রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

সুরের মানুষ জাহিদ হোসেন

জাহিদ ভাইয়ের ভুবন ভুলানো হাসির আড়ালে কী লুকিয়ে রাখেন কে জানে

জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ কালে সুরকার আলাউদ্দিন আলীর প্রসঙ্গ আসলেই – তিনি প্রায় স্তব্ধ হয়ে যান! আমি জানি এই স্তব্ধতা তাঁর ভিতরে তোলপাড় করা এক সঙ্গীত সাধকের প্রতি সম্মান। মাঝে মাঝে স্তব্ধতা ভেঙ্গে এরকম ভাবে আলাউদ্দিন আলীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠেন যে, মনে হয় আলাউদ্দিন আলীর প্রশংসা করা যায়, বা তাঁর গুণের কদরকে পুরোপুরিভাবে ভাষায় প্রকাশ করা যায় এরকম শব্দবন্ধের বাক্য গঠন করতে তিনি অপারগ। তিনি বলেন – ভাইজান, এই দেখেন আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। আলাউদ্দিন আলী যে কত বড় গুণী সঙ্গীত সাধক – মনে হলেই আমার শরীরে কাঁটা দেয়! এতো গুণ, এতো বহুমুখী প্রতিভা- আমাদের দেশে কেন, আমাদের কালে কেন, যে কোন জাতির, যে কোন ভাষার, যে কোন সময়েরই এক শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব। এ কথাগুলো বলেই তিনি আবার নীরব হয়ে যান। অনেকক্ষণ পরে আবার বলেন – কী মনে করাইয়া দিলেন ভাইজান! আলাউদ্দিন আলী বাপরে বাপ! কী যে এক সম্পদ আমাদের সঙ্গীত জগতের!
জাহিদ ভাইয়ের এই কথাগুলো যে তাঁর কথার কথা নয়, তা অনুভব যায় তাঁর হৃদয় উৎসারিত আবেগ প্লাবিত মায়াভরা কথায়৷ তবু মনে হয় আলাউদ্দিন আলীর গুণ সম্পর্কে উপযুক্ত উপমা-বিশেষণের অভাবে তাঁর অনুভবের মাত্রাটি অপ্রকাশের ভারে তিনি অস্থির! আলাউদ্দিন আলী সম্পর্কে ২৪ ঘন্টা প্রশংসা বাক্য বলার পরেও জাহিদ ভাইয়ের অন্তরের ভিতরে না বলা কথার ঢেউয়ের কূলপ্লাবী চাঞ্চল্য অনুভব করা যায়। যেরকম অনন্যসাধারণ মাত্রায় অনুভবের সুক্ষ্ম তারে ওস্তাদ বেলায়েত কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্টির কথা বহুধা বিস্তারে বলার পরেও অপ্রকাশের ভারে নতজানু হয়ে অতৃপ্তির কথাটা বলেন জয় গোস্বামী। যেরকমভাবে গালিব কিংবা জয় গোস্বামীর কথা বলতে গিয়ে অপ্রকাশের ভারে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন শ্রীজাত।
আমি তখন আলাউদ্দিন আলীর সর্বব্যাপী সৃষ্টির কথা বলতে শোনা জাহিদ হোসেনকেই দেখি। তখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সেই পঙক্তির কথা আমার আবার মনে পড়ে-
‘চাঁদ তুমি সুন্দর?
নাকি তোমার দিকে চেয়ে থাকা পাগল সেই চোখ!’
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ওস্তাদ বেলায়েত খাঁ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, শ্রীজাত প্রমুখ সৃষ্টিশীলরা তাদের ভিতরে মানুষের আকুল কান্নার উদ্বেলিত ঢেউয়ের সাগরকে ধারণ করে আছেন। মানুষের জন্য মায়ায় মোড়ানো স্নিগ্ধ অনুভবের সুন্দর প্রকাশটিই মাত্র। মানুষের ভিতরের অপ্রকাশিত কান্নার দগ্ধতাটুকু পান পরে আমাদের চর্মচক্ষুর আড়ালে যন্ত্রণায় নীল হয়ে থাকেন। জাহিদ ভাইয়ের ভুবন ভুলানো হাসির আড়ালে কী লুকিয়ে রাখেন, কে জানে!

২.
জাহিদ ভাইকে আপনি জিগ্যেস করুন – কেমন আছেন? উত্তরটা তাঁর হাসিতেই ফুটে উঠবে। সুগন্ধী পান বাহার মুখে দেওয়া জাহিদ হোসেন এক সৌরভ ছড়ানো হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেবেন তিনি কত ভালো আছেন। সন্তুষ্টি আর স্বস্তির এক অপরূপ যুগলবন্দীর নাম জাহিদ হোসেন। কোন অভিযোগ নেই। কোন অসন্তুষ্টি নেই। কোন তাড়া নেই। কোন চাহিদা নেই। কথা কেড়ে নিয়ে নিজের কথাটি বলার কোন তাড়না নেই। ছোট-বড় সকলকে সম্মানিত সম্বোধনে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে রাখেন তিনি। যেমন তানজীর আলম রাজিবকে, যেমন জুনায়েদ আনোয়ার চয়নকে, যেমন রনি পালমারকে, যেমন সোহেল ইমতিয়াজকে।
মানুষকে সম্মান দেখাতে এমন আনত হৃদয় উৎসারণ আমাদের চারপাশে সাধারণত দেখা যায় না। একটা গল্প বলি- একদিন গ্রীষ্মের এক রৌদ্রজ্বল দুপুরে জাহিদ ভাইয়ের বাসার এপার্টমেন্টে গিয়েছি। তাঁর বাসার ভিতরে দক্ষিণ মুখি বিশাল কাঁচের জানালা ভেদ করে দুটি বৃক্ষের চূড়ার ডাল-পাতার ছায়া এসে পড়ে ঘরের মেঝেতে। খাবার টেবিলে বসলে দক্ষিণের অবারিত দৃশ্যপটে দেখা যায় বাচ্চাদের স্কুল। ছোট ছোট ঘরবাড়ি। তারপর বড় রাস্তায় চলাচলকারী হরেক রকমের যানবাহন। যানবাহন চলাচলকারী বড় রাস্তার ওপারে দেখা যায় উঁচু উঁচু চারটি অট্টালিকা। সেদিন দুপুরে খাবার টেবিলে বসে ঐ উঁচু অট্টালিকার একটিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে জাহিদ ভাই বললেন – ‘ জানেন ভাইজান, আমি ঐ যে বিল্ডিং দেখা যায়, সেটার দিকে আমি প্রায়ই তাকিয়ে থাকি। দেখি আর ভাবি, এই বিল্ডিংয়েই বাস করেন কবি আসাদ চৌধুরী। কী যে ভালো লাগে আমার ভাবতে! জানেন, এখনো উনাকে দেখলে আমার শরীর কাঁপে। মনে আছে, অনেকদিন আগে টেলিভিশনে তিনি আমাকে একটি সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকলেন। আমি তো ভয়ে অস্থির! একটু আধটু বাজাই। কী ভুলভাল বাজাই কে জানে! সেই আমার আবার সাক্ষাৎকার। তাও কবি আসাদ চৌধুরীর সাথে। গানবাজনা সঙ্গীত বিষয়ে কত কিছু জানেন তিনি, ওরে বাপরে বাপ! আমি তো কিছুই জানি না। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপা শুরু হয়েছিল! অথচ, তিনি আমাকে এতো আপন করে, এতো সম্মান করে কথা বলে গেলেন যে, সময় কোনদিকে ফুরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আজ আমি যখন ভাবি, তিনি ঐ বিল্ডিংয়ে থাকেন, আমার খুব ভালো লাগে! আমি শুধু ঐ বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি!’
আমি জাহিদ ভাইকে দেখি আর ভাবি, অজ্ঞতা, মূঢ়তা ও কপটতার চূড়াস্পর্শে বসে যখন আমরা অহংকারের দৃষ্টিতে সবকিছু ছোট ছোট দেখি; তখন, তাঁর মতো সত্যিকার সৃষ্টিশীল মানুষেরা বিনয়ের মাটিতে নেমে অহংকারের আসল রত্নকে আকাশচুম্বী উচ্চতায় তুলে কত সম্মানিত বোধে বিবেচনা করেন!

- Advertisement -

আমাদের কত আনন্দ, সুরের মানুষ, সুন্দর মানুষ জাহিদ হোসেনও এই শহরে বসবাস করেন।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent