভিডিও দেখতে শুরু করলে কানাডিয়ান ডাক্তার জ্যাসন ফাং কিংবা একই বা কাছাকাছি বিষয়ের ওপর তৈরি করা অন্যান্য ডাক্তার বা নিউট্রশনিস্টদের ভিডিও চলে আসে। তখন তাদের কখাগুলো মন দিয়ে শুনি। ডাক্তার জাহাঙ্গীর কবির, ডাক্তার ফাং কিংবা অন্যান্যদের বক্তব্য একই রকমের। ডা. ফাং-এর ভিডিও দেখতে দেখতে একদিন একটা ভিডিওর শিরোনাম দেখে চমচে উঠি। সেখানে লেখা : বার্ধক্য এক রোগ যার নিরাময় সম্ভব। আর মন্তব্যটি হার্ভার্ড-এর জেনিটিক বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডেভিড সিনক্লিয়ারের। আমি দেখতে শুরু করে দিলাম। যতই শুনি, ততই অবাক হই। জেনেটিক্স নিয়ে বিশ^ যে কতদূর এগিয়ে গেছে, ধারণা ছিল না। ভদ্রলোক ডিএনএ ঘড়ির কথা বলছে যেখানে কোষ তার স্মৃতি ধরে রাখে। সেই ঘড়ি নাকি ১০ বছর পূর্বের স্মৃতিতে রিসেট করা যায় এবং তাতে করে মরে যাওয়া অঙ্গ নবজীবন ফিরে পায়। ইঁদুরের উপরে পরীক্ষা শেষ, সেই সফলতার ওপর ভর করে এখন মানুষের চোখের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হচ্ছে। তখন এক ভাইরাসের ইঞ্জেকশন দিয়ে অন্ধের চোখে আলো ফেরানো যাবে। এরকম যুগান্তকারী ঘটনা আগামী ২/৩ বছরের মধ্যেই ঘটতে চলেছে।

কী শুনলাম! ‘অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে প্রাণ!’ প্রাণ কেউ ফেরাতে না পারুক, অন্ধের চোখে আলো ফিরিয়ে দেওয়া, সেটাই বা কম কী?

- Advertisement -

শুধু কি তাই? মানুষের বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার মূল কারণটাও ভদ্রলোক আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। তার মতে, আমাদের শরীরের কোষগুলো সারাক্ষণ জীবন-মৃত্যুর চক্রে চলমান আছে, আর পুনর্জন্ম লাভের সেই মহাক্ষণে শরীরের কোষগুলো একধরনের আত্মপরিচয়ের সংকটে পড়ে, তারা নিজের এবং তার চারপাশের কোষগুলোকে চিনতে সক্ষম হয় না। কারণ তাদের পরিচয় জানিয়ে দেওয়ার কাজ করে যে জিন, বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশ, জীবনযাপন, খাদ্যাভাস ইত্যাদি নানাকারণে তাদের সংখ্যা কমতেই থাকে। ফলে নবজীবন লাভ করার সময় ওই কোষগুলো নিজের পরিচয় জানতে ব্যর্থ হয়। আর এভাবে তারা শরীরের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকে। যে জিনগুলো সেই আত্মপরিচয় ধরে রাখার কাজ করে, তাদের সংখ্যা কমে যাওয়া ঠেকাতে পারলে মানুষ কেবল যে অনেক অনাকাঙ্খিত রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকবে তা না, দীর্ঘজীবন লাভেও সক্ষম হবে। এমনকি বর্তমানের যে গড় আয়ু তাকে অতিক্রম করে মানুষ ১২০ কি ১৫০ বছর পর্যন্ত অনায়াসে বেঁচে থাকতে পারবে। ভদ্রলোক বই লিখে তাতে তার এবং আরও অনেক অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণাগুলোকে একত্রিত করে আমাদের জন্য উপস্থাপন করেছেন।

ফেব্রæয়ারির ৮ তারিখে ‘লাইফস্প্যান, হোয়াই উই এইজ অ্যান্ড হোয়াই উই ডোন্ট হ্যাভ টু’ বইটি কিনে আনি।

ততদিনে রাত ১০টা কি সাড়ে ১০টায় ঘুমানোর অভ্যাস হয়ে গেছে। ফলে, ঘড়িতে ভোর ৬টা ২৫ মিনিটে অ্যালার্ম দেওয়া থাকলেও শরীর সেই ঘড়ির ডাকের অপেক্ষায় থাকে না, ৫টা কি সাড়ে ৫টায় ঘুম ভেঙে যায়। ব্রেকফাস্টের ঝামেলা যেহেতু নেই, ঘুম ভেঙে প্রার্থনার কাজ শেষে বই নিয়ে বসি। এভাবে এক সপ্তাহের মধ্যে ৪০০ পৃষ্ঠার বইটি শেষ করে ফেলি। শুরুটা গল্পের ছলে হলেও ধীরে ধীরে বইয়ের বিষয়বস্তু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গভীরে চলে গেছে― জিন, কোষ, মাইটকন্ড্রিয়া, ক্রোমোজোম, ডিএনএ ইত্যাদি নানাবিষয়ের ওপর সর্বশেষ আবিষ্কারগুলো সম্পর্কে কত কথা। কোষ বিভক্ত হওয়ার সময় কীভাবে ক্রোমোজোমগুলো তাদের পরিচয় ধরে রাখে বা হারিয়ে ফেলে এবং হারিয়ে ফেললে এই কোষগুলো কী ধরনের বৈরি আরচণ শুরু করে, সেগুলো পড়তে গিয়ে চমকে উঠি। স্কুল-কলেজে পড়া সেই বায়োলজির তলায় এত গভীর জ্ঞান! শুধু তাই নয়, আমাদের জীবনযাপনে এবং খাদ্যাভাসে কী কী পরিবর্তন আনা গেলে কোষ বিভক্তির সময় ক্রোমোজোমগুলো তার আত্মপরিচয় নিয়ে কোনো সংকটে পড়ে না, সেটাও জেনে ফেললাম। এর বাইরে নানা ধরনের সাপ্লিমেন্ট নিয়ে বলা হয়েছে, এরমধ্যে কিছু আছে যাদেরকে শরীরে হজম করালে আমাদের কোষগুলো সতেজ থাকে এবং তাদের বিভক্তি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ হয়। সেসব সাপ্লিমেন্টের উপরে পরিচালিত পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা আছে। উদ্দেশ্য, মানুষের দীর্ঘায়ু লাভের পথটিকে উন্মুক্ত করা, সেটা প্রাকৃতিকভাবে হোক কি মেডিসিন প্রয়োগ করে। দুটো পথ নিয়েই আলোচনা আছে, উপায়গুলো বলা হয়েছে লেখকের নিজের উপরে পরিচালিত নিরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে; বিশেষ করে মেডিসিনের বেলায়। লেখক পেশায় ডাক্তার না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মেডিসিন প্রয়োগের বিষয়টি আইনদ্বারা নির্ধারিত, সেজন্য নিরাপদ অবস্থান হচ্ছে কোনো রকমের অনুমোদনের ঘোষণা না দিয়ে কেবল ওষুধ বা ড্রাগ প্রয়োগের বেলায় নিজে কী করেছে সেটা বলে যাওয়া, তাতে আইনের ঝামেলায় পড়তে হয় না। লেখক তাই-ই করেছে। আকলমন্দকে লিয়ে ইশারায় কাফি।

বইয়ের বিষয়বস্তুকে দুইভাগে ভাগ করে নেওয়া যায়। এক, জীবনযাপন ও খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এবং দুই, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সাপ্লিমেন্ট বা ড্রাগ।

আমাদের জন্য সহজ হচ্ছে জীবনযাপনে পরিবর্তন আর সস্তায় পাওয়া যায়, এমন সাপ্লিমেন্ট। কিন্তু কীভাবে তা কাজ করছে সে সম্পর্কে কিছু আলোকপাত না করলে একটা ধাঁধা থেকেই যায়। তার আগে বলে নিই― জীবন কী অথবা মৃত্যুই বা কী, সে সম্পর্কে বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত অজ্ঞ। লেখক নিজেই বলছেন যে, পদার্থবিজ্ঞান অণুপরমাণুর অনেক গভীরের খোঁজ দিতে সক্ষম হলেও সেই তুলনায় জীববিজ্ঞান এখনও শিশুই রয়ে গেছে এবং এখন পর্যন্ত এই দুই প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি। জীবন কী সেই সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন যে, এ হচ্ছে অসংখ্য বিশৃঙ্খল ডিএনএ’র এক আশ্চর্যজনক আয়োজন; আর মৃত্যু হচ্ছে শরীরের অসংখ্য কোষের পরষ্পরকে ভুলে যাওয়া। জীবন নয়, লেখকের আগ্রহ তাই মরণে, কীভাবে তাকে ঠেকানো যায়, আর তা সম্ভব হলে মানুষের দীর্ঘায়ু লাভের যে সাধ, তা পূরণ হয়।

ক্যালগেরি, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent