বুধবার - মে ৮ - ২০২৪

ঐশ্বর্যান্বিত মাতৃত্ব

ছবিকেনেসিয়া মাকাগোনোভা

একটি শিশু জন্মের পরপরই জন্মদাত্রী মায়ের শরীর ত্যাগ করে এবং জ্ঞানেন্দ্রিয় প্রকৃতির সংস্পর্শে আসে। তার সুকোমল সর্বাঙ্গ প্রথমবারের মত আলো, শব্দ-তরঙ্গ ও পরিবেশের আবহাওয়ায় প্রকৃতিস্থ হয়, স্নায়ুকোষ শিহরিত হয়, মাংসপেশী সঙ্কুচিত ও প্রশমিত হতে আরম্ভ করে। বিস্ময়কর একটি ছোট্ট চালিকা শক্তি, দুর্বোধ্য গঠনশৈলী ও অচিন্তনীয় পেলবতায় সৃষ্টির সবচাইতে আলাদা রূপে এই ব্রম্মান্ডে চলনশীল হয়।এই ক্ষুদ্র শিশু বিশদ সম্প্রসারিত হতে থাকে ও ক্রমবিকাশ লাভ করে একদা সুস্পষ্ট পরিপূর্ণ অত্যন্ত নিগূঢ় প্রভাব সম্পাদনে সক্ষম হয়। কামনাতীত রহস্যময় ও দুর্নিবার, সৃজনক্ষম অকল্পনীয় কর্মে স্বয়ং উদ্দীপ্ত হয়।

এই নতুন পরিবেশের সাহচর্য তাকে নানা ভাবে অনুপ্রাণিত করে, সে অন্বেষণে ব্রতী হয়, দিনেদিনে সুযোগ্য অভিলাষ দ্বারা উদ্ঘাটন বা উদ্ভাবন করে। হয়তো বা সমৃদ্ধির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করে বা আড়ম্বরপূর্ণ কোন কীর্তিস্তম্ভের তারকা রূপে আবির্ভূত হয়। সে বিশ্বের বুকে সুপ্ত ও অজ্ঞাত ঐশ্বর্যের ভান্ডার এবং অপরিমেয় অবরুদ্ধ শক্তির দ্বার উন্মুক্ত করে নিজ ব্যাবহারের তাগিদে। সে হানাদেয় রহস্যময় গভীর সমুদ্রের তলদেশে কিংবা মহাকাশের অসীমে, উপনীত হয় পরমাণুর আণবিক গড়ন, সংযোজন বা বিযোজনের নিভৃতাবাসে। স্থির দৃষ্টিতে পরিকল্পনা করে অনন্ত এ বিশ্বের অভিন্ন সুদূরে। নিজ সহায়তার প্রয়োজনে প্রকাশ করতে চায় প্রচণ্ড উৎসন্ন আলোর ঝলক, মনুষ্যত্বের ও সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্রমবিকাশকে, প্রবল শক্তিমান জলপ্রপাত, জোয়ার-ভাটা ও স্রোতের মত প্রাকৃতিক সাহচর্যকে। সে বশে আনতে চাইবে আকস্মিক ইন্দ্রজালিক দেবতাদের, বিদগ্ধ যুগ ও মহাশূণ্যের পরিমন্ডলকে, শক্তিমত্তার ফলে আকাশ করবে প্রতিধ্বনি, অখণ্ড ভূমি কেঁপে উঠবে তার পরিচ্ছন্ন মত প্রকাশের ধ্বনি বা স্বরে।

- Advertisement -

আগত দিনের জন্যে এই অপরিচিত মুখ কতখানি সঞ্চয় ভাণ্ডারে রেখে যাবে, তার শ্রমসিদ্ধ বিস্ময়কর প্রাপ্তি প্রান্তভাগে কী হবে, কৃতিত্বপূর্ণ অবদান কতটা রেখে যাবে, অভিষেক হবে কোন কার্য সম্পাদনার?

একদা সে সনাক্ত করেছে বোধগম্য সব বস্তু, মৌলিক পদার্থ থেকে এসেছে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম অণিমা ভাবনায় ধারণাতীত, আকাশে বা মহাশূণ্যে পরিব্যাপ্ত, যাকে বলা হয় ভাস্বর ইথার।এর উপরই নির্ভর করে জীবনপ্রদ চলমান প্রাণ এবং সৃজনী শক্তি, জীবৎকালের আহ্বান, চলে নিরন্তর বৃত্তাকার আবর্তনে ঘটমান সব বিস্ময়। মহীয়ান এই প্রকৃতির অভিভূতকারী লীলাখেলার মাঝে সব নিয়ন্ত্রণে রাখতে মানুষ কতটা সুযোগ্য, অফুরন্ত শক্তির কতটা সৎব্যাবহার করবে নিজ ক্রিয়াকলাপ সমাধান করতে, ইচ্ছাশক্তির অনুশীলনে সক্রিয় থাকবে কী সবকিছু? এক কথায় বলা যায় কেবল মানুষই করবে মহাশক্তির মহত্তম উদ্ভাস, পূর্ণাঙ্গ সাফল্য অর্জন, পদার্থবিদ্যাগত ঐশ্বর্য ভান্ডারের উপর।

উপরের দাঁড়িপাল্লায় দেখা যাচ্ছে ডানদিকে স্তুপাকৃত বহুকিছু, যে সব একদা ছিল অস্পষ্ট, অবাস্তব যে কোন নবজাতকের মস্তিষ্কে। বিস্ময়াপন্ন হওয়ার মত ভূমন্ডলে অনেক কিছু, বিখ্যাত জলপ্রপাত, গহীন অরণ্য, খরস্রোতা নদী, আগ্নেয়গিরি, অতল সাগর, বিদ্যুতের চমক, গ্রীষ্মমন্ডলের তাপ এবং নিষ্প্রাণ মেরুর নিরুত্তাপ। কিন্তু এখানে সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে চাইলে বুঝতে হবে পাল্লার একদিকের সবকিছু, আরেক দিকের নবজাত শিশুর মেধাবী মস্তিষ্কের সম্ভাবনাময় শক্তি সামর্থ্যের সাথে তুলনা করলে নগণ্য হতে পারে।বিজ্ঞানী নিকোলা টেসলার( ১৮৫৬–১৯৪৩) মতে, নিছক কল্পনায় নয়, বিজ্ঞান সম্মত বা তীক্ষ্ন বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দ্বারা এটি বিচার্য, তিনি পরামর্শদেন যে ভবিষ্যতে মানুষ গ্রহ-উপগ্রহকে জয় করবে, মহাকাশ অভিযানে নিজেদের দিক নির্দেশনা বেছে নিবে। টেসলা তার সময়কার সত্যিকার প্রতিভাধর এক বিজ্ঞানী ছিলেন, তিনি একদা নিউইয়র্কের ৫ম এভিনিউর ২৬তম স্ট্রিটের পুরানো ডেলমনিকো রেস্তোরায় বসে একটি ওয়াইন গ্লাস হাতে তুলে বলেছিলেন, “এই গ্লাসের অণু, পরমাণু যে শক্তি ধারণ করে তাহা বাস্তবে প্রয়োগ করতে পারলে আমেরিকার শিল্প-কারখানা চালানো যাবে”। তখন মনে হয়েছে এ হটকারী অবাস্তব কল্পনা, কিন্তু আজ ছাত্রদের স্কুলে পড়ানো হয় একটি এটমের মাঝে ইলেকট্রন প্রতি সেকেন্ডে নিউক্লিয়াসের চারদিকে ট্রিলিয়ন বার ঘুরতে যে বল ধারণ করে সেটি আমাদের কল্পনাতীত। তবে একটি নবজাত শিশু জন্মের কয়েক ঘন্টার মাঝে পা দিয়ে কিক্ দিয়ে তার যে আগত জীবনের সম্ভাবনার জানান দেয় তাহা বুঝতে কোন বিজ্ঞানের শিক্ষা বা বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না বরং সহজে অনুমান করা যায় বড় হয়ে এ শিশু হয়তবা পৃথিবীকে হতবাক করবে। নবজাতকের মা ছোট্ট কোমল মুখখানির দিকে তাকিয়ে প্রগাঢ় উজ্জ্বল এক আলোক বর্তিকা খুঁজে পায় এবং আত্মতৃপ্তি লাভ করে।

মেঘের থেকে আলোকে ধরে এনে ক্ষুদ্র লাইট বাল্বে তালাদিয়ে রেখেছে, এ তো একদিনের শিশু এডিসনের মস্তিষ্কে জন্ম নিয়েছিল। সকল ইঞ্জিনিয়ারের দক্ষতা, বিজ্ঞানী, সার্জন, শিল্পপতি সকলেই একদিনের শিশু, গর্বিত মা বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন। এমন কী যে শিশু অখ্যাত, গরীব ও সমান্য ঘরে জন্ম নিয়েছে তবে মেধা ও খ্যাতির প্রতিযোগিতায় উচ্চ বিত্তশালী পরিবারে জন্মানো শিশুদের চাইতেও অগ্রসর থেকেছে।

আমেরিকায় নীলচোখ নিয়ে যে শিশু ছোট্ট একটি জানালা বিহীন অপরিচ্ছন্ন কাঠের ঘরে জন্মেছিল, তার মা সযত্নে তাকে যে শক্তি সামর্থ্য দিয়ে জন্মদান করেছিল, জন্মের পর প্রথম নীলচোখ মেলে ‘আব্রহাম লিঙ্কন’ চরিদিকে তাকিয়ে কী ভেবেছিল তার বল-বীর্য বা ক্ষমতার কথা?

সকল মায়ের উৎসাহ, উদ্দীপনা গর্বের সাথে মনে রাখা প্রয়োজন, তার কোলের শিশুটির জীবন হতে পারে অসীম সম্ভাবনার, তার মাঝেই লুকিয়ে আছে গৌরবোজ্জ্বল আমাদের ভবিষৎ। লক্ষ লক্ষ মায়ের নিকট অনুমেয় নয় বিজ্ঞানী টেসলা কী বলতে চাইছেন। নবজাত শিশুর প্রতি মায়ের যত্ন ও ভালোবাসার যে শক্তি তার চাইতে মহান শক্তি বিশ্বে আর কিছু নেই, “ভালোবাসাই আশা ও ভরসার পাথেয়, যেখানে যুক্তিবৃত্তি নৈরাশ্যের আধার” বলে গেছেন নিকোলা টেসলা। তিনি আরো বলেন, “একটি ছোট শিশুর মুখে ও অন্তরে মা ‘ঈশ্বর’।”

উপরের এই ছবি, প্রশংসনীয় ভাবে মানুষের মন, মেধা ও মননের প্রতি শ্রদ্ধা বা গুণমুগ্ধতা প্রকাশ করে এবং মানব মস্তিষ্কের শক্তি, সামর্থ্য ও ক্ষমতার গুরুত্ব অনুধাবন করতে সহায়তা করে। তার চাইতেও অধিক কৌতূহল-উদ্দীপক, যে কোন শিশুর মেধা ও ক্ষমতা মানব জাতিকে কোথায় পৌঁছে দিতে সক্ষম তাও আমাদের অজানা।

অপরিণত হলেও প্রতিভাশালী এই শিশুর ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে, সর্বাগ্রে  মোটামুটি এসে পড়ে মাতৃত্ব, উদ্ভাবক শক্তি যার নিকট এ বিশ্ব ঋণী।

ছবিতে এক পাল্লায় একটি নবজাতক, আর অপরটিতে বিশ্বের যত বিস্ময়, নানা উদ্ভাবন, রেলরোড়, গগনচুম্বী অট্টালিকা, জাহাজ, নিত্যনব কলকারখানা ইত্যাদি। শিশুর দিকেই দেখা যায় পাল্লা ভারী এবং ছবিটি কিছুতেই অতিরঞ্জন বা অতিকথন নয়, সব বিস্ময়ইতো এমন শিশুর মাথা থেকে এসেছে। ভবিষ্যতে এর চাইতে হাজার গুণ বেশী উদ্ভাবন যে একটি শিশুর মেধা থেকে প্রবর্তন হতেপারে তাহা কেউ হয়ত কল্পনাই করিনা। নতুন মাতৃত্ব আসবে, নবজাতকের মেধা বিশ্বকে হতবাক করে ধীরে ধীরে এক একটি উদ্ভাবন হবে, আমরা নির্বাকচিত্তে শ্রদ্ধার সাথে কৃতজ্ঞতা জানাব।

মাতৃত্বকে বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন। শিশুর মেধাকে যথাযোগ্য সুযোগ দিতে পারলে, বিশ্ব বিস্মিত হয়ে দেখবে কোন কিছু অসম্ভব নয়।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent