আইনস্টাইন যখন আণবিক ফিউশন বিষয়টি আবিস্কার করেন তখন কি ভেবেছিলেন বিষ্ফোরণের পরিণাম কি ভয়াবহ হবে! মাইকেল জুকারবার্গ ফেসবুক উদ্ভাবনের সময় কি ভেবেছিলেন এর পরিণতি কি হতে পারে!
ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম মানুষকে শুধু যে বিপদজনক আসক্তির গহŸরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে শুধু তাই নয়; কেড়ে নিচ্ছে মানুষের উপর তার নিয়ন্ত্রণ শক্তি।
রিনা (ছদ্মনাম) একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কাজ করে। থাকে বনানীর এক আধুনিক এপার্টমেন্টে। স্বামী ব্যাংকের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তা। এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে চলছিল তার সুখের সংসার। দশম বিবাহ বার্ষিকীতে স্বামী তাকে একটি স্মার্টফোন কিনে দেয়। সেই থেকে ফেসবুক আর ভাইবারের মাধ্যমে পরিচয় হয় রিনার। ধীরে ধীরে ভাইবারে আসক্ত হয়ে পড়ে সে। পরিচয় হয় আমেরিকা প্রবাসী এক যুবকের সাথে। স্কুলের পর বিকেল বেলাটা রিনার নিঃসঙ্গ কাটে। স্বামী ব্যাংক থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। এই ফাঁকে এই ছদ্মবেশী প্রেমিক মিষ্টিমধুর ইলেকট্রনিক মেসেজ পাঠিয়ে ঢুকে পড়ে রিনার মনজগতে। প্রথম প্রথম রিনা ব্যাপারটাকে মজার খেলা হিসেবে নিয়েছিল। পরে একসময় সে নিজের অজান্তে এই যুবকের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। একদিন গভীর রাতে মাহফুজ ঘুম থেকে উঠে দেখে রিনা স্মার্টফোনের ভাইবারে চিরকুট চালাচালিতে ব্যস্ত। সেই থেকে মাহফুজের মনে ঢুকে পড়ে সন্দেহ। শুরু হয় সংসারে অশান্তি। চিড় ধরে তাদের এত দশকের দাম্পত্য জীবনে।
রিনা অনুভব করে তার জীবনে অনেক অপূর্ণ সাধ আছে যা তার স্বামী মেটাতে পারেনি। ঐ প্রবাসী যুবক তার সামনে দেবদূত হিসেবে হাজির হয়। রিনা ভাবে আসলে সে এই দেবদূতের অপেক্ষায় ছিল। মাহফুজ যে গত দশ বছর চাকুরী করে তাদের সংসার চালিয়েছে, দুটি সন্তান উপহার দিয়েছে, যখন যা চেয়েছে তা সাধ্যমত দেয়ার চেষ্টা করেছে, তার মূল্যমান রিনার কাছে ফিকে হয়ে আসে। অথচ যে দেবদূত জেনে শুনে একটি সুখের সংসারে ভাঙ্গন ধরাচ্ছে সে যে একজন শয়তানরূপী দানব সেটা বোঝার ক্ষমতা রিনা হারিয়ে ফেলেছে। বস্তুত রিনার বিচার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। অজান্তে হারিয়ে ফেলেছে নিজের মনের উপর নিয়ন্ত্রণশক্তি।
টিনা (ছদ্মনাম) একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। টিনা জানায়, ‘কি যে হয়েছে কিছুতে মন বসে না। প্রতি ১০ মিনিট অন্তর ফেসবুকে ঢুকে পড়তাম। একসময় বুঝলাম ফেসবুকে আসক্ত হয়ে পড়েছি। নানা ভঙ্গিতে ফেসবুকে নিজের ছবি পোস্ট করে দেখতাম কয়টা লাইক পড়ে। যারা লাইক দিয়েছে তারা কারা। কোনো রেস্টুরেন্ট বা অনুষ্ঠানে গেলে চেক ইন না দিয়ে থাকতে পারতাম না। যখন বন্ধুদের নতুন কোনো পোস্ট পেতাম না তখন আজে বাজে নিউজ ফিড পড়ে সময় কাটতো। সেমিস্টার শেষে দেখলাম ঠিকমত এসাইনমেন্ট জমা দিতে না পারায় রেজাল্ট খুব খারাপ হয়েছে। টিনার মত এরকম অনেকেই শুধু রেজাল্ট খারাপ নয়, চাকুরীও হারিয়েছে কাজে গাফিলতির জন্য।
ষাটের দশকে মানুষের জীবনে অতটা ব্যস্ততা ছিল না। মানুষ প্রতিবেশীর বাসায় অনায়াসে আড্ডা দিতে যেত। ছেলেরা পাড়ার মাঠে ফুটবল বা কাবাডি খেলতে যেত। মেয়েরা পুতুল খেলা, ঘর সাজানো, রান্না বান্না ইত্যাদি ঘরোয়া খেলায় মশগুল থাকতো। রাস্তায় ছিল না যানজটে সময়ক্ষেপণ। ছিল না শব্দদূষণ বা পলিউশন। সেই সময় লেখক যাযাবর তার ‘দৃষ্টিপাত’ গ্রস্থে লিখেছেন ‘আধুনিক জীবনের বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ তিনি কি ছন্দ মেলাবার জন্য এই বাক্য রচনা করেছিলেন কিনা জানি না। তবে তার এই বাণী যে কঠিন বাস্তবতায় পরিণত হবে তা কে জানতো। মূলত প্রযুক্তি যে শুধু আবেগ কেড়ে নিয়েছে তা নয়। কেড়ে নিয়েছে সুখের বিনিময়ে শান্তি। কেড়ে নিয়েছে মানুষের মনের উপরে তার নিয়ন্ত্রণ।
অনেকেই হয়তো বুঝতে পারে না যে, এই নিয়ন্ত্রণহীন আসক্তি এক ধরনের মনোবিকার। এই আসক্তি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য কাউন্সেলিং এবং সাইকো থেরাপির প্রয়োজন হয়।
অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন কাউন্সিলিং, সাইকোথেরাপি এবং মেডিকেশন নিয়ে অনেকেই আবার এই আসক্তি থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। সামাজিক যোগাযোগের আসক্তি যে মনোবিকার এটাকে অনেকেই মানতে চায় না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই মনোভাবকে বলা হয় ‘ডিনায়াল’। অর্থাৎ মনোবিকারকে অস্বীকার করা।
যারা দীর্ঘসময় অনলাইনে কাটান তাদের মধ্যে হতাশা এবং উদ্বিগ্নতার লক্ষণ বেশি দেখা যায়। যখন অন্যরা সুখী জীবনের বিবিধ ছবি পোস্ট করেন তখন অনেকেই নিজেকে বন্দী বা অসুখী ভাবেন। ফলে এক ধরনের অসহায়বোধ এবং হতাশা পেয়ে বসে। ক্রমে তা বিষন্নতায় পরিণত হয়। বিষন্নতা কেবলমাত্র মন খারাপ লাগার অনুভূতি নয়, মন খারাপ বা অসহায়বোধ একটি প্রাথমিক সংকেত। ক্রমে তা হতাশা, দুশ্চিন্তা, রাগ, হীনমন্যতায় পরিণত হয়। একসময় নিজেকে ভীষণভাবে বঞ্চিত মনে হয়। মনে হয় জীবন অর্থহীন। এই মানসিক বৈকল্য একসময় দেহের উপর প্রভাব ফেলে। বিষন্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা দূর্বলতা, ক্লান্তি, মাথাব্যাথা এবং উচ্চরক্তচাপের সমস্যায় ভোগেন।
পশ্চিমের কর্পোরেট গুরু স্টেভেন কোভে বলেছেন, মানুষের জীবনে দুটি প্রভাব বলয় রয়েছে। একটি হল ‘সার্কেল অব ইনফ্লুয়েন্স’ বা ‘ক্ষমতা/ প্রভাব বলয়’, আরেকটি হল ‘সার্কেল অব কনসার্ন’ বা ‘নেতিবলয়’ । সৃজনশীল কাজ, পড়াশোনা, গবেষণা, নেটওয়ার্ক বা অপরকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে সবার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা, পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন এবং সঞ্চয় করা ইত্যাদি ইতিবাচক বিষয়গুলো ‘ক্ষমতা/প্রভাব বলয়ের’ উপাদান। আর অন্যের বিষয়ে নাক গলানো, অন্যের সম্পদের সাথে নিজেকে তুলনা করা, কুৎসা রটানো বা যেকোনো নেতিবাচক কাজে মানুষ যখন সময় ব্যয় করে তখন সে নেতি বলয়ের গহŸরে ডুবে যেতে থাকে। কোনো মানুষের সাফল্য নির্ভর করে কোনো বলয়ে সে তার সময় ব্যয় করবে তার উপর। দেখা গেছে, সফল তারাই, যারা অধিংকাংশ সময় ব্যয় করে ক্ষমতা বলয়ে। এভাবে ক্রমেই তারা হয়ে ওঠে প্রভাবশালী, সম্পদশালী এবং ক্ষমতাবান।
সামাজিক যোগাযোগের অনলাইন মাধ্যমগুলো মানুষকে পরস্পরের সংস্পর্শে রাখে এবং প্রয়োজনে অনেক কাজে লাগে। ফেসবুকের মাধ্যমে অনেকেই খুঁজে পেয়েছে পুরনো বা হারিয়ে যাওয়া বন্ধুবান্ধব, শৈশবের সাথী, এমনকি আত্মীয়স্বজন। তবুও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অকারণে ফেসবুক বা ট্যাংগোতে সময় কাটালে তা মানুষের মনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
সামাজিক যোগাযোগের আসক্তির লক্ষণগুলো হলো-
0 ঘন ঘন নিজের ছবির পোস্টিং দেয়া
0 বন্ধু সংখ্যা বাড়ানোর জন্য অপরিচিতদের তালিকায় যুক্ত করার প্রবণতা
0 কাজ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে গোপনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুক ব্যবহার করা
0 অনলাইনের জন্য বাস্তবের জীবনকে অবহেলা করা
0 ঘন ঘন প্রোফাইল পরিবর্তন এবং তার জন্য মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া
0 কোনো নোটিফিকেশনের চিহ্ন দেখলেই উত্তেজিত হয়ে পড়া
0 রাগের মাথায় প্রতিক্রিয়াশীল কমেন্ট করে উত্তেজিত হয়ে পড়া এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা
এই জন্য এই আসক্তির গহŸর থেকে মুক্তির জন্য আপনাকে সতর্ক হতে হবে। প্রয়োজনে কাউন্সিলরের সহায়তা গ্রহণ করুন।
মানুষ হল মূলত সৃজনশীল এবং বুদ্ধিমান প্রাণী। নিজেতে প্রকাশ করার বাসনা মানুষের মধ্যে সহজাত। কিন্তু অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগের সাইটে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে যেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে। অনেকে ক্ষুদ্র বিষয়ে মন্তব্য করতে যেয়ে অযথা তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে। ফলে অনেক বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন হয়।
নিজের ছবি, নিজের সকালের খাবার, নিজের ড্রয়িংরুম, বেডরুম এসব ছবির যথেচ্ছ পোস্টিং করার ফলে একধরনের আসক্তি এসে যায়। একে বলা হয় নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেমে মগ্নতা, যা মূলত একটি মনোবিকার। অথচ নিজের ছবির বদলে আপনি যদি আপনার আঁকা একটি চিত্রকর্ম পোস্ট করেন তবে সেটা হবে ইতিবাচক সৃজনশীল কাজ। নিজের খাবারের আইটেমের বদলে আপনি যদি নতুন কোনো রেসিপির খাবার বন্ধুদের জানান এবং আমন্ত্রণ করেন তা উপভোগ করার জন্য তা হবে অনেক বেশি আনন্দদায়ক। খেয়াল রাখুন আপনার প্রকাশটা যেন হয় সৃজনশীল। তাহলেই আপনার মনের বিকাশ ঘটবে।
অনেকেই ফেসবুকে নিজের রচিত কবিতা বা কোনো মজার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। এটা কিন্তু মন্দ নয় বরং ইতিবাচক। তবে সবসময় সজাগ থাকতে হবে এসব কাজ যেন আপনার অফিস বা বাসার স্বাভাবিক কাজকর্মকে বিপন্ন না করে। বরং অবসর সময়ে বা ট্রাফিক জ্যামে আটকে পড়লে গাড়ির ব্যাকসিটে বসে একটি মধুর স্মৃতির কথা লিখে বন্ধুবান্ধব বা স্বজনদের জানাতে পারেন। স্মৃতি লিখন মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও অন্য জগতে নিয়ে যায়। ফলে মনের ওপর চাপ কমে এবং একধরনের প্রশান্তি আর আনন্দ মনে দোলা দেয়।
আসলে প্রযুক্তি মানুষের জীবনে এগিয়ে চলার জন্য একটি হাতিয়ার। কিন্তু এই হাতিয়ারের অপব্যবহারের ফল মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। পারমাণবিক বোমা যেমন ধ্বংস করেছে হিরোশিমা আর নাগাসাকী শহর। তেমনি সেই প্রযুক্তিকে ইতিবাচক কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক শক্তি আমাদের দিয়েছে বিদ্যুৎ, দিয়েছে আলোকিত রজনী।
অদূর ভবিষ্যতে ঘরোয়া রোবট এবং বাণিজ্যিক দ্রোন আসছে মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্মকে আরো সহজতর করতে। সেক্ষেত্রেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমরা যেন সেই প্রযুক্তি পণ্যকে ইতিবাচক হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাই। নয়তো সেই কৃত্রিম রোবটের কাছে নিয়ন্ত্রণহীন মানুষ হবে তার দাস।
মার্ক জাকারবার্গ স¤প্রতি তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, ‘যন্ত্র কখনো মানুষের কাছে জিততে পারবে না।’ তারপরও বলা মুশকিল। যন্ত্র যদি দানব হয়ে ওঠে তবে সে মানুষের দূর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিতেই পারে।