মঙ্গলবার - মে ১৪ - ২০২৪

বজ্র আঁটুনী ফস্কা গেরো

ছবি জন ম্যাক আর্থার আনপ্লাশ

জামিল স্যার অষ্টম শ্রেণিতে আমাদের ইংরেজি সাহিত্য পড়াতেন। ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পাঠ্য বইয়ের বাইরে তখন শেক্সপিয়ারের নাটকের ইংরেজি সহজ সংস্করণ পড়ানো হতো। ম্যাকবেথ, টেমপেস্ট, কিং লেয়ার, মার্চেন্ট অব ভেনিস ইত্যাদি। বজ্র আঁটুনী ফস্কা গেরো লিখতে গিয়ে হঠাৎ করেই মার্চেন্ট অব ভেনিসের শায়লকের কথা মনে পড়লো। এন্টোনিওর ওপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শায়লক এক কঠিন বজ্র আঁটুনী এটেছিল। গল্পটা অনেকেরই হয়তো জানা আছে। যারা পড়েননি বা মনে নেই, তাদের কথা মনে করে সংক্ষিপ্ত অবতারণা করছি।
বাসানিও ছিল ভেনিসের এক যুবক। তার প্রেয়সী পোর্শিয়া থাকে বেলমন্ট শহরে। সেখানে যাবার জন্য অর্থের প্রয়োজন। তাই সে তার ব্যবসায়ী বন্ধু এন্টোনিওর স্মরণাপন্ন হয়। কিন্তু এন্টোনিওর টাকা আটকে আছে বাণিজ্যগামী জাহাজে। তাই সে বন্ধুকে অনুরোধ করে মহাজনী সুদে অর্থ লগ্নীকারী শায়লকের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়ার জন্য।
এন্টোনিও কথা দেয় যে, সে বাসানিওর জামিনদার হবে। যেহেতু এন্টোনিও সুদ বিহীন অর্থ ধার দেয় সেই কারণে সে ছিল শায়লকের চক্ষুশূল। বন্ধুর পরামর্শমত বাসানিও শায়লকের কাছে অর্থ ঋণ চায়। জামিনদার এন্টোনিওর কথা শুনে শায়লক টাকা ধার দিতে রাজি হয়। তবে সে এক অদ্ভুত শর্ত জুড়ে দেয়। শর্তটি হল নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এন্টোনিও যদি ঋণকৃত অর্থ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে সে এন্টোনিওর এক পাউন্ড মাংস কেটে নেবে। শর্তটি অদ্ভুত হলেও এন্টোনিও রাজি হয়। কারণ সে জানে বন্দরে জাহাজ ভিড়লেই সে টাকা পেয়ে যাবে।
বাসানিও ঋণের টাকা পেয়ে ধনবতী প্রেয়সী পোর্শিয়ার সাথে দেখা করার জন্য বেলমেন্ট গমণ করে। এদিকে বিধি বাম। ঝড়ের কবলে পড়ে পণ্যবাহী জাহাজ সমুদ্রে নিরুদ্দেশ হয়। এন্টোনিও দিশেহারা। সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও শায়লকের টাকা শোধ করা যায়নি।
বন্ধুর বিপদের খবর পেয়ে বাসানিও ভেনিসে ফিরে আসে। পোর্শিয়া ছদ্মবেশে এন্টোনিওর ওকালতি করে এবং দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দিতে চায়। কিন্তু শায়লক নাছোড়বান্দা। সে এন্টোনিওর এক পাউন্ড মাংস কেটে নেয়ার জন্য উদ্যত হয়। আদালতের বিচারক ছিলেন ডিউক অব ভেনিস। পোর্শিয়া বিচারকের কাছে আর্জি পেশ করেন যে চুক্তি অনুযায়ী শায়লক এন্টোনিওর এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে পারেন কিন্তু এক বিন্দুও রক্ত নয়। কারণ চুক্তিপত্রে মাংসের কথা উল্লেখ আছে কিন্তু রক্তের কথা উল্লেখ নেই। শায়লক চুক্তির ফাঁদে আঁটকে যান। অগত্যা মাংসের বদলে শায়লক ঋণের অর্থ ফেরত চান। কিন্তু পোর্শিয়া এবার অর্থ ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং তাঁর যুক্তিতে অনঢ় থাকেন। উপরন্তু এন্টোনিওর জীবননাশের পরিকল্পনা করার জন্য শায়লকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য আবেদন করেন। বিচারক শায়লকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার বদলে অর্থদন্ড দেন।
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘অতিলোভে তাঁতী নষ্ট’। শায়লকের অবস্থা হয়েছিল অনেকটা সেরকম। মূলত সে বনে গিয়েছিল ‘পাউন্ড ফুলিশ’। অর্থাৎ এন্টোনিওকে নাজেহাল করার জন্য শায়লক বজ্র আঁটুনি এটেছিল কিন্তু তার শর্তের গেরোটা ছিল ফস্কা।
বাস্তব জীবনেও প্রায়শই আমরা ‘পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ’-এর মতো কাজ করি। যেমন কিছু টাকা খরচ হবে চিন্তা করে অনেকেই নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার বিষয়টা এড়িয়ে যাই। কিংবা স্বাস্থ্য বীমার খরচকে বাজে খরচ মনে করি। অথচ যখন নিজে কিংবা পরিবারের কেউ অসুস্থ্য হয় তখন পকেট থেকে অনেক টাকা বেরিয়ে যায়।
আবার বিশেষত বিদেশে অনেক রিটেল শপ আছে, যারা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ে ১৫% ডিসকাউন্ট প্রদান করে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, ডিসকাউন্ট সুবিধা নেয়ার জন্য আমরা অপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ফেলি কিংবা দেরীতে বিল শোধ করার জন্য অতিরিক্ত জরিমানা গচ্ছা দেই।
আমি যখন প্রথম টরন্টো শহরে যাই তখন আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু কয়েকটি দর্শনীয় জায়গা ঘুরিয়ে দেখাবার প্রস্তাব দেয়। বাসা থেকে বের হবার পর গাড়িতে তেল নেয়ার জন্য কাছেই একটা গ্যাস স্টেশনে যাই। সে তখন আবিষ্কার করে যে ঐ গ্যাস স্টেশনে প্রতি লিটারে তিন সেন্ট বেশি মূল্য দিতে হবে। পরে দেখা গেল এক ডলার বাঁচাতে গিয়ে সে প্রায় ২০ মিনিট ড্রাইভ করে অন্য একটি স্টেশন থেকে তেল নিল। বন্ধুর কর্মকান্ড দেখে আমার পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশের কথা মনে পড়ে গেল।
পেশাগত জীবনেও আমরা খরচ বাঁচানোর জন্য কিংবা দুর্নীতি রোধ করার জন্য লাল ফিতার বজ্র আঁটুনী দেই। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে ফস্কা গেরো দিয়ে ফস্কে গেছে থলের বেড়াল। যেমন আইনজীবীর ফি বাঁচানোর জন্য নিজেরাই অনেক সময় দলিল পত্র বানিয়ে ফেলি। পরে দেখা যায় যে, সামান্য ভুলের জন্য বিরাট অর্থ দন্ড দিতে হয়।
একজন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীকে চিনি যিনি কমার্শিয়াল বিল্ডিংয়ে বেশি ভাড়া দিতে হবে ভেবে একটি আবাসিক বাসায় রেস্টুরেন্ট খুলে বসেন। ডেকোরেশন এবং সাজসজ্জায় তিনি অনেক টাকা খরচ করেন। কিন্তু আইনজীবীর খরচ বাঁচানোর জন্য তিনি বাড়িওয়ালার দেয়া দলিলপত্র সঠিকভাবে নিরীক্ষা না করেই সই করে দেন। রেস্টুরেন্টটি যখন জমে বসেছে তখন বাড়িওয়ালা দুই মাসের নোটিশে বাড়ি খালি করে দিতে বলেন। চুক্তিপত্রে ক্ষতিপূরণের কোনো শর্ত না থাকায় সেই ব্যবসায়ীকে অনেক ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়।
আমার পরিচিত এক সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের গল্প বলি। কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ সিদ্বান্ত নেয় যে গত কয়েক বছরের মুনাফার প্রবৃদ্ধি সন্তোষজনক নয়। তাই প্রবৃদ্ধি ১২% থেকে ২৫%-এ উন্নীত করার জন্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়। ব্যবস্থাপনা কমিটি ঘর্মাক্ত হয়ে চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নেয় যে, হয় আয় বাড়াতে হবে নতুবা ব্যয় কমাতে হবে। দ্রুত আয় বাড়ানোর একটা উপায় হল পণ্য বা সেবার মূল্য বৃদ্ধি করা এবং আরেকটি উপায় হল কর্মী ছাটাই করা। সিদ্ধান্ত হয়, লক্ষ্য অর্জন করতে হলে দুটি কৌশলই প্রয়োগ করতে হবে। তিন মাসের মধ্যে পণ্য বা সেবার ট্যারিফ ১৫% বৃদ্ধি করা হল এবং তিনশ কর্মীকে স্বর্ণালী করমর্দন (অব্যাহতি) জানিয়ে দেয়া হল। ফলে স্বল্প সংখ্যক কর্মী অধিক সংখ্যক গ্রাহককে সেবা দিতে গিয়ে দিশেহারা। অন্যদিকে গ্রাহকরা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সেবা নিতে গিয়ে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লো। সেবা প্রদানের মান পড়ে গেল। ছয় মাসের মাথায় সেই প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক সংখ্যা কমে যেতে লাগলো। বছর শেষে দেখা গেল প্রথম তিন মাস মুনাফা বৃদ্ধি পেলেও পরবর্তী নয় মাস মুনাফা নেমে গেছে অধঃগতিতে। বজ্র আঁটুনী ফস্কা গেরোর মতো কৌশলের ফাঁক গলে মুনাফার লক্ষী উড়াল দিল।
২০০৫ সালে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার ফলে ডেল্টা এয়ারলাইন্স চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ব্যয় সংকোচন করার জন্য কোম্পানি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী ছাঁটাই করে এবং বাকি কর্মীদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা কমিয়ে দেয়। ফলে সেবার মান পড়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম বিমান কোম্পানি ডেল্টা এয়ারলাইন্স দেউলিয়া হয়ে যাবার উপক্রম হয়।
গ্রাহক সেবা প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, ব্যয় সংকোচন করতে গিয়ে সেবার মানকে কোনোভাবেই বিসর্জন দেয়া যাবে না। গ্রাহকরা অনুভূতিপ্রবণ। তারা চায় হাস্যমুখে বিনম্র সৌজন্যতা। আর দীর্ঘ সারিতে কেউ বেশি সময় অপেক্ষা করতে চায় না। সেই কারণে সেবা প্রদানে রোবটীক প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হবে। নতুবা এই রূপান্তরে গ্রাহকরা স্বাচ্ছন্দবোধ না করলে তা বুমেরাং হতে পারে।
গত সপ্তাহে আমার সহকর্মীকে নিয়ে আইডিবি ভবনে কম্পিউটার মার্কেটে গিয়েছিলাম অফিসের জন্য ল্যাপটপ, পিসি, প্রিন্টার ইত্যাদি কেনার জন্য। আমার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য একটা প্রিন্টার কেনার পরিকল্পনা ছিল। নামী ব্রান্ডের একটা প্রিন্টার পছন্দ করলাম। মূল্য দশ হাজার তিনশত টাকা। যখন ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দিলাম তখন বিক্রয়কর্মী আমাকে বিরস মুখে বললেন, ‘স্যার ক্যাশ টাকা দিলে ভাল হয়।’ আমি বললাম, ‘সাথে ক্যাশ টাকা নেই বলেই তো প্লাস্টিক কার্ড দিলাম। ক্রেতার সুবিধা অসুবিধা দেখবেন না! আজকাল তো বিকাশেও পেমেন্ট করার সুযোগ রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির পণ্য বিক্রি করছেন, অথচ লেনদেনে আপনারা পড়ে আছেন সেই সুলতান সুলেমানের যুগে।’
বিক্রয়কর্মী মুখ অন্ধকার করে বললেন, ‘স্যার ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট দিলে আরো দুশো টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে।’
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘আজকাল তো ক্রেডিট কার্ডের জন্য কেউ অতিরিক্ত চার্জ করে না। উপরোন্তু অনেক শপে ডিসকাউন্ট দেয়া হয়। আর সবাই তো এত ক্যাশ টাকা পকেটে নিয়ে ঘোরে না। জিনিসটা প্রয়োজন এবং পকেটে ক্রেডিট কার্ড আছে বলেই তো কিনছি।’
এবার বিক্রয়কর্মীটি অনেকটা সহমর্মীতা দেখিয়ে বললো, ‘স্যার, আমরা তো ক্রেতার সুবিধা অসুবিধা বুঝি। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট তো ব্যাপারটা বুঝতে চায় না। তারা উল্টো ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট অনুৎসাহিত করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন যে, ক্রেতাকে যেন অতিরিক্ত চার্জের কথা বলা হয়।’
আশ্চর্য, দুশো টাকা বাঁচানোর জন্য ক্রেতাকে এভাবে নাজেহাল করা! বেরিয়ে এসে আমার সহকর্মীকে (প্রকিউরমেন্ট ম্যানেজার) নির্দেশ দিলাম যে, এই দোকান থেকে ভবিষ্যতে যেন কোনো পণ্য কেনা না হয়। ল্যাপটপ, প্রিন্টার ইত্যাদি কেনার জন্য আমাদের প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকার বাজেট ছিল। সামান্য দুইশত টাকা বাঁচানোর জন্য তারা পাঁচ লক্ষ টাকার পণ্য বিক্রয়ের সুযোগ হারালো।
আমার সহকর্মী নিজের অজান্তেই মনে করিয়ে দিল, স্যার ওদের কথা ছেড়ে দিন। ওরা হলো ‘পেনি ওয়াইজ পাউন্ড ফুলিশ।’

- Advertisement -

Read More

Recent