সোমবার - মে ২০ - ২০২৪

শাহরুখের ডাংকি ও আমরা

শাহরুখের ডাংকি ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বুঝে গেছেন শিরোনামের বাক্যটি কোথা থেকে নেয়া। ইংল্যান্ডে আসতে হার্ডি, মানু, বালি, সুখী, বুগুদের ইংরেজি শেখার সে কী সংগ্রাম! IELTS ক্লাসে বোমান ইরানি ক্লাসে ঢুকছেন এই শ্লোগানে, বার্মিংহ্যাম, হিয়ার আই কাম!

- Advertisement -

ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী বার্মিংহ্যাম। মেট্রো বার্মিংহ্যামের জনসংখা প্রার ৪৩ লাখ। এরই একটি অংশ ওয়ালসাল। মার্কেট টাউন হিসাবে খ্যাতি আছে। নিজস্ব পপুলেশন কম নয়। ৬৭ হাজারের উপরে।

এই ওয়াসলাল শহরে আমার এক বাল্যবন্ধু শাহীনের বসবাস। প্রচুর বাংলাদেশী বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের অনেক লোকের বাস এখানে। আমার ম্যানচেস্টার আসার কথা শুনে শাহীন কাজ থেকে চারদিনের ছুটি নিয়ে বসে আছে। যাতে এর ভেতর কোনো এক দিন আমি সময় ম্যাচ করাতে পারি।

সকালে ব্যাংকিংয়ের কাজটা এতো দ্রুত শেষ হবে ভাবিনি। ঘড়িতে গ্রীনিচ মান টাইমে মাত্র সাড়ে এগারো। হিসেব কষলাম ১২টা ২০ এর বাস ধরলে তিনটের আগেই বার্মিংহ্যাম পৌঁছাবো। ছেলেকে বললাম রেডি হ’।

ছেলে তাঁর নতুন বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত। তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিতে ওর দেরী হয়ে গেলো। ১২:২০ এর ফ্লিক্সবাস মিস করলাম। ফ্লিক্সের পরের বাস আড়াইটায়। গুগল সার্চে দেখি দুপুর ১টায় এয়ারপোর্ট থেকে ন্যাশনাল এক্সপ্রেস বাস যাবে বার্মিংহ্যাম। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে সোজা ছুটলাম এয়ারপোর্টে।

শাহীন তখনো জানেনা আমি আজই আসছি। বাস হাইওয়ে M-6এ ওঠার পর শাহীনকে ফোন দিলাম। বললাম, “শাহীন আসছি।”

চরম উত্তেজিত শাহীন। এমনিতে ও’ বেশ ঠান্ডা প্রকৃতির। কণ্ঠে স্পষ্ট আনন্দ টের পেলাম।

কখন আইতাছো?

এ মুহূর্তে বাসে। তিনটে নাগাদ পৌঁছবো।

ঠিক আছে। আমি টার্মিনালে থাকবো। বার্মিংহ্যাম ডাউনটাউনে শুধু পাবলিক ট্রানজিট ও সার্ভিস কার ঢুকতে দেয়। আমি গাড়ি আনতে পারবো না। তোমাদেরকে ট্যাক্সি বা বাসে করে বাসায় নিয়ে আসবো।

টার্মিনালে তোমার আসার দরকার নেই। আমি পাশের কোনো হোটেলে উঠবো। তুমি সেখানে আসো।

শাহীনের আনন্দ উত্তেজনা এবার দপ করে নিভে গেলো। চেপে রাখতে না পেরে বললো, “আমি একটা রুম সম্পূর্ণ রেডি কইরা রাখছি। তুমি কইতাছো হোটেলে উঠবা?”

“শাহীন, আমি হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছি। ফুললি পেইড অফ।”

মিথ্যে বললাম শাহীনকে (স্যরি বন্ধু, ছেলের কারণে উপায় ছিলোনা। ওরা হোটেলে কমফোর্ট পায়… কী যে যুগ পড়লো)!

হতাশা কাটিয়ে শাহীন স্বাভাবিক হলো। বললো, “এখানে ডিনার করে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতে হবে।”

সে তো অবশ্যই। তবে খাবার দাবাড় আয়োজনে সময় নষ্ট কোরোনা। বেশিরভাগ সময় গল্পগুজবে কাটাবো।

ফোন রেখেই আমার বুকিং অ্যাপ ‘হোটেলস ডট কম’এ ঢুকলাম। টার্মিনাল থেকে হাঁটার দূরত্ত্বে কোনো হোটেলে রুম নাই। শেষে শতবর্ষ পুরোনো এন্টিক হোটেলে দুটো সিঙ্গেল বেডের রুম পেলাম। ফিচারে দেখাচ্ছে নো ব্রেকফাস্ট, নো পার্কিং, একশো বিশ স্কয়্যার ফিট বেড রুম উইথ ফুল ওয়াশ। নো কিচেনেট! অগত্যা এটাই বুকিং দিলাম।

এড্রেস টেক্সট করে শাহীনকে পাঠালাম।

বার্মিংহ্যাম ডাউনটাউনে ঢুকতেই গাড়ি বুলরিং বিল্ডিয়ের পাশ দিয়ে অর্ধ গোলাকার ঘুরে টার্মিনালে প্রবেশ করলো। বুলরিং ভবন বার্মিংহ্যাম শহরের আইকোন। এর স্থাপত্য নন্দন যেকোনো বেরসিক মানুষকেও আকৃষ্ট করবে।
বুলরিং’এর তিন মিনিটের দূরত্বে হোটেল। সাথেই গ্রান্ড সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশনের সামনের সিঁড়ি ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরির মতো। তবে সাইজে তিন/চার গুন বড়। প্রথমে ভেবেছিলাম এটিও কোনো লাইব্রেরি। পরে দেখি রেলওয়ে স্টেশন এবং মাল্টিপ্লেক্স শপিংমল। কাভি খুশি কাাভি গম ছবির শ্যুটিং হয়েছিলো এ’ মলে।

হোটেলের রুমে ঢুকেই রোবাব চিৎকার করে উঠলো। ‘ওয়াশরুম কাঁচের কেনো? তাও আবার রুমের মাঝখানে?’

বললাম, কাঁচের ওয়াশরুমের ডিজাইনটা দেখেছো? কী সুন্দর।

না আব্বু। কোনো প্রাইভেসি নাই।

প্রাইভেসি আছে। দেখো নন-ট্রান্সপারেন্ট। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায়না।

উঁহু! ইউ ক্যান সী মাই শ্যাডো হোয়াইল টেকিং শাওয়ার।

বললাম, চিন্তা কোরোনা। আমি তাকাবো না।

এমন সময় শাহীনের ফোন। হোটেল কনসিয়ার্জে ওয়েট করছে। হাত মুখ ধুয়ে নিচে নামলাম।

সেই মুখ। সেই চেহারা। শাহীন বদলায়নি। সোফায় বসে ফোন টিপছিলো। কনসিয়ার্জের সুন্দরী মহিলা ওর জন্য কফি নিয়ে আসছে। সোফা ছেড়ে উঠে জড়িয়ে ধরলো। দুই যুগের উপরে ওর সাথে দেখা হয়না। দুইবন্ধুর আলিঙ্গনে মহিলা খানিকটা হকচকিয়ে গেছে। আল্লাহই জানে সে কি মনে করেছে?

ছেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। রোবাব আমার ইউনিভার্সিটি বন্ধুদের চিনলেও বাল্যবন্ধুদের সাথে ওর পরিচয় কম। একারণে আমার চাইল্ডহুড বন্ধুদের ব্যাপারে ও’ খুব আগ্রহী।

শাহীন বললো, ‘তুমি তো হার্ট অব বার্মিংহ্যামেই আছো। বুলরিং এখানটাতেই’

হ্যাঁ। আমি আসার সময় দেখেছি।

চলো তোমাদের পুরাটা ঘুইরা দেখাই। স্টিলের তৈরী বিরাট একটা ষাঁড় আছে। ওটা আবার সময় সময় ঘাড় ঘুরায়।

ও কে। চলো আগে এগুলো দেখি তারপর তোমার বাসায় যাবো।

হোটেল থেকে পা ফেলেই পর্যটন শোবিজ শুরু। গ্রান্ড সেন্ট্রালের সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে যেতে দেখি ফিলিস্তিনিদের সপক্ষে বিরাট জনসমাবেশ। পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে চতুর্দিকে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ। তবে যে মহিলা ভাষন দিচ্ছিলেন তাঁকে দেখলাম ভীষণ গরম বক্তৃতা দিচ্ছেন। কেউ বাঁধা দিচ্ছেনা।

পাশেই স্টিলের ষাঁড়। ছবি তুললাম। সমাবেশের ভাষণ শুনলাম খানিকটা। এরপর ভেতরে মল এলাকায় গেলাম। ভেরি ওয়েল প্লানড। স্টেশন, শপিংমল, প্রার্থনার জন্য ১৮৫৫ সালের গীর্জা, শতশত রেস্টুরেন্ট, বিশাল খোলা চত্বর, স্ট্রিট ফুড’সহ পর্যটন বিনোদনের সবকিছু। একটু দূরেই বিশাল আকারের হাইরাইজ। নতুন নির্মাণ চলছে অনেকগুলো বহুতলের।

সিটি সেন্টার, বুলরিং বেড়িয়ে শাহীনকে বললাম,

‘চলো এবার। ওয়ালসালে তোমার বাসায়।’

শাহীন তিনটি আগাম টিকেট কেটেছিলো। সিটি বাস সার্ভিসের ডাবলটেকার। দোতলায় বসে শহর দেখাতে দেখাতে নিয়ে যাবে।

বাসায় ঢুকে খাবারের পদ দেখে অবাক। দুজন মাত্র দাওয়াতি, বাকিরা বাসার মানুষ। তাতেই এ্যাতো আয়োজন? সব দেশী খাবার। বিফ, চিকেন, ছোট ও বড় সব মাছ, বিভিন্ন রকমের ভাজি, ডাল, গরুর কলিজা… কি নেই? সাথে বিরিয়ানি ও সাদা ভাত।

এ্যতো কিছুর মানে আছে? আসছি শুধু কথা বলতে।

ভাবী এবং শাহীন মৃদু হাসলো।

শুরু হলো কথামালা। শ্যামলী, আগারগাঁও, আমলির টেকের যতো আলাপ! কথা হলো শৈশবে পাড়ার বড় ভাইদের নিয়ে! শাহীননের আপন বড় ভাই, মিজান ভাই, ১৯৮০ সালে বডিবিল্ডিংএ “মিস্টার বাংলাদেশ” হয়েছিলেন। মাস কয়েক আগে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কথা হলো মিন্টু ভাই, মেজবাহ ভাই, সজল, জাকির ভাই, মরহুম রিপন ভাই, দুই সোহেল, আর্টিস্ট শামীম, রিপন, হেলাল, জুয়েল… সবাইকে নিয়ে। সেইসাথে ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ড সহ বিদেশে যাঁরা আছে তাঁদের নিয়ে। কথা হলো লন্ডনে মোদাসসের মামার এক্সিডেন্টাল অসুস্থতা নিয়ে। জার্মানিতে থাকা মঈনউদ্দিনকে ফোন দিলো শাহীন। ও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলো। কথা হয়নি। জার্মানির টাইমজোন আবার ইংল্যান্ডের চেয়ে এক ঘন্টা এগিয়ে।

আড্ডার রাত খুব একটা গভীর হয়নি, যতোটা আশা করেছিলাম। একে ক্লান্ত, তার উপর নিরাপত্তা চিন্তা। শাহীন আশ্বস্ত করেছিলো এ এলাকা সম্পূর্ণ নিরাপদ।

কিন্তু আমার চিন্তা হোটেল এলাকা নিয়ে। ডাউনটাউনে জায়গাটি ট্যুরিস্টিক হওয়ায় ডেলিভারি ট্রাক ছাড়া সব যান নিষিদ্ধ। ট্যাক্সি হোটেল পর্যন্ত যেতে পারেনা। এক দেড় মিনিট হাঁটা লাগতে পারে। ভয়টা সেখানেই।

ভাবীও সায় দিলেন। পৃথিবীর সমস্ত ডাউনটাউনে কিছু হোমলেস ঘুরে বেড়ায়। নেশা ভাং করে পড়ে থাকে। ওরা হার্মফুল না হলেও দেখে ভয় লাগে।

কথা বলতেই বলতে জুতা মোজা জ্যাকেট পরতে থাকলাম। ভাবী ও শাহীন দেখি সুদৃশ্য গিফট ব্যাগ বের করছে। বললাম, এটা কি?

কিছু না। রোবাবের জন্য সামান্য উইন্টার ক্লথ।

বলো কি ভাই? আমিতো কানাডা থেকে তোমার বাচ্চাদের কিছু আনতে পারিনি।

এটা কোনো ব্যাপার না। তুমি আইছো কাজে। আর আমরা তো তোমারে দাওয়াত কইরা আনছি। ব্যস্তসময়ে কষ্ট কইরা আইছো, তাতেই খুশী।

শেষ চমকটা তখনো বাকি ছিলো। ছেলেবেলায় দেখা বাঙালির অতিথি কালচার শাহীন পুরোটা ধরে রেখেছে। অতিথি বরণ, নিজ হাতে খাবার পরিবেশন, হাত ধোয়ায় সহযোগিতা এবং বিদায় বেলা হাতে গিফট ব্যাগ ধরিয়ে দেয়া। খাবারের একটি প্যাকেটও হাতে দিলো। আপেল, কমলা, কলা ও খেজুরসহ বিস্কুটের প্যাকেট।

ভাবী ট্যাক্সি ডাকলেন। ট্যাক্সি নিচে এলে আমরাও বিদায় নিলাম। শাহীন সাথে এলো। ট্যাক্সিওয়ালা পাকিস্তানি। তাঁকে চুপি চুপি উর্দুতে কি যেনো বললো। কিছু বুঝিনি। একেতো ফিসফিসানি। তার উপর উর্দু। ভাবলাম হয়তো ডিরেকশন দিচ্ছে।

ভাগ্যভালো রাতে ট্যুরিস্ট পাড়ার রাস্তা আনব্লক করা। ট্যাক্সি হোটেলের একদম সামনে দাঁড়ালো। রোবাব খাবারের ব্যাগ নিয়ে ভেতরে গেলো। ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম মিটার কতো হয়েছে?

ইউ ডোন্ট নিড টু পে। তোমার বন্ধু ভাড়া এবং টিপ আমাকে অগ্রীম দিয়ে দিয়েছে।

কি বলো?

ইয়েস।

ট্যাক্সি থেকে নেমে ধীরে ধীরে হোটেল লবিতে প্রবেশ করলাম। ভাবছিলাম, বিদেশ এসে আমরা অতিথি সেবা করলেও বাঙালির এই রীতিগুলো ভুলে গিয়েছি। শৈশবে আম্মা আব্বাকে দেখেছি। গ্রাম থেকে কেউ এলে যাবার সময় বাস ভাড়া দিয়ে দিতো।

চোখটা ভিজে উঠলো!

ব্রামটন, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent