শনিবার - জুলাই ২৭ - ২০২৪

একটি কবিতা ও এর পেছনের কথা

আমাদের দেশটি সমগ্র বাঙালির ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারকারী ও মধ্যযুগীয় মাদ্রাসা শিক্ষার নামে অন্ধকারের প্রশ্রয়দাতা ক্ষমতালোভী কোন দলের নয় বাঙালি এটা হতে দেবে না দেয়নি

২০০৫ সালে টরন্টোয় আমাদের আড্ডা ছিল সুমন রহমান সম্পাদিত ‘বাংলা রিপোর্টার’ পত্রিকা অফিসে। সেই সময় হায়াৎ মামুদ টরন্টোয় বসবাস করেছিলেন প্রায় ছয় মাসের মতো, তাঁর ছেলে সৌম্য মামুদের বাসায়। স্বভাবতোই হায়াৎ মামুদকে পেয়ে আমরাও ভীষণ আনন্দিত। তিনি আমাদেরকে সময় দেন, আড্ডা দেন, আনন্দময় স্মৃতিকথা বলেন এবং সময়ে সময়ে পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখে দেন।

সেই সময় অর্থাৎ বিএনপি জামাতের সরকারের আমলে

- Advertisement -

বাংলাদেশে ভয়াবহ রকমের সাম্প্রদায়িক উস্কানি অত্যাচার চলছে। হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভাইবোনদের ঘর বাড়ি দখল করা হচ্ছে। উপাসনালয় ভেঙ্গে দিচ্ছে। অসহায় নারী ধর্ষিত হচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে এই অবস্থা দমনের কোনো সন্তোষজনক উদ্যোগ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছেনা। দেশের বিবেকবান মানুষ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো প্রশাসনিক দায় মোটেই চোখে পড়ার মতো ছিল না।

এরকম পরিস্থিতিতে এক বিকেলে আমরা অর্থাৎ সম্পাদক সুমন রহমান, আমি আর হায়াৎ মামুদ পত্রিকা অফিসে বসে আছি। পরের দিন পত্রিকা বেরুবে। বিভিন্ন লেখা ও খবর পেস্ট করা হচ্ছে। রাতেই পত্রিকা প্রেসে পাঠাতে হবে। সুমন ভাই হায়াৎ মামুদকে অনুরোধ করলেন সম্পাদকীয় লিখে দিতে। সম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের সর্বশেষ খবর দেখে নিতে অনলাইনে পত্রিকা পড়ে নিচ্ছেন। সহসাই একটি খবর তাঁকে স্তম্ভিত করে দিল। তিনি খবরটি আমাদেরকে বললেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বৌদ্ধ উপাসনালয়ে হামলা করা হয়েছে। কয়েকটি প্রাণ নিঃশেষ হয়েছে। শুধু তাই নয়, হামলাকারী স্বর্গলোভী মুসলিম জঙ্গিরা বৌদ্ধদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। হায়াৎ মামুদ নির্বাক হয়ে কম্পিউটারের সামনে থেকে সরে আরেকটি কামরায় গিয়ে বসলেন। আমরা তিনজন মুখোমুখি বসে রইলাম। কারো মুখে কোনো কথা নেই। হায়াৎ মামুদ কাঁপা কণ্ঠে মৌনতা ভেঙ্গে বললেন :’নাহ্, চলে যাবো। দূরে কোথাও চলে যাবো। এই দেশে (বাংলাদেশে) আর থাকা যাবেনা। এই দেশ মানুষ হয়ে বসবাস করার আর যোগ্য রইলোনা। আমি কোনো ধর্ম পরিচয়ে এই দেশে থাকতে চাইনা। আমি মানুষ পরিচয়ে থাকতে চাই। কিন্তু মৌলবাদীরা আমাদেরকে মানুষ হয়ে থাকতে দেবেনা।’

অপ্রকাশিত এবং নিঃশব্দ অস্বস্তিতে ঢেকে দিল আমাদের পরিসর। কারো দিকেই আর পরস্পর চেয়ে দেখার সাহস হলোনা। তবু আমি আড়চোখে চেয়ে দেখলাম হায়াৎ মামুদের জলজ চোখ চিকচিক করে উঠলো। ক্ষুধার্ত সিংহের থাবায় পড়া অসহায় হরিণের মতো ছটফট করতে লাগলেন নীরবে, নিঃশব্দে।

তাঁর কথায় ক্ষুব্ধতা ছিল। অসহায়ত্ব ছিল। দিকভ্রান্ত পথিকের মতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা ছিল। গ্রহণকালীন সূর্যের মতো আদিগন্ত অন্ধকার হয়ে যাওয়া কয়েকটি মুহূর্ত আমরা তাঁকে তাঁর আলোকিত ভাবনার আবরণে ঢেকে থাকতে দেখলাম। কয়েক লহমায় তিনি আবার স্বরূপে ফিরে আসলেন। নীরবতার আপাত দেয়ালের কাঁচকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন : ত্রিশ লক্ষ প্রাণ দিয়েছি এই দেশের জন্য। অসাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করেছি। এই দেশ আমার। এই দেশ আমাদের। এই বাংলাদেশ ছেড়ে আমি যাবো কেনো! কোথাও যাবোনা। আমাদের সবাইকে আবার লড়াই করতে হবে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। মানুষের বসবাস উপযোগী একটি দেশ আমাদেরকেই গড়ে যেতে হবে।’ অপরাজেয় সেনাপতির মতো দৃঢ়তা তাঁর কণ্ঠে। অতঃপর তিনি কলম হাতে নিলেন। রক্তের অক্ষর দিয়ে লিখলেন সেদিনের বিষাদময় পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কথা। দিক নির্দেশনামূলক বিশ্বাসের আশ্বাস বাণী দিয়ে লেখা সম্পাদকীয় ছাপা হল পরের দিনের ‘বাংলা রিপোর্টার’ পত্রিকায়।

সেদিন মধ্যরাতে আমি বাসায় গেলাম ঠিকই। কিন্তু আমার দেখা সেদিন বিকেলে এক জ্ঞানতাপসের উদ্বিগ্নচিত্ত মুখ মন থেকে গেলোনা। আমি সারারাত জাগরণে থেকে ভোর রাতে লিখলাম এই সনেট কবিতাটি। পরদিন কম্পিতবক্ষে লেখাটি তাঁর হাতে দিলাম। বিনীতভাবে কবিতাটি তাঁকে উৎসর্গ করার অনুমতি চাইলাম। বিনয়ের অবতার হয়ে স্নেহ মিশ্রিত আবেগময় কণ্ঠে তিনি যা বললেন, তা শুধু আমার কাছেই থাক।

আজ আমার দেশের মস্তিষ্কে যেভাবে ক্রমশ পচন ধরেছে, তা দেখে একজন জ্ঞানতাপস হায়াৎ মামুদের সেই দৃঢ়চিত্ত মনোভঙ্গির কথাই বারবার মনে হচ্ছে। জনযুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে জয়ী এই দেশ কোনো দলের নয়। কোনো একক নেতা নেত্রীর তো অবশ্যই নয়। বিশ কোটি মানুষের এই দেশটি রক্ষা করবে এই দেশের আপামর জনতাই। জনতার জয় হবেই। সময় শুধু অপেক্ষার।

জয় বাংলা।

পুনশ্চ : পরের সপ্তাহেই সুমন ভাই কবিতাটি বাংলা রিপোর্টারে ছাপলেন। সেদিনের ছাপা হওয়া হুবহু ফটোকপিই এখানে বন্ধুদের জন্য তুলে দিলাম। লেখাটিতে আলতো করে দুইবার চাপ দিলেই সম্পূর্ণ কবিতাটি পড়া যাবে।

পাদটীকা : সুমন ভাইয়ের সাথে যে সম্পর্ক, তাতে করে তাঁকে ধন্যবাদ প্রকাশ এখানে অবান্তর।

** আমাদের দেশটি সমগ্র বাঙালির। ধর্মীয় আধিপত্য বিস্তারকারী ও মধ্যযুগীয় মাদ্রাসা শিক্ষার নামে অন্ধকারের প্রশ্রয়দাতা ক্ষমতালোভী কোন দলের নয়। বাঙালি এটা হতে দেবে না। দেয়নি!

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent