শুক্রবার - জুলাই ২৬ - ২০২৪

লিটিল লাইব্রেরি মুভমেন্ট

মাসুদুল হাসান রনি

জ্ঞানচর্চার জন্য বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। নানান বিষয়ের বই পড়ার জন্য লাইব্রেরির চেয়ে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে?

লাইব্রেরি মানে বিশাল আকৃতির বিল্ডিং। আলমিরায় থরে থরে সাঁজানো হাজার হাজার বই। চেয়ার টেবিলে বসে বইপড়ার আয়োজন । সদস্যরা প্রয়োজনীয় বইটি বাড়িতে নিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু প্রচলিত ধারনার লাইব্রেরির বাহিরে ই-লাইব্রেরি যেমন আছে, তেমনি লিটিল লাইব্রেরিও আছে। পশ্চিমা বিশ্বের এই লিটিল লাইব্রেরির ধারনা খুব বেশী দিন আগের নয়। (আমাদের বাংলাদেশে এই লাইব্রেরির ধারনায় কোন উদ্যোগ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।)

- Advertisement -

সম্ভবত দুই হাজার আঠারো সালের নভেম্বরের কোন এক তুষারস্নাত সকালে দ্যু পার্ক এভিনিউর বার্নাড আবাসিক এলাকায় হঠাৎ চোখে পড়ে সুদৃশ্য একটি কাঠের বক্স। যার ভেতর অনেক বই সাঁজানো। বক্সের গায়ে লেখা “একটি বই নিন, আপনার পঠিত একটি বই দিন “।

মনে পড়ে, এ ধরনের ক্ষুদ্র লাইব্রেরি প্রথম দেখেছিলাম টরন্টোতে। এরপর অটোয়া ও মন্ট্রিয়েলের বিভিন্ন আবাসিক এলাকা এবং পার্কে। তখন বুঝিনি যে, এটা পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলার আন্দোলনের উদ্যোগ। রুয়ে বার্নাডের এই জুইশ বাড়ির সামনে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাঠের বাক্সভর্তি বই আমাকে কৌতুহলী করে তোলে। অনেকটা কুঁড়েঘর অাকৃতির ছোট বাক্সের লাইব্রেরী। যেখানে রয়েছে হাতে গোনা ১০/১২ টি বই ও কয়েকটি ডিভিডি এবং ফ্রেঞ্চ ভাষার লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন। বক্সের গায়ে ইংরেজী ও ফ্রেঞ্চে লেখা, যে কেউ এখান হতে বই নিতে পারেন কিন্ত একটাই অনুরোধ, পড়া শেষে বইটি ফেরত দিতে হবে। অথবা আপনার পছন্দের যে কোন একটি ভাল বই অন্যদের পড়ার সুযোগ দেয়ার জন্য এখানে রাখতে হবে। ”

প্যারিস,বার্লিন, ব্রাসেলস, আমাস্টারডাম কিংবা ইউরোপের বিভিন্ন শহরের যানবাহনে দেখেছি অনেকেই চলতি পথে ব্যাগ হতে বই বের করে পড়ছেন। মন্ট্রিয়েলেও মেট্রো বা বাসে স্বল্প বা দুরপাল্লার যাত্রাপথে প্রায় চোখে পড়ে, বইপ্রেমীরা নিবিষ্ট মনে বইয়ের মধ্যে ডুবে আছেন। এমন শহরে পথচলতি মানুষ কিংবা পাড়াপড়শির জন্য বাড়ির আঙ্গিনায় ক্ষুদ্র লাইব্রেরি থাকবে খুবই স্বাভাবিক মনে হলো।

এখানকার জনপ্রিয় দৈনিক মন্ট্রিয়েল গেজেটের ২০১৪ সালের জুনের একটি সংখ্যায় জানতে পারি, ‘ মন্ট্রিয়েলে চমৎকার এই উদ্যোগটি প্রথম সুচনা করেছিলেন লিন্ডা ড্রোইন নামে এক বইপ্রেমী। কিন্ত বিশ্বে প্রথম এই ধারনা নিয়ে লিটিল লাইব্রেরি মুভমেন্ট সুচনা করেন আমেরিকান টড বেল। ২০০৯ সালে প্রয়াত স্কুল শিক্ষিকা মায়ের স্মরনে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় টড প্রথম ছোট লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। ‘

এই ধারনায় বিশ্বের ৪০ টি দেশের বিভিন্ন শহরে গড়ে উঠেছে লিভার-সার্ভিস। লিটিল লাইব্রেরি. অরগ এর হিসেব অনুযায়ী, এই মুহুর্তে সারাবিশ্বে ৭৫ হাজারের মতন লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে। যাকে বলা হয় নিখরচায় একে অপরের সাথে বইয়ের আদান প্রদান। ধারণাটি সহজ, মানুষজন তাদের সংগ্রহের কোন একটি বই “বইয়ের বাক্সে” রেখে তারপর বাক্স হতে পছন্দের বই বাড়িতে নিয়ে যায়। সংগৃহীত বইটি ফিরিয়ে দেয়ার কোন বাধ্যবাধকতা কিংবা কোনও চার্জ, নাম নিবন্ধকরণের বালাই নেই। এই ধারনাটি এখন মন্ট্রিয়েলসহ পশ্চিমাবিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

মন্ট্রিয়েলের বিভিন্ন এলাকায় এরকম কিছু লাইব্রেরির ডিজাইনের জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তাই বিগত দিনে যখনই লিটিল লাইব্রেরি চোখে পড়েছে তখনই ছবি তুলে রেখেছি। আহা কি চমৎকার সব ডিজাইন, আকৃতি!

পথচলতি মানুষের পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলার উদ্যোগের জন্য লিন্ডা ড্রোইনকে অব্যশ্যই ধন্যবাদ জানাতে হবে। তার কারনে মন্ট্রিয়েলে লিটিল লাইব্রেরি মুভমেন্ট বেশ জনপ্রিয়। আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি প্রথম রোজমন্টে তাঁর বাড়ির সামনে একটি লিটিল ফ্রি লাইব্রেরি স্থাপন করেছিলেন। প্রতিবেশী ও শিশু কিশোরদের আগ্রহ লক্ষ্য করে তিনি আরো বারোটি লাইব্রেরি স্থাপনে উৎসাহী হন।

টড বেল আমেরিকার উইনসকনসে যখন লিটিল লাইব্রেরি স্থাপন করেন তখনো তিনি ভাবতে পারেননি, এ ধারনা এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। সে তার লাইব্রেরির গায়ে লিখেছিলেন,আপনার ভাল বই শেয়ার করুন!

প্রতিবেশীদের কাছে ব্যাপক সাড়া পাওয়ায় টড শহরের বিভিন্নস্থানে একটি দু’টো করে অনেকগুলো লিটিল লাইব্রেরি স্থাপন করেন। তার এই উদ্যোগের জনপ্রিয়তায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে লিটিল লাইব্রেরি মুভমেন্ট নামে অর্গ্যানাইজেশনের যাত্রা শুরু । বিনামূল্যে বইয়ের আদান প্রদান ধারণাটি সহজ হওয়ায় বইপ্রেমীরাও লুফে নেয়। তাদের পছন্দ মতো একটি বই “বইয়ের বাক্সে” রেখে একটি বই বের করে নিতে পারছে।

লিন্ডা ড্রোইন বিশ্বাস করেছিলেন, লিটিল লাইব্রেরি মুভমেন্টের সাফল্য অাসবে পাড়া পড়শীদের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তিনি প্রতিবেশীদের বলতেন, বাক্সগুলিতে কিছু “জাদু” রয়েছে। সেই জাদুর মোহে একবার পড়লে “তোমার শহরে পরিবর্তন আসবেই।সেই পরিবর্তনের নায়ক হবে তুমি।'”

সেই পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে মন্ট্রিয়েলের পাশ্ববর্তী ডরভাল শহরে। এই গ্রীষ্মে ব্যালান্টিন এবং বে ডি ডি ভেলোইস পার্কগুলিতে বইয়ের বাক্স রাখা হয়েছে। সার্টো দেসোনয়র্স কমিউনিটি সেন্টার, সেরি অ্যাক্যাটিক এবং বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারের সামনেও সিটি কর্পোরেশন বেশ কিছু লিটিল লাইব্রেরি স্থাপন করেছে। পয়েন্ট-ক্লেয়ার শহরে সিটি কর্পোরেশন গ্রীষ্মে লিটিল লাইব্রেরিগুলি চালু করার পরিকল্পনা করেছে, যাতে বাসিন্দারা তাদের প্রিয় বই আদান-প্রদান করতে পারে।

আমেরিকায় টড বোল ও কানাডায় লিন্ডা ড্রোইনের পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলার আন্দোলনের সাফল্য ও জনপ্রিয়তার ঢেউ ব্যক্তিপর্যায় থেকে সরকারী উদ্যোগে পশ্চিমা বিশ্বের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে।

জয় হোক বইয়ের।

মন্ট্রিয়ল, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent