রবিবার - এপ্রিল ২৮ - ২০২৪

ড্যান্ডেলায়ন

ছবিকার্ল হেজ মিলার

নটিংহামে প্রথম গেছি তখন, চমৎকার ইউনিভার্সিটি ক্যামপাস। সেই প্রথম ড্যান্ডেলায়নের দেখা পাই ইউনিভার্সিটি পার্কের লনগুলোতে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম উঁচু নিচু টিলার ঢালে সবুজ গালিচায় অজস্র তারার মেলা যেন। সেদিন আমার মনে হয়েছিল এর চাইতে শৈল্পিক সুন্দর আর কিছু দেখিনি। আমি যখন বার বার ড্যান্ডেলায়নের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যাচ্ছিলাম, আমার ব্রিটিশ বান্ধবী এমিলি তখন মুখ টিপে হাসছিলো আমার উচ্ছাস দেখে। হাসির অর্থ তখন বুঝিনি। খুব শীঘ্রই একদিন জানতে পারলাম আমার সেই প্রচুর নন্দিত ড্যান্ডেলায়ন গাছই নাকি বিশ্রী রকমের আগাছা ওদেশে এবং পৃথিবীর আরও অনেক দেশে। সচেতন কারও বাগানের এক কোনে একটি ড্যান্ডেলায়নের চারা দেখলেও তাদের মাথাব্যাথা শুরু হয়ে যায়। এই আগাছাকে তাড়াতে মানুষ অনেক অসাধ্য কাজই করে ফেলবে যেন।
ফুল ফোটার প্রাথমিক অবস্থ্যায় অর্থাৎ যত্ন করে কাটা ঘাসের লনের বুকে ড্যান্ডেলায়ন ফুল দেখতে খুব ভাল লাগে। সমস্যা হয় পরে, যখন এদের বীজ হয়। তখন ফুলগুলো দেখতে খারাপ হয়ে যায় এবং বীজগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে চতুর্দিকে। কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু দেশে ড্যান্ডেলায়নকে বিরক্তিকর আগাছা বলে মনে করা হয়। যারা সুন্দর লন বা সুদৃশ্য বাগান ভালবাসেন তারা বাগান বা লন থেকে ড্যান্ডেলায়নকে তাড়ানোর সব রকম চেষ্টা করে থাকেন। আমার এক বান্ধবিকে জানি নির্ভেজাল ড্যান্ডেলিয়ন বিহীন ঘাস পাওয়ার জন্য এক ধরণের সার ব্যবহার করে যা দিলে ঘাসের গ্রোথ অনেক বেশী হয় এবং তার সাথে পাল্লা দিয়ে ড্যান্ডেলায়নের গ্রোথ সেই অনুপাতে বাড়ে না। ফলে ড্যান্ডেলায়ন বিদায় নেয় বাগান থেকে। আমরা যখন একটি সুদৃশ্য লনের কথা ভাবি তখন আমাদের চোখের সামনে ভেষে ওঠে গাড় সবুজ ঘাসে মোড়া আগাছা বিহীন একটি লন যার ঘাস কাটা হচ্ছে নিয়মিত। এই সুদৃশ্য লন রাখার প্রথম শর্তই হচ্ছে আগাছা নিয়ন্ত্রন বা weed control। ব্যাপারটার গুরুত্ব অনেক এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে একই সাথে এটা খুব চ্যালেঞ্জিং ব্যাপারও। লনকে আগাছা মুক্ত রাখতে হলে নিয়মিত লনের দিকে নজর দিতে হবে, শারীরিক শ্রম দিতে হবে এবং এ ব্যাপারে প্রচুর তথ্য জানতে হবে।
ইউরোপ এবং এশিয়ার দেশগুলোতে অনেক বছর ধরে মানুষ এই আগাছার অসাধারণ নিউট্রিশনাল ভ্যালু থেকে উপকৃত হয়েছে। ভিটামিন মিনেরালস এবং এন্টি-অক্সিডেন্ট এর আধার হল ড্যান্ডেলায়ন। এক কাপ সবুজ ড্যান্ডেলায়নে ১১২% ভিটামিন A (দৈনন্দিন যা দরকার) পাওয়া যায়। ভিটামিন ছাড়াও লৌহ ও ক্যালসিয়ামে সমৃদ্ধ এবং একই সাথে ডি-টক্সিফায়ার। হলুদ ড্যান্ডেলায়নে থাকে শরীর সুরক্ষা করার মতো বহু উপাদান। এছাড়াও থাকে স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য বহু রকমের টিপস। অনেকে মনে করেন বাগানে ড্যান্ডেলায়ন থাকলে তা বাগানে থাকা অন্য গাছের জন্য উপকারী গাছ হয়ে কাজ করে। এদের লম্বা ট্যাপ রুট (tap root) মাটির নিউট্রিয়েন্টকে মাটির উপরের স্তরের কাছে নিয়ে আসে এবং মাটিতে মিনেরালস এবং নাইট্রোজেন যোগ করে। ফলে ছোট বা শ্যালো শিকড়অলা গাছগুলো মাটি থেকে নিউট্রিয়েন্ট পায়। ড্যান্ডেলায়ন তার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য দিয়ে পরাগায়নকারি পতঙ্গদেরকে আকর্ষণ করে নিয়ে আসে বাগানে ফলে বাগানের অন্যান্য গাছেরও পরাগায়নে সাহায্য হয়।

ছবিপল লেজলি

ড্যান্ডেলিয়ন দিয়ে অনেক সুস্বাদু খাবার তৈরি হয়। এই গাছের প্রায় সব অংশই খাওয়া যায়, বিশেষ করে পাতা, শিকড় এবং ফুল খাওয়া হয়ে থাকে। এর পাতা সালাদের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায় আবার রান্না করেও খাওয়া যায়। ড্যান্ডেলায়নের পাতা, ফুল বা শিকড় শুকিয়ে রাখা যায় বা ফ্রোজেন করেও রাখা যায়। ফুল দিয়ে জুস তৈরি করা যায়, আবার বিভিন্ন রেসিপিতে যোগ করা যায়। কফির বিকল্প হিসেবে ড্যান্ডেলায়নের শিকড় ব্যবহার করা হয়। শিকড় এবং পাতা শুকিয়ে রেখে দেয়া হয় চা বানানোর জন্য। ড্যান্ডেলায়ন দিয়ে যে সমস্ত খাবারের রেসিপি প্রচলিত আছে তার কিছু উল্লেখ করা হল, বেকড ড্যান্ডেলায়ন, বুরডক টনিক টি, চিকেন উইথ র‍্যাপ, ড্যান্ডেলায়ন ব্যানানা ব্রেড, ড্যান্ডেলায়ন সিরাপ, ড্যান্ডেলায়ন ভিনেগার, ড্যান্ডি মাফিন টপস, ড্যান্ডি পাস্তা, লিক এন্ড নেটেল সুপ, সেসামি এন্ড উইল্টেড গ্রীন সাট্যে, ওয়াইল্ড পিজ্জা ইত্যাদি বহুবিধ রেসিপি এবং হারবাল শ্যাম্পু।
ড্যান্ডেলায়নের বৈজ্ঞানিক নাম ট্যারাক্সাকাম অফিসিনালে (Taraxacum officinale)। Asteraceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। ট্যাক্সোনোমিক দিক থেকে এই জেনাস ট্যারাক্সাকাম খুবই জটিল। কিছু উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এই গনকে ৩৪টি ম্যাক্রোস্পিশিজ এবং ২০০০ মাইক্রোস্পিশিজে ভাগ করেন। ড্যান্ডেলায়নের ডাঁটা এবং গুচ্ছাকার পাতা খুবই বৈশিষ্টপূর্ণ। এদের পাতাগুলো গভীরভাবে খাঁচ কাটা থাকে যাকে ইংরেজিতে বলা হয় toothy। ড্যান্ডেলায়ন (Dandelion) কে সরাসরি ফরাসি ভাষায় তর্জমা করলে অর্থ দাঁড়ায় “Lion’s tooth” অর্থাৎ সিংহের দাঁত বা সিংহদন্তী। পাতাগুলো দাঁতের মত অর্থাৎ ডেন্টেড থাকে এবং পাতাগুলোতে রোম থাকে না। পাতা সাধারণত ৫ থেকে ২৫ সেমি লম্বা হয়। গাছের গোড়ার দিকের পাতা গোলাপের পাপড়ির (rosette) মত সাজানো থাকে। মাটি এবং পরিবেশের উপর নির্ভর করে এদের উচ্চতা বা বৃদ্ধি। এরা ২৫ থেকে ৪০ সেমি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
ড্যান্ডেলায়নের ফুল সাধারণত উজ্জ্বল হলুদ থেকে কমলা রঙের হয়ে থাকে। দিনের বেলায় ফুটে থাকে এবং রাত্রে বুজে যায়। ফুলগুলো একটি ফাঁপা ডাঁটার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। এই ডাঁটার সাথে কোনো পাতা থাকে না। ডাঁটাগুলো ১ থেকে ১০ সেমি লম্বা হয়ে থাকে। কান্ড এবং পাতায় এক ধরণের সাদা বা কমলা রঙের কষ থাকে। একটি পাতার গুচ্ছ থেকে একাধিক ফুলের দন্ড বের হতে পারে। ফুলগুলো ২ থেকে ২.৫ সেমি ব্যাসের হয়। ভিতরের দিকের ব্রাক্ট খাড়া থাকে যতক্ষণ না বীজ পরিপক্কতা পায়, তারপর নিচের দিকে ঝুঁকে বীজ গুলোকে ছড়িয়ে যেতে সাহায্য করে। ফুলগুলো পরিপক্কতা পেলে বীজসহ গোল বলের মত আকৃতি ধারণ করে যাকে বলে ব্লো-বলস (blowballs)। একটি বীজের বলে অনেকগুলো একক বীজসহ ফল থাকে যাকে বলা হয় achenes। প্রত্যেকটি achene সুক্ষ রোম দিয়ে জুড়ে দেয়া থাকে মাঝখানে pappus এর সাথে। যার ফলে এরা বাতাসে ভেষে ভেষে দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ড্যান্ডেলায়নে প্রচুর পরিমানে আয়রন থাকে যা শরীরের হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য খুবই দরকারি। এটাতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন A থাকে। আরও থাকে এন্টি-অক্সিড্যান্ট যেমন ভিটামিন সি এবং luteolin যারা সম্মিলিতভাবে হাড়ের বয়স-জনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। ড্যান্ডেলায়নের জুস ডায়াবেটিক রোগীদের প্যানক্রিয়াসে ইনসুলিন তৈরি করতে সাহায্য করে এবং এইভাবে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমিয়ে আনে। এর রসকে বলা হয় ড্যান্ডেলায়ন মিল্ক। এই রস ত্বকের সমস্যায় খুবই উপকারী বিশেষ করে যখন মাইক্রোবিয়াল এবং ফাঙ্গাল আক্রমণের কারণে ত্বকের সমস্যা হয়। এই রসের মধ্যে খুব বেশী পরিমানে ক্ষারীয় এবং জীবানু, পোকামাকড় এবং ফাঙ্গাসের বিরুদ্ধে লড়ার মত উপাদান থাকে। এই রস চুলকানি, রিং-ওয়ারম, এক্সিমা এবং অন্যান্য ধরণের ত্বকের রোগে ভাল কাজ দেয়। কোন রকম সাইড-ইফেক্ট ছাড়াই এই রস ব্যবহার করা যেতে পারে। এই রস ব্যবহারের সময় খুবই সতর্ক থাকতে হবে কারণ চোখের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এছাড়াও জন্ডিস, লিভারের সমস্যায়,মূত্রের সমস্যায় ও ওজন কমাতে ড্যান্ডেলায়ন খুবই উপকারী। ক্যান্সার থেকে দূরে রাখে এবং গল-ব্লাডারের সমস্যায় কাজ দেয়। কৌষ্ঠকাঠিন্য এবং রক্তশূণ্যতায়ও উপকার পাওয়া যায়।
ড্যান্ডেলায়নের মত এমন অজস্র উদ্ভিদ অনেক উপকারী ভেষজ গুন নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্বময়। সময় হয়েছে এখন এইসব উদ্ভিদ থেকে কমার্শিয়াল ড্রাগ উদ্ভাবন করে মানবের কল্যাণে সঠিকভাবে ব্যবহার করার।

- Advertisement -

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent