শনিবার - মে ১১ - ২০২৪

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন : উৎপাদন ও বিতরণ বিতর্ক

ছবিপাবলিক হেলথ অন্টারিও

আমরা যদি সৌভাগ্যবান হই, আশা করি ২০২২ সালের প্রথম দিকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের সরবরাহে প্লাবন বয়ে যাবে। আজ অবধি বিলিয়ন ডোজ উৎপাদন হলেও বেশীর ভাগই দেয়া হয়েছে ধনী দেশগুলোতে, অপরদিকে মৃত্যু ও সংক্রমণ বেড়ে চলেছে গরীব দেশ গুলোতে। যেমন ভারত যেখানে এযাবৎ ভ্যাকসিন প্রথম ডোজ পেয়েছে মাত্র ১০% বা তার চাইতেও কম লোক, অনেক দেশ তাও পায় নি, আবার ধনী দেশ আমেরিকায় প্রায় ৭৫% লোক অন্তত প্রথম ডোজ পেয়ে গেছে।
ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানিজেশনের নিকট আবেদন করেছে ভ্যাকসিনসহ কোভিড যুদ্ধে প্রয়োজনীয় সব প্রযুক্তি ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি সংরক্ষণের অধিকার মুক্ত করতে। আমরা জানি যে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি হচ্ছে আইনবলে আবিষ্কারকের উদ্ভাবিত দ্রব্যের ওপর একচেটয়া অধিকার, যাকে প্যাটেন্টও বলা হয়ে থাকে। প্রেসিডেন্ট জ্যো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির ১০ জন সদস্য এই আবেদনকে সমর্থন করেছে। যদিও ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো সতর্ক বাণী দিয়ে বলতে চেয়েছে, এ জাতীয় উদ্যোগ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনকে পঙ্গু করার সামিল হবে। যদ্যপি ইন্টেল্যাকচুয়াল প্রোপার্টি সংরক্ষণ আজ ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশাল প্রতিবন্ধক নয়, তবু কোভিড-১৯ এর অভিজ্ঞতা স্মরণ করিয়ে দেয় এই সংরক্ষণের অধিকার শিথিল করা অত্যাবশ্যক এই মহামারীর সঙ্কটময় মুহূর্তে।
ইন্টেল্যাকচুয়াল প্রোপার্টি সংরক্ষণ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোনে বিশেষ প্রয়োজনীয় প্রতীয়মান হতে পারে। গবেষণা ও উদ্ভাবন অত্যধিক ব্যয় সাপেক্ষ ও খুব ঝুঁকিপূর্ণ। ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি একটি ঔষধকে উৎপাদনের পর্যায়ে নিয়ে আসা অবধি প্রচুর বিনিয়োগ করতেই হয়, যদিও সাফল্যের প্রতিশ্রুতি কখনো থাকে না। একই সময়ে অন্য কোন প্রস্তুতকারককে যদি অবাধে দ্রুত নকল করে নূতন উদ্ভাবিত ঔষধ তৈরি করে বাজার জাত করতে দেয়া হয়, তাহলে তার মূল্যমান প্রায় উৎপাদন ব্যয়ের প্রান্ত সীমায় পৌঁছাতে পারে। এমতাবস্থায় উদ্ভাবক বা উদ্ভাবন সহযোগী কোম্পানির উৎপন্ন দ্রব্য আবিষ্কারের পশ্চাতে যে বিশাল অর্থ ব্যয় হয়েছে সেই বিনিয়োগ তুলে আনতে অপারগ হয়ে পড়ে। তাই স্বল্প কালীন সময় হলেও উদ্ভাবন সহযোগী কোম্পানিকে একচেটিয়া আধিপত্য না দিলে বিনিয়োগ অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়কর হয় না। ইন্টেল্যাকচুয়াল প্রোপার্টি সংরক্ষণ আইনই শুধু এ ধরনের গবেষণামূলক বিনিয়োগ সুরক্ষিত করতে পারে।
তবে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ প্রস্তুতকরণ বিষয়ক বিভাগের অধ্যাপক মাইক্যাল বোল্ড্রিন ও ডেভিড লেভাইনের মতে ইন্টেল্যাকচুয়াল প্রোপার্টি সংরক্ষণ আইন সকল ক্ষেত্রে একপ্রকার হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ আমেরিকার বায়োমেডিক্যাল গবেষণা কোভিড-১৯সহ অনেক উদ্ভাবনের সিংহভাগ বিনিয়োগ সরকারী তহবিল থেকে করে থাকে। তাই এ ক্ষেত্রে সংরক্ষণ আইন শিথিল হলে বিশ্বে ভ্যাকসিন সরবরাহ সুলভ ও সহজ হতে পারে।
আজ বিশ্বে যেখানে দৈনিক প্রায় দশ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, মহামারীর এই সময়ে কোভিড সম্পর্কিত যেকোনো দ্রব্যের ওপর সংরক্ষণ আইন ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞগণ। তাছাড়া কোভিড ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে সরকারী অর্থায়ন ছাড়াও বহু ক্ষেত্রে জনগণের প্রভূত সম্পদ ব্যবরুত হয়েছে, সেটাও ভুললে চলবে না। এমন কী বড় বড় ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি যেমন ফাইজার, ভ্যাকসিনের ৪ বিলিয়ণ ডলার লাভ বাদ দিলেও ২০২১ সালে তাদের মোট মুনাফা বিশাল অংকের।
তৎসত্ত্বেও বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানির বক্তব্য, ইন্টেল্যাকচুয়াল প্রোপার্টি সংরক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হলেও আজই উৎপাদনে প্লাবন আসবে না। বিশ্বের সব ভ্যাকসিন তৈরির সুযোগের সৎব্যবহার করতে এরই মাঝে ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই উদ্ভাবকদের সাথে লাইসেন্স চুক্তি ও সম্মতির মাধ্যমে অপর উৎপাদক গোষ্ঠী উৎপাদন করছে। যেমন এস্ট্রাজেনিকা ভারতে বিশ্বের সব চাইতে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদকের ( সিরাম ইনস্টিটিউট ) সাথে চুক্তি ভিত্তিক উৎপাদন করছে। এখন সমস্যা অন্যত্র, কাঁচামালের সীমাবদ্ধতা এবং নিরাপদ উৎপাদনের জন্য অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞসুলভ জ্ঞান থাকা দক্ষ ব্যক্তির অভাব। এসবের জন্য আমেরিকার সরকারী রপ্তানি নীতি বা নিষেধাজ্ঞা অতি জরুরী বস্তু সরবরাহে হস্তক্ষেপ বা বাধা বলে প্রতীয়মান।
উপরন্তু সব চাইতে বড় প্রতিবন্ধকতা হল, মালিকানার পুঁজি, ব্যবহারিক জ্ঞান ও কারিগরি কৌশল যেগুলো ইন্টেল্যাকচুয়াল প্রোপার্টি সংরক্ষণ আইনের কারণে প্রতিহত নয়। অনেক গরীব দেশেরই ফাইজার বা মোডার্নার এম.আর.এন.এ প্রযুক্তির পরিভাষা বুঝে কাজ করার সামর্থ্য নেই।

আলোচ্য এই বিষয়ে স্পষ্ট হয়েছে যে ভ্যাকসিন উৎপাদন প্রচেষ্টায় প্রস্তুতকারক কোম্পানি ও সরকারী কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব বা ঘাটতি রয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠান তথ্য-উপাত্ত এবং কারিগরি জ্ঞান অপরের সাথে অংশীদারির ভিত্তিতে শেয়ার করতে বিমুখ, ফলে জীবনরক্ষক উৎপাদন সীমিত বা মন্থর হচ্ছে। সরকার ইচ্ছা করলে নির্দিষ্ট ও অনিবার্য কারণে ইন্টেল্যাকচুয়াল প্রোপার্টি আইন লঙ্ঘন করে উদ্ভাবকে এক কালীন কিছু অর্থের বিনিময়ে বাধ্যতামুলক উৎপাদনের লাইসেন্স দিতে পারে যে কোন কোম্পানিকে। তবে এই সব লাইসেন্সও কাজে আসে না যদি না উদ্ভাবন সহযোগী প্রতিষ্ঠান অপর উৎপাদনে আগ্রহী কোম্পানির সাথে তথ্য ও জ্ঞান শেয়ার না করে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়ে সমন্বয় করতে প্রয়াসী হয়েছে, বড় বড় কোম্পানি তা অগ্রাহ্য করেছে।
এযাবৎ বিগত বছরের অভিজ্ঞতা সরকারকে ইঙ্গিত দেবে নতুন ভেরিয়েন্টের ভ্যাকসিন তৈরীর সময়, পরবর্তী চুক্তিতে কীভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সমাধানে আসা যায়। আমেরিকা উদ্ভাবনের পেছনে এত বিশাল বিনিয়োগের পর যদি চুক্তি সম্পাদনার সময় প্রস্তুতকারকদের তথ্যাদি শেয়ার করতে বাধ্য করে তবে অবশ্যই ভ্যাকসিনের প্লাবন বইয়ে দেয়া সম্ভব। অথবা বড় কোম্পানি প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে তাদের ইন্ডাস্ট্রি বিভিন্ন দেশে বাড়াতে পারে, এবং উদ্ভাবক দেশের সরকার আইনগত প্রতিবন্ধকতার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে এগিয়ে গেলে মহামারী নিরসনে সহায়ক হতে পারে। দ্রুত দেশের জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা গেলেই কোভিডের বিপজ্জনক দিক থেকে রক্ষা হবে, কারণ চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে দেখাগেছ আক্রান্ত হলেও ভ্যাকসিন নেয়া রোগীদের মৃত্যু হার প্রায় শূন্যের কোঠায়। বিগত দিনের ভুলের মূল্য দিতে হচ্ছে মানুষের জীবনের বিনিময়ে। বিশ্ববাসী আশা পোষণ করে ভুলের পুনরাবৃত্তি আর হবে না।

- Advertisement -

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent