মঙ্গলবার - মে ১৪ - ২০২৪

অন্য অনুভূতির এক ফুটবল

ছবি পিটার গ্লেজার

সালটা তিরানব্বই। রোজার মাস। কলকাতায় চলছে চার্মস কাপ ফুটবল। আর সে টুর্ণামেন্টে খেলবে আবাহনী ও ঢাকা মোহামেডান। সাথে আছে সে সময়ে উপমহাদেশের সাড়া জাগানো কলকাতা মোহামেডান, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান এবং মহিন্দরের মতো বাঘা বাঘা সব দল। ফলে টুর্ণামেন্টের আকর্ষণ ছিলো আকাশচুম্বী। আর এ টুর্ণামেন্ট কভার করার জন্য আবাহনী শিবির দু’জন সাংবাদিক নিয়ে যায় কলকাতায়। সে সময় আবাহনীর দাপুটে কর্মকর্তা ও জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার হেলাল ভাই (গোলাম রব্বানী হেলাল) আমন্ত্রণ জানালেন। বেছে নিলেন বাংলার বাণী থেকে আমাকে আর জনকন্ঠ থেকে আরিফ রহমান শিবলীকে। আমরা দু’জনই সমবয়সী এবং বন্ধু। তারপরেও আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। একে তো রোজার মাস, তার ওপর ক’দিন আগেই ফিরেছি থাইল্যান্ড থেকে এশিয়ান ভলিবল কভার করে। কিন্তু হেলাল ভাই নাছোড়বান্দা। তাঁর বেইজিং চাইনিজ রেস্টুরেন্টে দুপরের খাবার খেতে খেতে হঠাৎই চার্মস কাপ কভার করার এই আমন্ত্রণ। আমার সাথে তখন ইনকিলাবের ক্রীড়া সম্পাদক রেজাউর রহমান সোহাগ। সোহাগও কিছুটা জোর করতে থাকায় গড় রাজি হলাম। পুরোটা মত না দেয়ায় হেলাল ভাই সরাসরি বাংলার বাণী অফিসে এসে সম্পাদক সেলিম ভাইকে (শেখ ফজলুল করিম সেলিম) বললেন, চার্মস কাপে বাবুকে চাই। সেলিম ভাই ডেকে নিয়ে বললেন, যেতে হবে। এটা আবাহনী। ওদের বলে দিয়েছি তোকে ফাইভ স্টার হোটেলে রাখার জন্য। কি আর করা! বাসায় ফিরে মা’কে বলতেই মা ক্ষেপে গেলেন। বললেন, দেশে থেকে বাইরে ঈদ করা যাবে না। সুতরাং তুমি যাচ্ছো না…। মায়ের এ কথা বলার পেছনে কারণ ছিলো টুর্ণামেন্টের ফাইনালের তারিখটা পড়েছিলো একেবারে ৩০ রোজার দিন। তাই যদি কোনো কারণে ২৯ রোজা হয় তবে আমাকে ঈদ করতে হবে কলকাতায়। অনেক বুঝিয়ে ম্যানেজ করলাম মাকে।
সে যাইহোক, আবাহনী ও মোহামেডান যে রাতে কলকাতার পথে বিমানে উড়লো, ঠিক পরদিন আমি বিমানে চাপলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে। কিন্তু কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে নেমেই হোঁচট খেলাম। ইমিগ্রেশন অফিসার আমার দিকে একবার তো পাসপোর্টের দিকে আরেকবার দেখছে আর কি যেনো পরখ করছে। চাওয়া-চাওয়ির এক পর্যায়ে বললো, ‘দাদা, আপনাকে ঘুরিয়ে দিলাম।’ মানে? ইমিগ্রেশন অফিসার এবার বললো, পাসপোর্টে যে উচ্চতা লিখেছেন তার সাথে আপনার উচ্চতার মিল পাচ্ছি না। তাই ফিরে যেতে হবে। ভাবলাম এ কী কান্ড! উপায় অন্তর না দেখে এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করলাম পূর্ব পরিচিত সাংবাদিক আনন্দবাজার পত্রিকার রুপক সাহাকে। ঘটনা শুনে রুপক দা বললেন, ও কিছু না। ‘ছালারা ছ্যাচরামি করছে। হাতে দুটো সিগারেট গুজে দাও, পাসপোর্টে স্ট্যাম্প লাগিয়ে দেবে।’ সত্যি তাই, টনিকের মতো কাজ হলো। ব্যাগ থেকে বেনসন এন্ড হেজেজের একটা প্যাকেট বের করে হাতে দিতেই পাসপোর্টে স্ট্যাম্প মেরে দিলেন সেই ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা! ব্যস, এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গ্র্যান্ড হোটেলে।
হোটেলে পৌঁছে বিশ্রামের তেমন একটা সময় পেলাম না। কারণ ঘন্টা খানেক পরেই ইস্টবেঙ্গল মাঠে আবাহনী সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ খেলবে কোলকাতা মোহামেডানের বিরুদ্ধে। আগের বিকেলে ঢাকা মোহামেডানও সরাসরি কোয়ার্টার খেলে কোলকাতা মোহনবাগানকে ন্যূনতম গোলের ব্যবধানে হারিয়ে সেমিতে উঠে বসে আছে। সুতরাং আবাহনীকেও কোয়ার্টার ফাইনালের সিড়ি ভেঙে সেমিতে চড়তে হবে। কোলকাতা মোহামেডান তখন দূর্দান্ত ফর্মে থাকা দল। কিন্তু আবাহনীর কাছে এ ম্যাচে দাঁড়াতেই পারলো না মোহামেডান। কিন্তু ম্যাচেই ঘটে গেলো অন্যরকম এক অপ্রীতিরক ঘটনা। কোলকাতা মোহামেডানের বিরুদ্ধে আবাহনী যখন ২-০ গোলে এগিয়ে তখন হঠাৎ করেই কোলকাতা মোহামেডানের সমর্থকরা অকস্মাৎ মাঠে ঢুকে আবাহনীর খেলোয়াড়দের ওপর মারমুখী হয়ে ওঠে। পাশাপাশি গ্যালারী থেকে মাঠে বৃষ্টির মতো পড়তে থাকলো ইট পাটকেল। অল্পের জন্য মাথায় আঘাত পাওয়া থেকে বেঁচে যান অধিনায়ক রুমি। খেলা বন্ধ থাকলো কিছুক্ষণের জন্য। প্রেস বক্সে তখন ভারতীয় সাংবাদিকদের সাথে বসা আমি ও শিবলী। ওরা একটু লজ্জাই পাচ্ছিলো। কোলকাতা মোহামেডানের এ উগ্র আচরণ দেখে। ২০ মিনিটের হট্টগোল শেষে খেলা আবার মাঠে গড়ালো।
মিজানের হ্যাট্রিকের সুবাদে ৩-১ গোলের জয় নিয়ে বীরদর্পে মাঠ ছাড়লো আবাহনী।
এবার সেমিফাইনালের লড়াই। দেশের ফুটবল ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়। বিদেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো (এখন পর্যন্ত একমাত্র) ঢাকা ফুটবলের দুই পরাশক্তি আবাহনী ও মোহামেডান মুখোমুখি হচ্ছে। দারুণ উত্তেজনা দেশ ও দেশের বাইরে। ঢাকায় ফোন দিলাম। বুঝলাম একই দৃশ্য। হাইভোল্টেজ এ ম্যাচকে ঘিরে মা-ছেলেতে তর্ক হচ্ছে। তর্ক হচ্ছে বাবা-মেয়েতে। তর্ক হচ্ছে কর্তা–গিন্নির মধ্যে। চলছে বাজি ধরাধরি। আর ঘরে ঘটছে মধুর বিচ্ছেদ আর মধুর মিলন। এদিকে, গ্র্যান্ড হোটেলে ঢাকা মোহামেডান সেকেন্ড ফ্লোরে আর আবাহনী থার্ড ফ্লোরে। রীতিমত আঁড়ি দিয়ে চলা। কেউ, কারো মুখ দেখতে নারাজ! আমি আর শিবলী দোতালা-তিনতলা ঘুরে প্রি-ম্যাচ ইন্টারভিউ করলাম আবাহনীর অধিনায়ক রুমি আর মোহামেডান অধিনায়ক কায়সার হামিদের। অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করলাম কোনো রকম ব্যতিক্রম নেই। দেশে এমন প্রি-ম্যাচ ইন্টারভিউতে যে মেজাজে থাকেন দুই শিবিরের অধিনায়করা, এদিনও তেমনি মেজাজে দুই অধিনায়ক। যেনো দু’দলের খেলোয়াড়দের মাঝে দা-কুড়াল সম্পর্ক। এদিকে, দু দলের টাগ অব লড়াই দেখতে যশোর বেনাপোল হয়ে শত শত সমর্থক কলকাতায় ঢুকেছে। বিকেলে ইস্টবেঙ্গল মাঠে গিয়ে দেখি, স্টেডিয়াম দর্শকে টইটুম্বুর। আবাহনীর ড্রেসিংরুম থেকে বেড়িয়ে আমি মোহামেডানের ড্রেসিংরুমে ঢুকতেই বাধা পেলাম মোহামেডান কোচ প্রতাপ শংকর হাজরার কাছে। অনেকটা উচ্চ স্বরেই বারণ করলেন রুমে যেনো না ঢুকি। একটু থমকে গেলাম। দাদা তো এমন আচরণ কখনো করেননি, বরং ক্লাবে গেলে আদর-যতœ করে পাশে বসিয়ে কথা বলতেন। অথচ এ কী রূপ দেখলাম তার! ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবলাম, দাদাদের দেশে আসায় হয়তো দাদার এমন দাদাগিরি! দেশে ফিরে এ ঘটনা নিয়ে আলাদা একটি রিপোর্টও করেছিলাম। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মোহামেডান সমর্থকরা বাংলার বাণী অফিসের সামনে ককটেল ফুটিয়েছিলো বেশ কয়েকটি।
সে যাইহাক, আবাহনী ও ঢাকা মোহামেডানের মধ্যে সেমিফাইনাল শুরু হলো। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। চরম উত্তেজনার ম্যাচ। মোহামেডান স্টপার রেহান তো এক ফাউলকে কেন্দ্র করে হাতাহাতিতে জড়িয়ে যান গাউসের সাথে। প্রতিদ্বদ্বিতাপূর্ণ এ ম্যাচের শেষ প্রান্তে এসে মামুন জোয়াদ্দারের ক্রসে মিজান দর্শনীয় গোল করে আবাহনীকে পৌঁছে দেন ফাইনালের রথে। অবশ্য ঢাকা মোহামেডান একবার বল ফেলেছিলো আবাহনীর জালে। গোল লাইনের কিঞ্চিৎ ভেতর থেকে গোলরক্ষক মহসীন সে বল মাঠে ফেরৎ পাঠালেও রেফারী মোহামেডানের দাবি নিয়ে ছুটে আসা খেলোয়াড়দের গোলের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দেন। অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ছাড়াই শেষ হলো এ ম্যাচ। খেলা শেষে হোটেলে ফিরলাম। মোহামেডান শিবিরে তখন কান্নার রোল, অপরদিকে আবাহনীর শিবিরে সকালের রদ্দুর।
দু’দিন বাদেই ফাইনাল। ঠিক ৩০ রোজার দিন। ভাগ্যিস সেবার ৩০টি রোজাই হয়েছিলো। ফাইনালে আবাহনীর প্রতিপক্ষ ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। দূর্দান্ত এক ম্যাচ দেখলো স্টেডিয়াম ভর্তি দর্শক। হাইভোল্টেজ ম্যাচে গাউস ও মামুন জোয়াদ্দারের দর্শনীয় দুটি গোল আবাহনীকে জিতিয়ে দেয় চার্মস কাপ। মামুন হন টুর্ণামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। সব ম্যাচে গোল পাওয়া মিজান ফাইনালে গোলের মুখ না দেখলেও হাতিয়ে নেন সর্বোচ্চ গোলদাতার (৭ গোল) ট্রফিটি।
সে এক অসাধারণ দৃশ্য! সারা মাঠ জুড়ে আবাহনীর তখন ল্যাপ অব অনার। এক পর্যায়ে অটোগ্রাফের ফাঁদে পড়ে যান আবাহনীর সব তারকা খেলোয়াড়রা। অটোগ্রাফ নিতে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঝাঁক সুন্দরী তো রুমি, মুন্নাদের জড়িয়ে ধরে চুমা খাওয়া শুরু করেন। কোনোভাবেই ছাড়তে নারাজ। পরে পুলিশ এসে রুমি ও মুন্নাকে উদ্ধার করে।
এবার হোটেলে ফেরার পালা। অসাধারণ এক সাফল্যে হোটেলের সর্বত্র আনন্দ উল­াস। খেলোয়াড়দের প্রত্যেকের হাতে হাতে হারুন ভাই পৌঁছে দিলেন বোনাস মানি। বাদ গেলাম না আমি ও শিবলী! আত্মতৃপ্তির অস্পর্শ এক মজায় তখন আমরা দুজন। কারণ এতো সাংবাদিকের ভিড়ে শুধু আমি আর শিবলী হয়ে থাকলাম ইতিহাসের সাক্ষী। দেশের বাইরে, বিদেশের মাটিতে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ কভার। আর কোন দিন কারো ভাগ্যে জুটবে কী!
পরদিন ঈদ। তাই বাক্স-পেটরা গোছানোর পালা। সকালে ফ্লাইট। কিন্তু বিধি বাম। বিমানের ফ্লাইট গোলযোগে সকালের বিমান ছাড়লো বিকেলে। লালমাটিয়ায় নিজ বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। মা তখন দরজায়। অনেকটা আক্ষেপের স্বরে বললেন, ঈদটা মাটি করলি?

মন্ট্রিয়র, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent