রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

ছড়াকারের মাথায় জাতির জনকের এবং তাঁর কন্যার আশীর্বাদের হাত

আমার জীবনের সবচাইতে বর্ণাঢ্য উজ্জ্বল আর গৌরবময় অধ্যায়টি রচিত হয়েছিলো ছেলেবেলায়। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহ সান্নিধ্য ও স্পর্শ লাভের বিস্ময়কর মুহূর্তগুলোর সমন্বয়েই রচিত হয়েছিলো সেই অধ্যায়টি, ১৯৭৪ সালের এক প্রসন্ন বিকেলে। রৌদ্রকরোজ্জ্বল অবিস্মরণীয় সেই বিকেলের গল্পটির ধারাবাহিক প্রেক্ষাপট নির্মিত হয়েছিলো ইতিহাসের অলৌকিক প্রণোদনায়।

- Advertisement -

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কচি-কাঁচার মেলার জাতীয় শিক্ষা শিবির বা ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়েছিলো গুলিস্তানের পাশে, বঙ্গভবনের উল্টোদিকে, শহিদ মতিউর শিশুপার্কে। সারাদেশ থেকে কচি-কাঁচার মেলার বিভিন্ন শাখার কয়েক শ কিশোর-কিশোরী সেই ক্যাম্পে অংশ নিয়েছিলো। আমিও অংশ নিয়েছিলাম সেই ক্যাম্পে কেন্দ্রীয় সদস্য হিশেবে।

মতিউর শিশুপার্কে আমরা থাকতাম তাঁবু খাটিয়ে। এই শিবির বা ক্যাম্পে কঠোর অনুশাসনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলতো আমাদের নানা রকম কর্মকাণ্ড। শরীরচর্চা, প্যারেড-পিটি, ব্রতচারী, বাঁশনৃত্য, লাঠিখেলা, উপস্থিত বক্তৃতা, গান, আবৃত্তি কতো কিছু!

দাদাভাই বলেছিলেন, ক্যাম্পের সমাপ্তীপূর্ব কোনো একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসেবেন আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে অথবা দাদাভাই আমাদের নিয়ে যাবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কাছে। অধীর আগ্রহে আমরা অপেক্ষা করেছি—কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! কখন দেখবো তাঁকে সামনাসামনি!

তো, আমাদের ক্যাম্পের তাঁবুবাসের শেষদিকে, এক মনোরম বিকেলে অনেকগুলো বাস বোঝাই হয়ে আমরা গিয়েছিলাম গণভবনে, বঙ্গবন্ধুর কাছে। ১৯৭২-এর পর সেটা ছিলো আমার ছুঁয়ে দেয়া দূরত্ব থেকে দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু দর্শন।

সেদিনের সেই বিকেলটা খুবই মনোরম ছিলো। উজ্জ্বল সোনালি রোদের আভায় ভীষণ চকচকে ছিলো। আমাদের পেয়ে কী রকম উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু!

সেই বিকেলে আমাদের নিজস্ব কিছু আনুষ্ঠানিকতাও ছিলো। আমার নেতৃত্বে মার্চপাস্ট হলো। মার্চপাস্টে ছেলেমেয়েদের স্যালুট গ্রহণ করলেন বঙ্গবন্ধু। মার্চপাস্টের শুরুতে ছোট্ট এইটুকুন আমি বিশাল দেহের বঙ্গবন্ধুর মাথায় পরিয়ে দিয়েছিলাম কচি-কাঁচার মেলার ক্যাপ।

খুব নিচু হয়ে মাথাটা আমার নাগালের কাছে নামিয়ে এনে বিরাট-বিশাল বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করলেন আমার মতো একজন খুদে বন্ধুর স্মারক উপহার। বঙ্গবন্ধুর মাথা এবং মাথার চুল স্পর্শ করতে হলো আমাকে, ক্যাপটা তাঁকে পরাতে গিয়ে। তাঁর শক্ত এবং ঘন কালো চুলগুলো ভীষণ ঠান্ডা ছিলো।

(কারো মাথার চুল এতো ঠান্ডা হয়! আমাদের কাছে আসবার আগ পর্যন্ত সারাটাদিন একটানা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ছিলেন বলেই কি তাঁর সতেজ ঘন চুলগুলো এতো শীতল লাগছিলো আমার কাছে! কী জানি! তাঁর শরীর থেকে, শাদা পাঞ্জাবি আর কালো মুজিবকোট থেকে মিষ্টি একটা সৌরভ যেনো ছড়িয়ে পড়ছিলো। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় পারফিউমের নামটা আমার জানা নেই। তিনি তাঁর বিখ্যাত পাইপ-এ এরিনমোর তামাক খেতেন। মিষ্টি সুবাসটা কি তাহলে এরিনমোরের গন্ধ ছিলো! কী জানি!)

মাথায় ক্যাপটা পরানোর পর বঙ্গবন্ধু হ্যান্ডশেক করলেন আমার সঙ্গে। আহা কী নরোম তাঁর হাতটা! তারপর তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত তর্জনীটি, একাত্তরের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের চিরস্মরণীয় সেই আঙুলটি আমার দিকে তাক করে খুবই হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বললেন–আরে এই ছেলেটাকে তো মনে হয় চিনি আমি!

আমি আমার ছোট্ট দু’টি হাত দিয়ে তাঁর হাতটা জড়িয়ে ধরলাম–হ্যাঁ চেনেন তো! আমি রিটন। ছবি আঁকি। আমাদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম তো!

বঙ্গবন্ধু বললেন–আরে তাইতো এইটাই তো সেই আর্টিস্ট ছেলেটা। খুব সুন্দর ছবি আঁকে!

হাসিমুখে দাদাভাই বললেন, আমাদের রিটন ছড়াও লেখে! ইত্তেফাকে ওর ছড়া ছাপাও হয়েছে!

শুনে বঙ্গবন্ধু একটু অবাক হবার ভঙ্গি করে বললেন–তাই নাকি? তুমি তাহলে কবি হবা বড় হয়ে! সুফিয়া কামালের মতো? জসিমউদ্দিনের মতো?

আমি না সূচক মাথা নাড়াই–না বঙ্গবন্ধু, আমি কবি হবো না।

বঙ্গবন্ধু বললেন–তাহলে তুমি হবা ছড়াকার।

এবারও রাজি হই না আমি। মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাই। আমার কাণ্ড দেখে দাদাভাই আর খালাম্মা সুফিয়া কামাল হাসতে থাকেন। আমার কথায় মজা পেয়ে হাত তালি দিতে থাকেন সুফিয়া কামাল।

এবার বঙ্গবন্ধু বললেন, তাহলে বড় হয়ে কী হবা তুমি?

খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে বললাম আমি,
–আর্টিস্ট হবো।
–কতো বড় আর্টিস্ট হবা?
–জয়নুল আবেদীনের মতো বড় আর্টিস্ট হবো বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু বললেন–বাহ্‌ আমাদের তাহলে দুইটা জয়নুল আবেদীন হবে!

আমাদের কথোপকথনের সময় পাশে থাকা কবি সুফিয়া কামাল আর রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই খুব হাসছিলেন। আসলে ছেলেবেলা থেকেই খুব চটপটে আর ছটফটে স্বভাবের ছিলাম আমি। বড়দের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতাম না একটুও। এবং ভয় পাইনি বঙ্গবন্ধুকেও। আর বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলছিলেন যে আমাকে তিনি অনেক আগে থেকেই চেনেন! এই প্রথম আমাদের দেখা হচ্ছে না। এর আগেও দেখা হয়েছে বহুবার, এতোটাই পরিচিত আমি তাঁর কাছে।

আমার মাথায় কাঁধে গালে আর চিবুকে আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে আদর করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার এই অপরূপ কথোপকথন আমার একজীবনের শ্রেষ্ঠ সংলাপের স্মৃতি হয়ে থাকলো। এই সৌভাগ্যের কথা এই পরম প্রাপ্তির কথা আমি গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করে যাবো নতুন প্রজন্মের কাছে। সেই বিকেলটা, সেই মুহূর্তগুলো, তাঁর কণ্ঠস্বর, তাঁকে ছুঁয়ে দেয়া, এবং তাঁর অনন্য আশীর্বাদমাখা স্নেহস্পর্শ পাওয়ার সেই অমূল্য ঘটনাটা এখনো আমার কাছে অলৌকিক কোনো রূপকথা বলেই মনে হয়! এরকম মুহূর্ত একবারই আসে ইতিহাসে, মানবজীবনে।

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। সেই ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে বিশাল দেহের বঙ্গবন্ধু তাঁর মাথাটা নিচু করে আমার নাগালের মধ্যে এনে দিচ্ছেন আর আমি তাঁর মাথায় পরিয়ে দিচ্ছি ক্যাপ, কচি-কাঁচার মেলার। তিনি আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। তাঁর বিখ্যাত তর্জনীটি আমার দিকে তাক করে কথা বলছেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে। ছোট্ট বালক আমি একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে খুব হাসিখুশি ভঙ্গিতে কথা বলছি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, আই কন্ট্যাক্টে! আমাদের কথোপকথন শুনে হাসছেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এবং কবি সুফিয়া কামালও। অপরূপ হাসিমুখে সুফিয়া কামাল হাততালি দিচ্ছেন আমার আর বঙ্গবন্ধুর কথাবার্তা শুনে। সব মিলিয়ে একটা অসাধারণ ফ্রেম। সেই ফ্রেমে বঙ্গবন্ধুসহ আমরা সকলেই হাস্যোজ্জ্বল।

আহা কী গৌরব-সঞ্চারি একটা দৃশ্য! আমার সারা জীবনের এক অনন্য প্রাপ্তি সেই বিকেল এবং সেই বিকেলের এই ভিডিও ফুটেজটি। (বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কুমার বিশ্বজিতের একটি গানে এই ফুটেজটি ব্যবহার করা হয়েছে। গানটাও হয়েছে অসাধারণ, কথায় সুরে আর গায়কীতে।

সাতচল্লিশ বছর আগের, ১৯৭৪ সালের এই দুষ্প্রাপ্য ভিডিও ফুটেজটির খবর প্রথম আমাকে দিয়েছিলো চ্যানেল আই-এর অনুষ্ঠান প্রযোজক শওকত আলী। ২০২০ সালে একুশের বইমেলা উপলক্ষ্যে আমি তখন ঢাক্য। জানুয়ারির শেষান্তে এক দুপুরে চ্যানেল আই ভবনে আমাকে পেয়েই নোয়াখালীর আঞ্চলিক এক্সেন্টে মহাউচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছিলো শওকত

–আম্‌নের লগে বঙ্গবন্ধুর স্টিল ফটোগ্রাফি আম্‌নের লেখায় এর বইতে দেইখছি এতোদিন। বঙ্গবন্ধু স্যালুট নিতেছেন আর ছোট্ট পিচ্চি আম্‌নে কবি সুফিয়া কামাল-দাদাভাইয়ের লগে দাঁড়াইয়া আছেন। সেই ঘটনার ভিডিও দেইখছেন্নি?
আমি বললাম, না তো! স্টিল ছবি দেখেছি কিন্তু ভিডিও তো দেখিনি!

–আঁই দেইখচি! বঙ্গবন্ধুরে লই কুমার বিশ্বজিতের একটা গান এডিটিং চইলতেছিলো। আমি আম্‌নেরে চিনি ফালাই চিৎকার কইচ্ছি। হ্যার পর রিওয়াইন্ড ফরোয়ার্ড করি সবতে মিলি আমরা আম্‌নেরে দেইখচি!
আরে তাই নাকি? এই ভিডিও ফুটেজ কোত্থেকে আবিস্কৃত হলো? মনে হয় ডিএফপিতে ছিলো। সাতচল্লিশ বছর পর পাওয়া গেছে!

০২
আমার জীবনের গতি-প্রকৃতি পালটে দিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হবার বিস্ময়কর সেই বিকেলের বিশাল একটা ভূমিকা রয়েছে। যেটা আমি তখনই বুঝিনি, বোঝার কথাও না, কিন্তু এখন বুঝতে পারি।

ছেলেবেলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন আমার দেখা হয় তখন তো আমার স্বপ্ন ছিলো চিত্রশিল্পী হওয়ার। কিন্তু নিয়তি বা প্রকৃতি চাইছিলো ভিন্ন কিছু। তিনি যখন আমার মাথায় চুলে গালে কপালে কাঁধে চিবুকে স্পর্শ করে করে আদর করে দিচ্ছিলেন তখনই আসলে ঘটে যাচ্ছে অদ্ভুত একটা শিহরণ। বিপুল একটা আলোড়ন। বঙ্গবন্ধুর মতো বিরাট বিশাল হিমালয়সম মানুষটার অলৌকিক সান্নিধ্য আমার ভেতরে কিছু একটা ওলট পালট তো ঘটিয়েই থাকবে। কিন্তু সেটা বোঝার মতো বয়েস তখন আমার ছিলো না।
আমি বুঝিও নি। কিন্তু তিনি তো পরশ পাথরের মতো! তাঁর অবিনাশী স্পর্শের জাদুতে নিয়তি তখনই সিদ্ধান্তটা পাকাপাকাকি করে ফেলেছিলো যে–বড় হয়ে আমাকে হতে হবে লেখক। হতে হবে কবি। এবং আমার লেখার বিষয় হবেন এই বঙ্গবন্ধু। এবং পরবর্তী সারাটা জীবন আমাকে লিখে যেতে হবে ছড়া কিংবা কবিতা, একের পর এক, তাঁকে নিয়ে। ধারাবাহিক ভাবে আমাকে লিখতে হবে বই, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। একের পর এক। একটা বই দু’টো বই। সাতটা আটটা দশটা বই।

আমি যখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখি তখন একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। কেমন একটা স্বপ্ন-বাস্তবতার মাঝামাঝি জায়গায়। অদ্ভুত এক জাদুবাস্তবতায়। যেনো আমি লিখি না। আমি লিখছি না। প্রকৃতিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে যেনো বা!

শৈশবে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যস্মৃতি আমার মনোজগতে চিরস্থায়ী একটা ছাপ ফেলে দিয়েছিলো। তাঁর স্পর্শের সৌরভ আর সান্নিধ্যের গৌরব দীপান্বিত করেছিলো আমাকে। সেই বৈভব আমি বহন করে চলেছি আজও। আমার করোটির চিরহরিৎ অলিন্দে থাকা, হৃদয়ের গভীর গোপন কুঠুরিতে থাকা একজন মুজিব প্রায়শঃই ছন্দ হয়ে হাসেন এবং ছড়া হয়ে আসেন। প্রকৃতি এক অদ্ভুত খেলা খেলে আমার সঙ্গে। একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে যেনো বা প্রকৃতিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় শেখ মুজিবের ছড়া। আর সেটা মুদ্রিত হয় আমার নামে, লুৎফর রহমান রিটনের নামে—

”কান পেতে শোনো এই বাংলার মাটি বায়ু নদী সরোবর/
জপিতেছে নাম করিয়া প্রণাম মুজিবর আহা মুজিবর…।”

০৩

এবার আমি একুশের বইমেলা উদযাপন করতে ঢাকায় এসেছি ০৯ ফেব্রুয়ারি। বইমেলায় সাধারণত একাই আসি আমি। এবারো তাই।

২০২৪ এর একুশে পদক প্রাপ্তির খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হবার পর আমেরিকার হিউস্টন থেকে টেলিফোনে মহাউচ্ছ্বসিত নদী আমাকে বললো, বাবা তুমি তো একা। তোমাকে সঙ্গ দিতে আমি যদি চলে আসি তোমার কি খুব সমস্যা হবে?
আমি বলেছি–সমস্যা হবে না কিন্তু তুই কেনো আসবি এতো দূর থেকে?

শেষ মুহূর্তে বিমানের টিকিটের দাম হবে আকাশ ছোঁয়া। দরকার নেই।

কিন্তু নদী এসে পড়লো। ডেভিড ছুটি পেলো না। অনেক কষ্টে নদী চারদিনের ছুটি ম্যানেজ করে চলে এলো। বললো, প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে একুশে পদক নেবার সময়ের ঐতিহাসিক দৃশ্যটা আমি সামনা সামনি দেখতে চাই। তাছাড়া পুরস্কার প্রাপ্তদের সকলেরই ফ্যামিলি মেম্বাররা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবে। তোমার কেউ নেই। মা কিংবা ডেভিড কিংবা আমি কেউ একজন অন্তত উপস্থিত না থাকলে তোমার খুব মন খারাপ হবে বাবা।

নদী চলে এলো।

নদী চলে আসায় আমার একুশে পদক পাবার আনন্দটা একশোগুণ বড় হয়ে গেলো। এবং প্রিয় আপা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই আনন্দটাকে ঐতিহাসিক একটা রূপ দিয়ে দিলেন।

পুরস্কার গ্রহণ করতে দর্শক সারি থেকে মঞ্চে উঠে আমি তাঁর কাছে গেলাম। বললাম, আপা, আজকের এই মুহূর্তটার সাক্ষী হতে আমেরিকার হিউস্টন থেকে মাত্র চারদিনের জন্যে উড়ে এসেছে আমার কন্যা নদী। ১৯৯৬ সালে আমার ছোটদের কাগজের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আপনি, তখনকার প্রধানমন্ত্রী হিশেবে। অনুষ্ঠানের খুদে বক্তা নদী এই এতোটুকুন ছিলো।

বঙ্গবন্ধু কন্যার স্মৃতিশক্তিও তাঁর বাবার মতোই তীক্ষ্ণ। তিনি নদীকে চিনতে তো পারলেনই, জিজ্ঞেস করলেন নদী কোথায়?

আমি হাত উঁচিয়ে দর্শক সারিতে থাকা নদীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলাম। আপা হাসিমুখে নদীর দিকে হাত নাড়ালেন। দর্শক সারিতে থাকা নদীও মহা বিস্মিত চোখে উল্লাসে ফেটে পড়ে হাত নাড়াচ্ছে। আহা! কী এক দুর্দান্ত আন্তরিক মুহূর্তের সুচনা যে হলো পুরো অডিটোরিয়াম জুড়ে! সঙ্গে যুক্ত হলো দর্শকদের বিপুল করতালি।

আপা আমাকে ধরে নদীর দিকে ঘুরিয়ে দিলেন–তোমার পদকটা ওকে দেখাও!

এই পুরো দৃশ্যটা সরাসরি সম্প্রচারিত হলো। সারাদেশের মানুষ দেখলেন সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যটা।

এর কয়েক সেকেন্ড পরেই ঘটলো আরো দুর্দান্ত ঘটনাটা। আমার জীবনের সৌরভ আর গৌরব যেনো মুহূর্তেই অভ্রভেদী হয়ে উঠলো।

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭৪ সালে ছোট্ট এইটুকুন বালক আমি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত থেকে ভালোবাসার অর্ঘ্য গ্রহণ করেছিলাম। সেদিন তিনি তাঁর আশীর্বাদের অলৌকিক হাতটি রেখেছিলেন সেদিনের ছোট্ট বালক লুৎফর রহমান রিটনের মাথায়।

পঞ্চাশ বছর পর তাঁরই কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের একুশে পদকটি আমার হাতে তুলে দিয়ে সেই একই ভঙ্গিতে আমার মাথায় তাঁর আশীর্বাদের অপরূপ হাতটি রাখলেন। আমার মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে হাসিমুখে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। পিতার মতোই আরেকটি অলৌকিক দৃশ্য নির্মাণ করে দিলেন তিনি। আবেগে ভাসছিলাম আমি। আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো–এ যেনো পঞ্চাশ বছর আগে ঘটে যাওয়া অলৌকিক সেই দৃশ্যেরই ধারাবাহিক এক্সটেনশন। পিতার আশীর্বাদ বর্ষিত হয়েছে যে বালকের মাথায় সেই বালকই আজ ষাটোর্ধ লেখক ছড়াকার। এবং সেই ছড়াকারের হাতে একুশে পদক এবং মাথায় একই ভঙ্গিতে আশীর্বাদের হাত! কী বিস্ময়কর ঘটনা!

কী বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী আমি!

আমার মতো আর কেউ তো নেই যাঁর জীবনে বা স্মৃতিতে একই সঙ্গে জাতির পিতা এবং জাতির পিতার কন্যার মমতার স্পর্শ লেগে আছে!

টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত এই অপরূপ দৃশ্যটি মুহুর্তেই সারা দেশ তো বটেই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে গেলো।

একুশে পদকের মতো রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মানের পদকের সঙ্গে আমি পেয়ে গেলাম আমার জীবনের সেরা গৌরবের আরেকটি অনুষঙ্গ।

প্রথমটি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া দ্বিতীয়টি তাঁর সুযোগ্য কন্যার কাছ থেকে।

আহা! দেশের একজন ছড়াকারের কী সৌভাগ্য!!

‘একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে’………

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent