রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

আরাস আন উখত্রাইন আয়ারল্যান্ড

আয়ারল্যান্ডে এসে হঠাৎ শৈশবের এই স্মৃতি ভেসে উঠলো

শৈশবে জেলা শহরে বেড়াতে গেলেই আত্মীয়রা সেখানকার দর্শনীয় জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন। রিকশায় ঘুরে জমিদার বাড়ি, প্রাচীন মসজিদ, ঐতিহাসিক পুকুর, পীরের মাজার, পুরনো মন্দির ইত্যাদি দেখার মজাই ছিলো আলাদা। তবে এগুলোর পাশাপাশি চারটি সরকারি বাড়ি দেখিয়ে তাঁরা আনন্দ পেতেন। এগুলো হলো জেলা প্রশাসকের বাস ভবন, জেলা জজের বাড়ি, এসপি সাহেবের বাড়ি এবং সার্কিট হাউস। ডিষ্ট্রিক্ট লেভেলের দর্শনীয় স্থান দেখানোর এই রেওয়াজ এখনো আছে কিনা জানিনা।

আয়ারল্যান্ডে এসে হঠাৎ শৈশবের এই স্মৃতি ভেসে উঠলো কেনো এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। আজ ডাবলিন শহর ঘুরতে গিয়ে দারুণ মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। খুলে বলছি। ধৈর্য্যে কুলোলে পুরোটা পড়তে থাকুন।

- Advertisement -

ট্যাক্সি চালকের নাম মাইকেল ফিয়ারি। ইংরেজি উচ্চারণে আইরিশ টান বেশ প্রবল। কথা বোঝা মুশকিল। জিজ্ঞেস করতেই ভদ্রলোক জানালেন তাঁর মাতৃভাষা গায়েলিক। আদিকালে আয়ারল্যান্ডের মানুষ এ ভাষাতেই কথা বলতো। এখনো বলে। তবে বর্তমান প্রজন্ম ইংরেজিতে সাবলীল। ইংরেজিতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তবে উচ্চারণে গায়েলিক প্রভাব থেকেই গেছে।

কথা বলতে বলতে মাইকেল বন্ধু হয়ে গেলো। অনুমতি নিয়ে ষাটোর্ধ মানুষটিকে মাইক বলে ডাকা শুরু করলাম। অমায়িক হাসি দিয়ে বললো, আমি এ নামেই পরিচিত!

মাইক গাড়ি চালাচ্ছে ডাবলিনের ঝকঝকে তকতকে রাস্তা দিয়ে। দারুণ পরিচ্ছন্ন শহর। হাই-রাইজ নাই বললেই চলে। লিফি নদীর পাড়ে উঁচু একটি ভবন দেখলাম। মনে হয়না দশ বারো তলার উপরে হবে।

লিফি নদীর কথা কখনো শুনিনি। এমন একটি কাব্যিক নদী ডাবলিন নগরীর বুক চিড়ে চলে গেছে, কেউ আমায় বলেনি। প্রশস্থতা বেশি নয়। কিন্তু অনিন্দ্য সুন্দর নদী। কিপ্পুর পর্বতশৃঙ্গ থেকে উৎপন্ন হয়ে আইরিশ সাগরে পতিত হয়েছে। পতিত হওয়ার আগে ডাবলিন শহরের যাবতীয় পানি পিপাসা মিটিয়েছে। অসংখ্য জল-বিনোদনের ব্যবস্থা করেছে।

লিফি পার হতেই মাইকের মুখে খই ফুটতে শুরু করলো। কতো যে কথা! ট্যুরিস্ট গাইডরাও এতো কথা বলেনা। রাস্তা থেকে ক্রমাগত মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারি, ট্রিনিটি কলেজ, ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটি সব দেখিয়ে চলছে। এক সময় বিশাল এক পার্ক এলাকায় নিয়ে গেলো। ফিনিক্স পার্ক। পর্যটকেরা এটি মিস করেনা। তাই আমাকেও সেখানে নেয়া হলো।

বিশাল খোলা ময়দান। একটিও ফুল গাছ নেই। নেই কোনো ফ্যান্টাসি কিংডম বা ওয়ান্ডার ল্যান্ড। তবু বিখ্যাত। কারণটা একটু পরে বুঝলাম।

খোলা জায়গাটির চতুর্দিকে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান। একদিকে ডাবলিন চিড়িয়াখানা। এর উল্টোদিক বরাবর ইউরোপীয় গাছপালার সবুজ বেষ্টনী। বেষ্টনীর ফাঁকে একটি ভবন দেখে চমকে উঠলাম! আমি কি ওয়াশিংটন ডিসিতে? আমি কি হোয়াইট হাউসের সামনে?

মাইককে বললাম, এটি কিসের বিল্ডিং?

দুর্বোধ্য আইরিশ ভাষায় যা বললো তা উচ্চারণে দাঁত ভাঙার দশা। সম্ভবত বললো, “আরাস আন উখত্রাইন”। ইংরেজিতে দাঁড়ায় ‘রেসিডেন্স অব দ্য প্রেসিডেন্ট’। আয়ারল্যান্ডের মহামান্য রাষ্ট্রপতি এখানে থাকেন।

দেখেতো হোয়াইট হাউসের মতো লাগছে?

মাইক হেসে ফেললো। “ঠিকই ধরেছো। আসলে জানো কি, এ ভবন অনুকরণে হোয়াইট হাউস নকশা করা হয়েছে।”

কি বলছো? স্থাপত্যের ইতিহাস আমার প্রিয় বিষয়। কিন্তু এ কথা কখনো শুনিনি হোয়াইট হাউস অন্য ভবন দেখে নির্মিত হয়েছে। শুধু জানি হোয়াইট হাউসের স্থপতি জেমস হোবান আইরিশ ছিলেন।

হোয়াইট হাউসের নির্মাণকাল জানো?

বললাম, ১৭৯২ এ নির্মাণ শুরু হয়। ৮ বছর লেগেছিলো পুরো কাজ শেষ করতে।

ভালোইতো জানো। তবে তোমার এই জানা প্রমাণ করে হোয়াইট হাউসের আগে এই বিল্ডিং হয়েছে।

তাই? মাইককে এবার পাল্টা জিজ্ঞেস করি, এই ভবন কবে হয়েছে?

নির্মাণ শুরু হয়েছিলো কবে জানিনা। তবে শেষ হয়েছিলো ১৭৫১ সালে। আজ থেকে ২৭৩ বছর আগে।

মনে মনে অবাক হলাম। মাইক ট্যাক্সি চালালেও ওঁর ইতিহাস ও সংস্কৃতির জ্ঞান বেশ গভীর। চেহারা এবং ব্যাক্তিত্বও অসাধারণ। ওর দেয়া তথ্য পরবর্তীতে ওয়েবসাইটে মিলিয়ে দেখেছি। প্রায় সবই সত্য।

হুম.. বুঝলাম! সে হিসাবে হোয়াইট হাউস মাত্র ২২৪ বছর আগে নির্মাণ শেষ করেছে।

”কারেক্ট”, মাইক চিৎকার করে ওঠে।

তাহলে বিষয়টি পপুলার হয়নি কেনো? বিশ্ববাসী কেনো জানেনা আইরিশ প্রেসিডেন্ট ভবনের আদলে হোয়াইট হাউস তৈরী।

কারণ একটি আছে। স্ট্রাকচারের যে অংশের কারণে ভবন দুটিকে এক মনে হয়, সেটি আসলে জেমস হোবান হোয়াইট হাউসের ক্ষেত্রে নকশা করেনি।

মানে?

মানে হলো, গার্ডেন ফ্রন্ট পোর্টিকো দুটোর ক্ষেত্রে দেখতে একই রকম মনে হয়। কিন্তু হোয়াইট হাউসের মূল নকশায় জেমস এটি রাখেনি। পরে স্থপতি বেনজামিন হেনরি ল্যাট্রোব এটি যুক্ত করেন। ল্যাট্রোবকে বলা হয় ফাদার অব অ্যামেরিকান আর্কিটেকচার।
আমি বললাম, তাতে কি? ল্যাট্রোবের ডিজাইন তো এই ভবনের সাথে মিলে গেছে।

তবু বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ এটি অস্বীকার করার চেষ্টা করেন। তাঁদের ধারণা জেমস হোবান আইরিশ হওয়ায় তাঁর ক্ষেত্রে অনুকরণটা স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু ল্যাট্রোব অ্যাংলো অ্যামেরিকান। সে হয়তো এ ভবন দেখেইনি।

আমি মাথা নাড়লাম। হোয়াইট হাউস সামনে থেকে কয়েকবার দেখেছি। ‘আরাস আন উখত্রাইন’ আজ দেখলাম। সাদৃশ্য স্পষ্ট। এটির নির্মাণকাল আগে। অংক মেলাতে পারছিনা।

মাইক কাঁধ ঝাঁকালো। অংক মিলিয়ে লাভ নাই। বরং তোমাকে আরেকটি ভবন দেখাই। এই পার্কেরই আরেক কোণায়।

বললাম, ঐতিহাসিক কিছু।

না। তবে গুরুত্ত্বপূর্ণ। হিপহপ ট্যুরিস্ট বাসগুলো পর্যটকদের এ বাড়ি দেখাতে নিয়ে আসে।

চলো। তবে তাড়াতাড়ি করো। সন্ধ্যায় ম্যানচেস্টারের ফ্লাইট ধরতে হবে।

দেরী করবো না। এখান থেকে ২ মিনিটের ড্রাইভ।

ফিনিক্স পার্ক এলাকার ভেতর দিয়েই রাস্তা। দূর থেকে ইউএস পতাকা দেখলাম। বিশাল প্রাসাদোপম বাড়ি। জানতে চাইলাম, ‘এটা কি ইউএস অ্যাম্বেসি?’

না। অ্যাম্বেসি ভবন আলাদা। এটি অ্যাম্বাস্যাডরের বাস ভবন।

বলো কি? আগের বাড়ি আর এই বাড়ির বিশালত্বে তো পার্থক্য দেখিনা।

পার্থক্য কি দরকার আছে? মিটমিট করে হাসলো মাইক। যার অর্থ…. তুমি যাহা বুঝিবার, তাহা বুঝিয়া লও!

ব্রামটন, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent