বৃহস্পতিবার - মে ৯ - ২০২৪

দহন, লোডশেডিং ও দোজখের আগুন

অপরপ্রান্তে তখন শুভসন্ধ্যা টরন্টো থেকে আমার স্ত্রী উদ্দেশ্য বাংলাদেশে দহন ও লোডশেডিংয়ে প্রায় তেজপাতা হয়ে যাওয়া স্বামীর কারেন্ট হাল হকিকত সম্পর্কে খোঁজ খবর করা কৌতুক মিশ্রিত মিহি কন্ঠ ভালো আছো কেমন যাচ্ছে দিনকাল

আলো আসে আবার আসে না। রাতের শেষ প্রহরে যখন বিদ্যুতের আগমন প্রতীক্ষায় ঘর্মাক্ত শরীর
হঠাৎ তখন খ্যাতনামা লেখক কমলকুমার মজুমদারের, খুব সম্ভবত ‘ফৌজ-ই বন্দুক’ গল্পের এমন একটি বাক্যের কথা মনে পড়ে গেল। গল্পের ইলিউশনের কথা না হয় বাদ দিলাম, প্রকৃত বাস্তব- চৈত্রের নিষ্ঠুর দাবদাহে যেন দোজখের আগুনে জ্বলছে বিদ্যুতবিহীন ঢাকা। মাথার ঘিলু গলে যেন নাসিকা দিয়ে বেরিয়ে যাবার উপক্রম! বিদ্যুত যে শুধু ঢাকা শহরেই আসা যাওয়ার ভেলকিবাজি দেখাচ্ছে তা নয়, দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতির শিকার গোটা দেশের দৃশ্যচিত্র মোটামুটি এক ও অভিন্ন। আসে ক্ষনকালের জন্যে এবং যায় দীর্ঘ সময়ের ছুটিতে এবং এসেই আবার যাবার জন্যে অস্থির। যেন ‘মাধবী এসেই বলে যাই’।
ভোররাতের দিকে এহেন গজবের ভিতর টেলিফোন বেজে ওঠে অকস্মাৎ। অপরপ্রান্তে তখন শুভসন্ধ্যা। টরন্টো থেকে আমার স্ত্রী। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশে দহন ও লোডশেডিংয়ে প্রায় তেজপাতা হয়ে যাওয়া স্বামীর কারেন্ট হাল-হকিকত সম্পর্কে খোঁজ খবর করা। কৌতুক মিশ্রিত মিহি কন্ঠ, ভালো আছো? কেমন যাচ্ছে দিনকাল?
সম্পর্কের ক্ষেত্রে কদাচিৎ এক-আধটু অগ্নিকান্ড, ছিটেফোঁটা ঝড়বৃষ্টি, কালেভদ্রে বজ্রপাত, দহন, লোডশেডিং আর প্রায়-অনুচ্চারিত ভালোবাসাবাসির হালকা পাতলা মিশেল আর আলো-আঁধারের আসা-যাওয়া নিয়ে আমাদের সংসার চৌত্রিশ বছরের। ফলে স্বভাবিক, একে অপরের মিহি কন্ঠের লুকোনো ভাষার মর্মার্থ কারো কাছে আজ আর অষ্পষ্ট কিংবা অবোধ্য নয়। আমি বলি, ইয়ার্কি হচ্ছে? মশকরা করছো মনে হচ্ছে। এবার কপট রাগ অপরপ্রান্তে, আরে ইয়ার্কি করবো কেন! ইন্টারনেটে ঢাকার পত্রিকায় দেখলাম, বিদ্যুত থাকে না বারো-চৌদ্দ ঘন্টা, পানীর অভাবে পুরোনো ঢাকায় নাকি কারবালার মতো অবস্থা, ঢাকার কোনও কোনও এলাকায় নাকি সারাদিন রান্না হয় না, গ্যাস থাকে না দিনের বেলা, রাত বারোটার পর গ্যাস এলে তখন চুলোতে হাড়ি বসে। এসব সত্যি নাকি? সারা দেশে নাকি ছ’টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত এয়ারকন্ডিশন চালানো বন্ধ? কেউ চালালে নাকি তিন মাসের জেল হবে?
আমি নিরুত্তর থাকি, এজাতীয় প্রশ্নের তাৎক্ষনিক কোনও উত্তর জানা নেই বলে। তবে পত্রিকায় পড়েছি এবং টিভি চ্যানেলে আমিও দেখেছি এখবরটি। জান লবেজান হওয়া গরমের ভেতরেও স্যুট-টাই পড়া বিদ্যুত-কর্তা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে টিভি ক্যামেরার সামনে বিদ্যুত সাশ্রয়ের লক্ষ্যে প্রতিদিন সন্ধ্যা ছ’টা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত এয়ারকন্ডিশন না চালানোর নির্দেশ দিচ্ছেন। হোয়াট এ জোক। যেন শিশিরের কার্টুনকেও হার মানায়। কারো অজানা নয় যে, অন্তহীন বিদ্যুৎ সংকটে সাশ্রয় অতীব জরুরি। তবে সেই সাশ্রয়ের নামে, আপামর জনগোষ্ঠির সীমাহীন এই দুর্ভোগের সময়, জাতির সঙ্গে এহেন বাস্তববোধবর্জিত ইয়ার্কি মশকরা তিনি কার প্ররোচনায় কিংবা কার বুদ্ধি পরামর্শে করলেন আজো তা বোধগম্য নয়। জাতীয় দুর্যোগ নিয়ে এহেন তামাশা ইতিপূর্বে চোখে পড়েনি আর তিনি যখন টিভি ক্যামেরার সামনে ‘বিদ্যুৎ সাশ্রয় ইয়ার্কি’তে মশগুল আমার মনে তখন বারবার কয়েকটি স্বাভাবিক মৌলিক প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছিলো। যে সময়ে এসি বন্ধ রাখার নির্দেশ নাজেল হল, সবার জানা, এ সময়টুকু হচ্ছে প্রাইম টাইম। বিদ্যুত-কর্তা কিন্তু এই হাস্যকর ‘বিদ্যুত ফরমানে’র আওতায় কারা পড়বে এবং কারা পড়বে না তা স্পষ্ট করলেন না। বর্তমান ও সাবেক রাষ্ট্রপতিদের বাসভবন ও কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রির বাসভবন ও কার্যালয়, বিরোধী দলীয় নেত্রী, মন্ত্রীপাড়া, সেনা ও পুলিশ কর্তাদের বাসভবন, সংসদ ভবন, সংবাদপত্র, বেতার টিভি, আমলা, ব্যবসায়ী, ধনাঢ্য ভূমি দস্যু আর বাঘা বাঘা রাজনীতিক এই ছ’টা-এগারোটার আওতামুক্ত না আওতাভুক্ত?
একথা অনস্বিকার্য যে, বিদ্যুৎ ঘাটতি একটি জাতীয় সমস্যা। আজকের এই বিদ্যুৎ ঘাটতিজনিত সমস্যার জন্যে কোনও সরকারকেই এককভাবে দায়ী করা যায় না। ইয়ার্কি মশকরা আর হাস্যকর
অযৌক্তিক ফরমানে এ কঠিন সমস্যার সমাধান হবে না। রাতারাতি এই সমস্যা থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব না হলেও দেশকে সচল রাখার স্বার্থে সরকারের উচিত সময়ক্ষেপন না করে এই সেক্টরে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। সোলার পাওয়ার বা সৌর বিদ্যুতের কথা বলা হচ্ছে বহুদিন থেকে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া স্বত্তেও পরিবেশ ও আগামী ভবিষ্যতের কথা ভেবে সোলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। আমাদের দেশে সোলার পাওয়ার বা সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার আইনের মাধ্যমে ম্যানডেটরি করা উচিত। যে কোনও ধরনের নতুন নির্মানের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সোলার পাওয়ারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার বাধ্যতামুলক শর্ত জুড়ে দিয়ে দেশে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। প্রতিটি সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চাহিদানুসারে সোলার পাওয়ারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সৌর প্যানেল আমদানিকারক এবং ব্যবহারকারীদের কর মওকুফ ও ভতুর্কি প্রদানের বিষয়টিও সরকার ভেবে দেখতে পারেন।

ইস্টইয়র্ক, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent