রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

কালরাতের বিভীষিকা

ছবি আশিক আনান আবির

হারুন চুপচাপ বসে আছে অনেক উৎসাহ আর অনেক ভালোলাগা যুদ্ধের জন্য কিন্তু ওর কিছুই ভালো লাগছে না। নিজের জীবন সে অকাতরে দেশের জন্য উজাড় করে দিতে পারে। কিন্তু পলাশ, ওর প্রিয় বন্ধু, ওর একমাত্র বন্ধু, ওর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। এভাবে চলে গেল ওর পাশ থেকে। কিছুতেই মানতে পারছে না হারুন। একমুহূর্ত আগেও গুলি চালাতে চালাতে হাসছিল পলাশ। সেই হাসি চোখ থেকে সরাতে পারে না হারুন আর ওর কথা। স্বাধীন দেশের সেই স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ জীবনের সেই ছবি বারবার আনমনা করে দিচ্ছে হারুনকে। পলাশের ইচ্ছা ছিল যুদ্ধ শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে পাস করে। পরবর্তী প্রজন্মকে জানাবে যুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আলোকিত করবে শিক্ষার্থীর প্রাণ, আদরে ভালোবাসায় দরদে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করবে প্রজন্ম। ভীষণ মেধাবী ছাত্র পলাশ জীবনে কখনও দ্বিতীয় হয়নি কোনো পরীক্ষায়। অনার্স হয়ে গেছে। এমএ পরীক্ষার আর মাস দুই বাকি ছিল। এরমাঝে লেগে গেল এই যুদ্ধ। হলের সেই ভয়াল কালরাতের বিভীষিকা এখনও তাড়িত করে হারুনকে। শত মৃত্যুর স্তুপে নিজেকে জীবন্ত পেয়ে নতুন জীবন পাওয়ার আনন্দ হয়েছিল। সারারাত আর পরের একটা দিন পুকুরের জলে কোনোমতে নাক ভাসিয়ে কাটিয়েছিল। চারপাশে মিলিটারির আনাগোনার মাঝে। জীবিত টের পেলে মেরে ফেলবে সেই ভয়ে থেমে ছিল যেন নিঃশ্বাসও। পরদিন রাতের অন্ধকারে অচেনা গলি ঘুরে ঘুরে পলাশদের ধানমন্ডির বাড়িতে পৌঁছে হারুন অচেতন হয়ে পড়েছিল বাগানে। তিনরাত অচেতন প্রায় কেটেছে একটা ঘরে। এরপর মানুষের ঝাঁকের সাথে, পলাশদের পরিবারের সাথে ওদের গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জে এসেছে ঢাকা ছেড়ে। হারুন জীবনে কখনো মৃত মানুষ দেখেনি। কোরবানির গরু জবাই দেখেনি। অথচ এমন মানুষের লাশের মাঝে কাটিয়ে গা গুলিয়ে শুধুই বমি করছিল। কাছের বন্ধু পরিচিত ছেলেরা লাশ হয়ে পড়ে আছে। যাদের সাথে সারাদিন পড়ালেখা হাসি-তামাশা ভাব-বিনিময়ে কাটত, তারা সবাই নিথর তাদের বিকৃত দেহ পড়েছিল আশেপাশে রাতভর। মাথাটা ফাঁকা হয়ে যায় যতবার ভাবে। মনে হয় যেন সে বাতাস হয়ে গেছে, মানুষ নাই আর। সেই ভয়ানক রাতের স্মৃতি অস্বাভাবিক করে দেয় হারুনকে। খেতে পারে না, ঘুমাতে পারে না। ভয়ে আতঙ্কে যেন সিঁটকে গেছে। চমকে উঠে চারপাশ দেখে ক্ষণে ক্ষণে। পলাশ অসম্ভব যতেœ আগলে রেখেছে হারুনকে। গ্রামের বাড়িতে এসে কিছুটা স্থিরতা পেয়ে ও ঠিক করে প্রতিশোধ নিবে এই হত্যাযজ্ঞের। শান্ত ধীর হারুন জেগে উঠে যেন এক নতুন আগুনে। নিজের মাঝে টের পায় বিশাল পরিবর্তন। ভিতরে কি যেন গজরায় থেকে থেকে। যেন প্রচণ্ড তুফানের আয়োজনে হাঁকে মেঘ গর্জন। পড়ালেখা কবিতা লেখায় সেই শান্ত ধীর দিন আর আরাম দেয় না, ফিরে আসে না ভালোলাগা। একরাতে উল্টে গেছে পৃথিবী হারুণের কাছে। বাবা মা বোন কেমন আছে সেই কুষ্টিয়ায় কে জানে। কীভাবে পৌঁছাবে সেখানে। চুপচাপ হারুণের মুখে কথার খৈ ফোটে। এতদিন আন্দোলন অস্থিরতার মাঝেও নিজের মাঝে বুঁদ হয়ে থাকা হারুন এখন মানুষের সাথে কথা বলে সারাক্ষণ। কে কি ভাবছে, কি হচ্ছে জানার চেষ্টা করে আর কিছুদিনের মাঝে জেনে যায় অনেক মানুষ ওর মতন ভাবছে, এই অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। তাদের একটা দলের সাথে ভিড়ে রওনা হয় হারুন ভারতের উদ্দেশে।

আগের রাতে পলাশকে বলে,

- Advertisement -

─ আমি কাল চলে যাব।

─ কোথায় যাবি এই যুদ্ধের মাঝে?

─ যুদ্ধ করতে

অবাক হয়ে খানিক তাকিয়ে থেকে পলাশ বলে,

─ আমিও যাব তোর সাথে।

─ কি বলিস তুই? তুই পারবি না।

─ তুই পারলে আমিও পারব।

─ তুই মা-বাবার একমাত্র সন্তান।

─ তুইও একমাত্র ছেলে।

─ আমার মা-বাবার কাছে আমি হারিয়ে গেছি এখন। ওরা জানে না আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি। আমিও জানি না ওদের খবর আর খবর নেবইবা কীভাবে এসময়ে? তার চেয়ে সহজ যুদ্ধে যাওয়া আর আমার কি মনে হয় জানিস পলাশ, আমি জীবন পেয়েছি এই দেশের জন্য নতুন করে। নয়তো আমার মরে যাওয়ারই কথা ছিল।

─ এত কিছু জানি না। তুই যাবি যুদ্ধে, আমিও যাব। জাফর, হাসান, আসিফ, মিলন, বিলু কেউ বেঁচে নাই, আমি ভাবতে পারি না, কেঁদে উঠে পলাশ হাউমাউ করে। আমার বন্ধুদের জীবনের কসম, আমি পাকিদের খেদাব এই দেশ থেকে। আমাদের দেশ বানাব বাংলাদেশ, সোনার বাংলাদেশ। আবেগে থরথর করে কাঁপে পলাশ। ওর গাল লাল হয়ে উঠে। বড়লোকের আদরের দুলাল এক গ্ল¬াস পানি ঢেলে খাওয়ার দরকার হয় না যার সে করবে যুদ্ধ। খেলাধুলার চেয়ে পড়ালেখায় যার আগ্রহ বেশি, কেমনে সে যুদ্ধের দামামা বাজাবে? হারুন ভাবে কিন্তু বন্ধুর আবেগে বাদ সাধে না। মনে মনে ঠিক করে ওকে লুকিয়ে চুপি চুপি রাতে চলে যাবে। আর খালাম্মাকে বলে রাখতে হবে পলাশকে আগলে রাখার কথা।

- Advertisement -

Read More

Recent