রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

স্নায়ু সহজ হয়ে আসে

ছবিস্টিভ জনসন

বুকের ভিতর এমনভাবে মুচড়াচ্ছে ভেতর থেকে সব যেন উগলে আসছে বমির ভাব কিন্তু কিছু পেটে নাই, বমি হবে কেমনে। থেকে থেকে ওয়াক ওয়াক শব্দ তুলছে হারুন। চোখ দুটো মরিচ লাগার মতন জ্বলছে আর রক্তজবার মতন লাল হয়ে আছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে হারুণের। অথচ বসে আছে শব্দহীন। পেছন থেকে কেউ একজন হারুনের কাঁধে হাত রাখে। খানিক পরে সে হাত সঞ্চালিত হতে থাকে হারুনের কাঁধে পিঠে খুবই নম্রভাবে। অনুভূতিহীন শক্ত হয়ে যাওয়া স্নায়ু ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসে যেন। একভাবে বসে থাকা হারুন পাশ ফিরে তাকায়, দেখে পাশে একটি মেয়ে বসে আছে যে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে গভীর মমতায়। ভাবলেশহীন দৃষ্টি মেলে রাখে মেয়েটির মুখে। কোনো কিছুই কাজ করে না ওর মাথায়। হারুণের সমস্ত অনুভব যেন ভিতরে গুমরে মরছে, কিছুতেই কোনো কিছু প্রকাশ করতে পারছে না।

একটু কাঁদো হারুন, ভিতরের কষ্টগুলো ঝরিয়ে দাও। এভাবে বসে থাকলে কি চলবে। তোমাকে যে আবার অ্যাকশনে যেতে হবে। পলাশ চলে গেছে কিন্তু আরো পলাশদের যে তোমাকে বাঁচাতে হবে, হারুন শক্ত হও জাগো, উঠো। এভাবে বসে থাকলে চলবে না। মেয়েটির কথা হারুণের ভিতরের ভয়ানক শক্ত পাথরটাকে হাতুড়ির আঘাতে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে, নড়ে উঠে, ধসে পড়তে থাকে বানে ভেসে যাওয়া নদীপাড়ের মতন, কান্নার মতন হেঁচকী উঠতে থাকে কয়েকবার। এরপর নিস্তেজ হয়ে ঢলে পরে হারুন একপাশে ।

- Advertisement -

প্রচণ্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে হারুণের। অচেতনতার ভিতর প্রলাপ বকছে। খুঁনসুটি করছে ছোট বোনের সাথে। অভিমান করছে মার সাথে। বাবাকে বলছে, রাগ না করতে আর কয়টা দিন অপেক্ষা করো বাবা আমি আসছি। ক্রমাগত উল্টাপাল্টা বকে যাচ্ছে হারুন। ঠাণ্ডা পানির পট্টি দেয়া ছাড়া আর কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। ঔষধও নাই, পথ্যও নাই। রোগীর জন্য যে খাবার দরকার তেমন কিছুই নাই। জাউভাতের দু-চামুচ মুখে দিচ্ছে মাঝে মাঝে বহু কষ্টে। তবুও দুইদিন পর চোখ তুলে তাকাল হারুন। স্বাভাবিক সুস্থ, পাশে বসা সামিয়াকে দেখে অবাক হলো ভীষণ।

─ আপনি?

─ যাক বাবা বাঁচালেন।

─ কেন?

─ এই যে সুস্থ হয়ে উঠলেন।

─ কী হয়েছিল আমার?

─ ভীষণ জ্বর। তিন দিন প্রায় অচেতন অবস্থা।

─ কোথায় আমি? আপনি এখানে কীভাবে? অবাক হারুন জানতে চায়। কিছুই মনে পড়ছে না ওর।

─ সে অনেক কথা, ধীরে ধীরে মনে পড়বে, মনে করার জন্য অস্থির হওয়ার কিছু নেই। চুপ করে শুয়ে থাকুন। শরীরের উপর দিয়ে তো অনেক ধকল গেল। আমি আসছি।

শোয়া থেকে আস্তে আস্তে উঠে বসে হারুন। মাথার ভিতর দপদপ করছে, শ্বাস টানছে জোরে জোরে। খানিক পরে সুস্থির হয়, শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়। ভাবতে চেষ্টা করে কী হয়েছিল?

মনে পড়ছে ধীরে, ঝাপসা, ছায়াছায়া।

এক বাটি মুড়ি এককাপ চা এনে হারুনের সামনে রাখল মেয়েটি।

─ আপনি সামিয়া চৌধুরী তাই না?

─ চিনতে পারলেন খুশি হলাম।

─ চিনতে না পারার কি আছে, আপনার মতন মেয়ে কি সচরাচর দেখা যায়? আপনাকে আমরা সবাই মিলে পছন্দ করতাম, হাসে হারুন।

─ সবাই !

─ কী আর করা বলেন, ক্লাসে পাঁচটি মেয়ে তার দুইজন বিবাহিত। একজন খালাম্মা। একজন সদা গম্ভীর। বাকি একমাত্র আপনি। সবাই আপনাকে নিয়েই কাড়াকাড়ি করত। হাসতে থাকে হারুন আপন মনে।

─ হাসছেন যে?

─ নিজের সৌভাগ্যের কথা ভেবে।

─ হুম, আচ্ছা আপনি ভাবতে থাকেন। দেখি আমি আপনার জন্য খাওয়ার কি ব্যবস্থা করা যায়, ক’দিন প্রায় না খেয়ে আছেন।

─ তবু একটু যদি বলতেন এখানে কীভাবে এলাম।

─ সামিয়া ভালো করে তাকায় হারুনের দিকে। এখনই ভয়াবহ অবস্থাটা মনে করে দেওয়া ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না।

হারুন আবার বলে,

─ কিছু বলছেন না যে, এটা কি আপনার বাড়ি?

সামিয়া ভাবে যে ভয়াবহ অবস্থার জীবন এখন না বলে কি হবে। কথাবার্তা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে তাই বলে,

─ না আমার বাড়ি না। আপনারা একটা অপারেশনে গিয়েছিলেন, তুমুল বৃষ্টির রাত ছিল। পলাশ আপনার বন্ধু, পাশ থেকে গুলি লেগে শহীদ হয়। এরপর আপনি উন্মাদের মতন ঝাঁপিয়ে পড়েন।

─ হুম মনে পড়ছে।

─ চুপচাপ শুয়ে থাকুন, আমি আসছি।

─ কিন্তু যাওয়ার আগে একটু বলে যান আমরা কোথায়, কি অবস্থায় আছি ? ছি ছি আমি এমন জ্বর বাঁধিয়ে বসে থাকলাম আর সবাই কই?

─ আছে ধারে-কাছেই কোথাও। খুব নিরাপদ নই আমরা। আজও আপনার জ্ঞান না ফিরে এলে এখান থেকে যে কোনো উপায়ে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হতো এমন কথা বলে গেছে শিবু গত পরশু। আজ বিকালের মধ্যে এসে পড়বে। তার আগে দেখি খাওয়াটা শেষ করে ফেলি।

─ আপনি কীভাবে এখানে?

─ পরে কথা হবে।

সামিয়া ঘর থেকে চলে যায়।

হারুন ধীরে ধীরে উঠে দরজার কাছে হেঁটে যায়। ধড়ফড় করছে বুক। ভীষণ দুর্বল শরীর। খোলা হাওয়ায় লম্বা নিঃশ্বাস নেয়। দরজার পাল­¬া ধরে দাঁড়িয়ে চোখ মেলে দেয় দূরে। রোদের আলোয় পুড়ছে বাইরের পৃথিবী। ঘন গাছগাছালি-ঘেরা বাড়ি, নিঃশব্দ যেন বিরান ভূমি, কাক পর্যন্ত ডাকছে না এই জৈষ্ঠ্যের দুপুরে। থমথমে একটা ভাব চারপাশে। খোলা উঠান, অদূরে টিনের চালার ঘর, মাঝখানে টানাঘর কয়েকখানা, বেশ বনেদি বাড়ি মনে হয়। এক পা, দু’পা করে বাইরে বের হয় হারুন। থেমে থেমে হাঁটে। আগের মতন অতটা দুর্বল লাগছে না। এ বাড়ির মানুষগুলো কই? হারুন এখানে কেমনে এলো মনে করার চেষ্টা করে। সামিয়া কোনোদিকে গেল? উঠানে নেমে এসে দাঁড়ায় হারুন। রোদের আলোয় তাতান ঝাঁজ অনুভব করে শরীরে। গোসল করতে ইচ্ছা করে ওর। এদিকটা বাড়ির সামনের দিকে মনে হয়। একটু হেঁটে দুই ঘরের মাঝখানে একটা চিকন রাস্তা দিয়ে পিছনে চলে আসে বাড়ির। প্রচুর গাছপালার সাথে গোলাঘর, রান্নাঘর, কলপাড় দেখতে পায়। সামিয়া রান্নায় ব্যস্ত। অনভ্যস্ত খড়ির চুলার ধোঁয়ায় চোখ লাল। হারুন রান্নাঘরের দাওয়ায় গিয়ে বসে,

─ কি করছেন? চমকে তাকিয়ে হারুনকে দেখে আশ্বস্ত হয় সামিয়া।

─ ওহ আপনি, মাগো যা ভয় পেয়েছিলাম, উঠে এসেছেন কেন?

─ মনে হচ্ছিল একটু গোসল করি। কিন্তু আপনার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে আপনাকে সাহায্য করি, কি রাঁধছেন ?

এমন কিছু না, যা পেয়েছি সব ঢেলে দিয়ে খিচুড়ি, হয়ে গেছে প্রায়। গোসল করলে যান চটপট করে আসুন, ঐদিকে টিউবওয়েল আছে। হাঁটতে পারবেন অতদূর?

─ পারব। এখন একটু ভালো লাগছে। শক্তিও পাচ্ছি।

চলুন আমি আপনাকে দেখিয়ে দেই আর শুকনো কাপড় দেই।

─ জলদি করেন আর দেখবেন চুলায় ধোঁয়া যেন না হয়।

─ আচ্ছা, সামিয়া নিঃশব্দ পায়ে দ্রুত ভিতরের ঘরে ঢুকে যায়। খানিক পরে একখানা টাওয়েল আর একটা লুঙ্গি নিয়ে আসে। হারুনকে নিয়ে যায় কলপাড়ে, এক বালতি পানি সাবান রাখা একপাশে।

─ আপনি জলদি গোসল সারেন। ঠাণ্ডা লাগে না যেন আবার।

─ যান আপনি রান্না দেখেন আমি আসছি।

গায়ে পানি ঢালতেই, শিরশির করে উঠে প্রথমে শরীর। দু মগ পানি ঢালার পর আরাম লাগে। রোদে রাখা পানি অতটা ঠাণ্ডা না কিন্তু পানি ঢালার শব্দ হচ্ছে তাই শব্দ না করে গোসল করার জন্য আস্তে আস্তে পানি ঢালে হারুন যতটা সম্ভব শব্দ না করে। কোথায় কি অবস্থায় আছে কিছুই জানা নেই। যে কোনো সময় সামনে যমের মতন মিলিটারি দেখতে পাবে বলে ভয় হতে থাকে। সামিয়ার জন্য আরো বেশি ভয় লাগছে। মেয়েটা এভাবে আয়োজন করে রাঁধতে না বসলেই পারত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সামিয়া চৌধুরী, স্মার্ট সুন্দরী পড়–য়া মেয়ে এভাবে খড়ির চুলায় রান্না করছে, স্বচক্ষে না দেখলে জীবনে হারুন বিশ্বাস করত না। বাঙালি সব মেয়েই কি মায়ের জাত। কতকিছু বদলে দিল এই যুদ্ধের হাওয়া। একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গোসল শেষ করে হারুন।

গা মুছতে গিয়ে টের পায় মিষ্টি একটা গন্ধ টাওয়েলে। এটা কি সামিয়ার টাওয়েল! তাই হবে হয়তো। তাড়াহুড়ায় নিজের টাওয়েলটাই এনে দিয়েছে সামিয়া। ভালোলাগার এক বোধ খেলা করে হারুনের দেহজুড়ে। গোসল করে বেশ ঝরঝরে লাগছে।

চটপট লুঙ্গি আর টাওয়েল ধুয়ে উঠানের টানা তারে মেলে দিয়ে বালতিটা পানিতে ভরে রেখে রান্নাঘরে যায় হারুন।

লাল চোখ মেলে সামিয়া বলে,

─ হলো? আসেন খেয়ে নেন।

─ আপনি?

─ আমিও খাব।

দুজনে নিঃশব্দে খেতে থাকে। একসময় হারুন বলে,

─ আমার কেমন ভয় ভয় লাগছে।

─ আমারও।

─ আসলে চারপাশের খবর, কোনো গ্রামে আছি, মিলিটারি এখানে এসেছে কি না কিছুই জানি না তো।

─ শিবু বলেছিল মিলিটারি এসেছিল গ্রামে। বেশি লোকজন ছিল না, সবাই আগেই পালিয়ে ছিল। দু’এক ঘর মানুষ ছিল আর বাইরে থেকে আগত কিছু মানুষ ছিল তাদের কিছু মারা গেছে একরাতের তাণ্ডবে, যারা ছিল তারাও চলে গেছে গ্রাম ছেড়ে। মিলিটারিরা আরও ভিতরের দিকে গেছে। যে রাস্তা দিয়ে বর্ডার ক্রস করতে হবে সেদিকে। তাই তোমাকে আর আমাকে নিয়ে ঐদিকে যাওয়ার চেয়ে এখানে রেখে যাওয়াটা নিরাপদ মনে করেছে। গত রাতে অনেক গোলাগুলির শব্দ শুনেছি। শিবু বলেছিল ওরা অপারেশন চালিয়ে এলাকা শত্র“মুক্ত করে আমাদের নিতে আসবে।

─ যখন বলেছে তখন আসবে।

─ আজ রাতটা আমরা ওদের জন্য অপেক্ষা করি। তবে এই বড় বাড়িটি ছেড়ে আমাদের ছোট কোনো আস্তানায় মাথা গুঁজতে হবে। যদি মিলিটারি আসে তবে এই বড় বাড়িটাই ওদের টার্গেট হবে প্রথমে।

রান্নাঘর গুছিয়ে সামিয়া বলল, আমি চটপট একটু গা ধুয়ে আসি। গরমে অতিষ্ঠ লাগছে।

─ ঠিক আছে।

গোসল করে খেয়ে শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে, শক্তি পাচ্ছে হারুন। ভিতরের ঘরে ফিরে এসে চারপাশে চোখ বুলাল। কার বাড়ি, কারা থাকত। সব সাজানো পড়ে আছে। কাচের আলমিরার মাঝে চিনামাটির বাসন। আলনা থেকে কয়েকখানা কাপড় বের করে  একটা মাপ মতন পাজামা পেয়ে গেল। সেটা পরে নিল, সাথে হাফ হাতা একটা শার্ট। আরো কখানা কাপড়ের পুঁটলি বাঁধল। পাশে বড় বড় টিনের কৌটায় মুড়ি পেল, একটা চাদরে বেঁধে নিল তাও। শিবু যদি এসে যায় ভালো, নয়তো অন্য আস্তানা খুঁজে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। আশেপাশে কি কোনো লোকজন নাই। এত সুনসান নীরবতা? কোথায় কোনো গ্রামে আছি কিছুই বুঝতে পারছি না। শিবু ভালোয় ভালোয় চলে আসুক। আমার কী হয়েছিল, এখানে কেমন করে এলাম কিছুই মনে পড়ছে না। অস্থিরতায় একটা টেবিলের উপর রাখা কিছু বইখাতা উল্টেপাল্টে দেখতে থাকে হারুন। কলেজে পড়ত কেউ এই বাড়ির। নাম লেখা আছে মোঃ আবদুল হাসিম। প্রথম বর্ষ। রোল নং ৩২। একখানা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই, দুটি কবিতার বই, পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইংরেজি অভিধান। কবিতার বই দু’খানির সাথে সাদা খাতা আর বলপেনটা ঝুলায় ভরতে ভরতে পলাশের কথা মনে পড়ে হারুনের। খাতাভর্তি কবিতা লিখছিল পলাশ।

চুল মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকে সামিয়া। নতুন বেশের হারুনের দিকে অবাক চোখে তাকায়।

হারুন সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে,

─ মোঃ আবদুল হাসিম।

─ কে?

─ এই যে তোমার সামনে দাঁড়ানো।

─ ও তাই নাকি ?

─ হুম, এই বাড়ির ছেলে।

─ আচ্ছা বাবা, মোঃ আবদুল হাসিম, আমরা এখন কি করব বলত? সামিয়াও মজা করে।

─ আমরা শিবুর জন্য অপেক্ষা করব। এরমাঝে তুমি আমাকে বলো আমরা এখানে কীভাবে এলাম? আমার কিছুই মনে পড়ছে না।

─ মোঃ আবদুল হাসিম, তুমি তো এ বাড়ির ছেলে এখানেই ছিলে।

─ তা ঠিক, তুমি এখানে কীভাবে?

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent