রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

হোমিকরসিন

একদল গবেষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে আবিষ্কার করেছেন হোমিকরসিন

পাট থেকে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এর সন্ধান পেয়েছেন বাংলাদেশের একদল বিজ্ঞানী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর হাসিনা খান, অধ্যাপক রিয়াজুল ইসলাম এবং জীন প্রকৌশল ও জৈব প্রজুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আফতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল গবেষক অক্লান্ত পরিশ্রম করে আবিষ্কার করেছেন হোমিকরসিন (Homicorcin) নামের নতুন একটি অ্যান্টিবায়োটিক। পাট গাছের শরীরে থাকা একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে এই অ্যান্টিবায়োটিক। কাজটি করা সম্ভব হয়েছে পাটের জীবন রহস্য উণ্মোচন উন্মোচন করার পর। বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ডক্টর মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে এক দল গবেষক তোষা পাটের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচন করে ২০১৩ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) ও বেসরকারি তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক সংস্থা ডাটা সফট যৌথভাবে গবেষণার কাজটি করে। পাটের জীবনরহস্য বা জিন নকশা (জিনোম সিকোয়েন্সিং) বের করার গবেষণায় পূর্ণতা পায় বাংলাদেশ। গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব হাওয়াই ও ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স মালয়েশিয়ার কাছ থেকে। এই গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত বিজ্ঞানীরা জানান এর মাধ্যমে পাটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈচিত্র আনা সম্ভব হবে।

পাটের ডিএনএ (DNA) কে বোঝার চেষ্টা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগ এর প্রফেসর ড. হাসিনা খান ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা। পাটের জীবন রহস্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এর বিভিন্ন অংশে থাকা নানা রকম অনুজীবের সন্ধান পান। ল্যাবরেটরিতে পাটের বীজ ব্যবহার করে যে সমস্থ ডিএনএ বিজ্ঞানীরা পান তা বিশ্লেষণ করে তারা একটু বিস্মিত হন। তারা দেখতে পান, উদ্ভিদ ডিএনএ তো আছেই সেই সাথে অণুজীবেরও অনেক ডিএনএ রয়েছে। প্রথমে তারা ভেবেছিলেন হয়ত কোনভাবে ল্যাবের ছাত্র-ছাত্রিরা অন্য অণুজীবের সাথে সংক্রমণ করে ফেলেছেন। অণুজীব হলো সেই সকল ক্ষুদ্র এককোষী জীব যাদেরকে খালি চোখে দেখা যায় না। সকল প্রকার ব্যাকটেরিয়া, আরকিয়া, প্রোটোজোয়া, এককোষী শৈবাল এবং ছত্রাক অণুজীবের অন্তর্গত। প্রত্যেক উদ্ভিদেরই সাথে ওতপ্রোত ভাবে বাস করে কিছু অণুজীব। গাছের নানা জায়গায় যেমন, পাতায়, কান্ডে, শিকড়ে বসবাস করে বিভিন্ন ধরণের ফাঙ্গাস, ব্যাকটেরিয়া, ইত্যাদি অণুজীব। শিকড়ে এক রকমের, কান্ডতে আর এক রকমের অণুজীব অবস্থান করে।

- Advertisement -

বিজ্ঞানীরা পাটের বীজ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বেশ কিছু অণুজীবের সন্ধান পান, যা দেখে বিজ্ঞানীদের মনে হলো এই অনুজীব এমন কিছু তৈরি করছে যা ভবিষ্যতে তাদের কাজে আসবে। এই অনুজীব বা ব্যাকটেরিয়ার বিশেষ এক ধরণের বৈশিষ্ট আছে। বিশেষ করে এটি অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল কম্পাউন্ড তৈরি করে, যার খুবই প্রয়োজন এখন মানুষের চিকিৎসার জন্য। এদেরকে আরও ভালো করে স্টাডি করে প্রফেসর রিয়াজুল ইসলাম দেখতে পান পাটের তন্তুর খাঁজে খাঁজে ৫০টিরও বেশী অনুজীব বা ব্যাকটেরিয়া বাস করে। সেই সব ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে স্টেফাইলোকক্কাস হোমিনিস (Stephailococcus hominis) নামে একটি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। এই ব্যাকটেরিয়া তার শরীর থেকে এমন কিছু তৈরি করে যা দ্বারা আশেপাশের অন্য ব্যাকটেরিয়া মারা যায়।

তারা যে মাইক্রো-অর্গানিজম বা অণুজীব পাচ্ছিলেন সেগুলো তারা আইসোলেট করেন বা পৃথক করেন। আইসোলেট করতে গিয়ে এবং এর ক্যারেক্টারাইজ করতে গিয়ে তারা দেখতে পান যে এই ব্যাকটেরিয়াটি খুবই ইন্টারেস্টিং। এই ব্যাকটেরিয়াটির নাম স্টেফাইলোকক্কাস হোমিনিস যা তারা পরবর্তীতে জানতে পারেন। এই ব্যাকটেরিয়াটি খুবই ভালো অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল একটিভিটি দেখায়, যে সমস্ত গুণাবলী অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির জন্য প্রয়োজন। তাদের কৌতূহল বাড়ালো এই ব্যাকটেরিয়াটি। কম্পাউণ্ডটা কি সেটা তারা দেখার চেষ্টা করলেন। ধারণা করলেন, এই ব্যাকটেরিয়ার জিনোমের মধ্যেই এই অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করার পুরো ইনফরমেশন আছে। বিজ্ঞানীরা এই ব্যাকটেরিয়ার হোল জিনোম সিকুয়েন্স করেন এবং এনালাইসিস করার পর তারা এর পুরো জিন ক্লাসটার খুঁজে পান। যখন এই অ্যান্টিবায়োটিক এর প্রিলিমিনারি জিন স্ট্রাকচারটা তারা জিন ক্লাস্টারের মধ্যে দেখতে পেলেন, তখন দেখলেন যে এটা একটি নোবেল অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল পেপটাইড। অনেক ধরণের ব্যাকটেরিয়া এই ধরণের অ্যান্টি-মাইক্রবিয়াল পেপটাইড তৈরি করে। এটি নতুন ধরণের একটি অ্যান্টিবায়োটিক বা ল্যান্টিবায়োটিক। তাহলে কি আছে এই ব্যাকটেরিয়ায়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজ শুরু করেন জিন প্রকৌশল ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আফতাব উদ্দিন। বেরিয়ে আসে নতুন এই অ্যান্টিবায়োটিক এর খোঁজ যা বাঁচিয়ে দিতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্ট হয়ে যাওয়া অনেক রোগীর প্রাণ। ব্যাকটেরিয়া আইসোলেট করা এবং কালচার করা প্রফেসর হাসিনা এবং তার গ্রুপের কাজ ছিল।

তারপর এটাকে যখন এস্টাবলিশ করা হলো যে, ব্যাকটেরিয়াটিকে কোন স্টেজে কত সময় ফারমেন্টেশন বা কালচার করলে মিডিয়ার মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকটি পাওয়া যায়। এর পর পিউরিফিকেশন পার্টটা করেন প্রফেসর আফতাব উদ্দিন। খুবই পরিশ্রমের কাজ ছিল। তার সাথে ছিল শাম্মি আক্তার নামে এনআরআই এর একজন ছাত্রি। প্রথমে তারা একটি ব্যাকটেরিয়া নিয়েই কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে তারা ৫টি ভ্যারিয়ান্ট পান। বিভিন্ন স্টাডি যেমন, ফিজিক্যাল ক্যারেকটারিসটিকস এবং কেমিক্যাল ক্যারেকটারিসটিকস পাওয়ার জন্য তাদেরকে সরবাত্মকভাবে আত্মনিয়োগ করতে হয়। তিন বছর ধরে চলে এই গবেষণা। তাদের সাথে কাজ করেছেন বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা কাউন্সিলের (বিসিএসআইআর) সদস্য এএইচএম শফিউল ইসলাম মোল্লা। এছাড়া গবেষক হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিভাগের শিক্ষার্থী শাম্মি আক্তার, মাহবুবা ফেরদৌস, বদরুল হায়দার এবং আল আমিন। অনেকদিন ধরে অনেক পরিশ্রম করে একটি নতুন অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল কম্পাউন্ড পান তারা। ব্যাকটেরিয়া ও পাটের নামের সাথে মিল রেখে এই নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এর নাম দেওয়া হয় হোমিকরসিন (Homicorcin)।

বিজ্ঞানীদের জন্য এই ধরণের কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং সফলতা খুবই আনন্দের ছিল। বাংলাদেশে এই ধরণের কাজ খুব একটা সহজ না।  তারা একসাথে সহযোগিতা করে অনেকে মিলে কাজটি করতে সক্ষম হন। এটা ছিল একজন মানুষের জন্য একটি ছোট্ট পদক্ষেপ কিন্তু গোটা মানব জাতির জন্য বা জীব জগতের জন্য এটা একটা বড় স্টেপ। এই অ্যান্টিবায়োটিকটি নিয়ে জাপানে ও ইংল্যান্ডে কাজ হচ্ছে। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এটা নিয়ে কাজ করছেন। যে সমস্ত অণুজীব আমাদের শরীরে রোগ জীবাণু তৈরি করে তারা অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক এ রেজিসট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা মানুষের জন্য বড় একটি দুর্যোগ। সেই কারণেই কাজটি তারা হাতে নেন। অনেকটা সময় ধরে, অনেকের সাথে মিলে কাজ করে তারা নতুন একটি অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল কম্পাউন্ড পান পাটের মধ্য থেকে। তাদের গবেষণা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি বিশ্বখ্যাত জার্নাল সায়েন্টিফিক রিপোর্টস (Scientific Reports) এ প্রকাশিত হয়।

দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে ব্যাকটেরিয়ার নতুন নতুন স্ট্রেইন। আমাদের আশপাশে এমনও অনেক ব্যাকটেরিয়া আছে যেগুলি প্রচলিত সমস্ত অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সফল হয়েছে, যা সারা বিশ্বের কাছে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যবহৃত বেশীর ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক এর সাথেই মানব দেহে রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া খাপ খাইয়ে ফেলেছে অর্থাৎ যে সমস্ত ব্যাকটেরিয়া আমাদের শরীরে রোগজীবাণু তৈরি করে তাদের বেশীরভাগই প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক এ রেজিসট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালেও রোগীরা সুপারবাগ নামে পরিচিত এমন কিছু ব্যাকেটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছেন যা প্রচলিত কোন অ্যান্টিবায়োটিকে নিরাময় হচ্ছে না। তাই নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের খোঁজে জোর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশ। সারা পৃথিবী হন্যে হয়ে খোঁজ করছে নতুন অ্যান্টিবায়োটিকের । বিভিন্ন দেশের ল্যাবরেটরিতে সেটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো হতাশ হয়ে পড়েছে। সেখানেও সফল হচ্ছে এই নুতন অ্যান্টিবায়োটিক।

এই রেজিসট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার নাম Staphylococcus aureus যার ইনফেকশন হাসপাতাল থেকে হয়। হাসপাতালে যারা ভর্তি হন তাদের মধ্যে এই ইনফেকশনটা বেশী হয়। এই স্ট্রেইনটা হাসপাতাল থেকে আসে। খুব কম অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করতে পারে এর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত এই নুতন অ্যান্টিবায়োটিক এই ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে খুব ভালোভাবে কাজ করতে পারে বলে মন্তব্য করছেন বিজ্ঞানীরা। Vancomycin এমন একটি অ্যান্টিবায়োটিক যাকে লাস্ট রিসোর্ট বলা হয়। ডাক্তাররা রোগীকে শেষ পর্যায়ে Vancomycin দেন। খোঁজার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এই ধরণের ড্রাগ রেজিসট্যান্স এর বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে বা কাজ করছে এমন কোন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক। সেখানেও সফল হয়েছে এই নুতন অ্যান্টিবায়োটিক। এই অ্যান্টিবায়োটিক এর মোট ৫টি ধরণ পেয়েছেন তারা, যা অ্যান্টিবায়োটিক এর ইতিহাসে এক নুতন দিগন্ত উন্মোচন করবে। যেখানে লেখা থাকবে বাংলাদেশের নাম।

নতুন অ্যান্টিবায়োটিক এর আবিষ্কার নিয়ে উচ্ছ্বসিত চিকিৎসকমহলও। হোমিকরসিন অ্যান্টিবায়োটিক কত দ্রুত জনসাধারণের নিকট পৌছাবে সেটা নির্ভর করছে সরকার ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো থেকে পাওয়া পর্যাপ্ত ফান্ডিং এবং কার্যক্রমের উপর। সাধারণত যে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বাজারজাত করতে কমপক্ষে পাঁচ বছর সময় লেগে যায়। তাই প্রাণ রক্ষাকারী এই ঔষধের দ্রুত প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারী ও বেসরকারী সব মহলের যৌথ উদ্যোগ একান্ত প্রয়োজন কারণ এই অ্যান্টিবায়োটিকের জন্যই হয়ত উন্মুখভাবে অপেক্ষমাণ রয়েছে সারা বিশ্বের অজস্র অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট মানুষ।

- Advertisement -

Read More

Recent