রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

ঝাপসা একটা ছবির গল্প

লুৎফর রহমান রিটন

সত্তরের দশকে আমরা একগুচ্ছ তরুণ এসেছিলাম লেখালেখির জগতটাতে। আমাদের সকলেরই প্রায় এক দশকের কর্মকান্ডগুলো গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিলো আশির সূচনায়, অর্থাৎ ১৯৮১/৮২ সালে। এই সময়কালেই প্রকাশিত হয়েছিলো আমাদের প্রথম বই। আমার ছড়ার বই ধুত্তুরি, রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর উপদ্রুত উপকূল, কামাল চৌধুরীর মিছিলের সমান বয়েসী, আবু হাসান শাহরিয়ারের আসমানী সাবান, মাসুদুজ্জামানের উদিত দুঃখের দেশ, মঈনুল আহসান সাবেরের পরাস্ত সহিস, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর লিন্ডা জনসনের রাজহাঁস, ইসমাইল হোসেনের র, সৈয়দ আল ফারুকের উড়োখুড়ো মন, ইসহাক খানের নগ্ন নাটমন্দির, মোহন রায়হানের জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ ছিলো সেই সময়ের উজ্জ্বল সাক্ষর।

সেই তরুণেরা তাঁদের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থের মাধ্যমেই জানান দিয়েছিলো–আমরা এসেছি থাকবো বলেই।

- Advertisement -

কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত কবি জাফর ওয়াজেদের একটা কবিতার বইয়ের নাম ছিলো–দেশ তার হারায় গৌরব। কাইয়ুম চৌধুরীর প্রচ্ছদ শোভিত বইটি খুবই প্রিয় ছিলো আমার।

আজ সকালে পুরনো ছবির এলবামে চোখ বোলাতে গিয়ে একটা ছবির ওপরে চোখ আটকে গেলো। একটা গ্রুপ ছবি। ছবিটা খুবই ঝাপসা। কারণ মুদ্রিত গ্রন্থ থেকে ছবিটি নেয়া হয়েছে। মূল ছবিটা নিশ্চয়ই এরকম ঝাপসা ছিলো না। তবে ঝাপসা হলেও খুব অনায়াসেই চেনা যায় ছবির পাত্র পাত্রীদের।

একটা চেয়ারে বসে আছেন নতুন বউয়ের সাজে সজ্জিত হাস্যোজ্জ্বল তসলিমা নাসরিন। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ডান দিক রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ, মোহন রায়হান, আলী রীয়াজ, লুৎফর রহমান রিটন এবং জাফর ওয়াজেদ।

ছবিটা রুদ্র এবং তসলিমা নাসরিনের বিয়ের রিশেপসন অনুষ্ঠানের। এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগনালের মোড়ের বেইজিং চায়নিজ রেস্টুরেন্টে আয়োজিত সেই রিসেপশন অনুষ্ঠানটা আমাদের শিল্পসাহিত্য অঙ্গণের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকলের উপস্থিতিতে খুবই বর্ণিল আর জমজমাট ছিলো।

রুদ্র ছাড়া এই ছবির সকলেই এখনও বহাল আছেন এই পৃথিবীতে। সকলের সঙ্গেই আমার দেখা হয় বাংলাদেশে কিংবা অন্যদেশে, শুধু একজন ছাড়া, তিনি তসলিমা নাসরিন।

কয়েক বছর পর।

বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলাটি এতো বড় ছিলো না তখন। মেলাটা শুধুই বাংলা একাডেমি চত্বর জুড়েই থাকতো কেবল। বইমেলার একটা অংশে চা-সিঙ্গারার দু’তিনটে স্টল থাকতো। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমরা সেখানে জিরিয়ে নিতাম। আড্ডা দিতাম প্রিয়জনদের সঙ্গে।

এক বিকেলে আমি আর শার্লি সেরকম একটা স্টলে বসে আছি। এমন সময় সেখানে এলেন তসলিমা–রুদ্র কি এসেছে মেলায়? আপনি কি দেখেছেন তাকে?

–না। দেখা হয়নি। মেলাটা বেশ কয়েকবার চক্কর দিয়েছি। রুদ্র আসেন নি এখনো। বসুন।

তসলিমা বসলেন। আরেক কাপ চা এলো। শার্লির সঙ্গে তাঁর খুব ভাব হয়ে গেলো দ্রুত। তাঁর ‘শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা’ নামের কবিতার বইটা শার্লিকে লিখে দিলেন তসলিমা। একজন মহিলা ফেরিওয়ালা এক হাতে খুদে খুদে কালো বিচির কতোগুলো মালা ঝুলিয়ে চলে যাচ্ছিলেন আমাদের টেবিলের পাশ দিয়ে। তসলিমা তাঁকে থামিয়ে দু’টি মালা কিনলেন। একটা নিজে নিলেন অন্যটা উপহার দিলেন শার্লিকে। তসলিমা ডানে বামে নজর রাখছিলেন। তাঁর চোখ রুদ্রকেই খুঁজছিলো। কিছুক্ষণ পর সঙ্গে থাকা ব্যাগ থেকে একটা শাদা এনভেলাপ বের করে তসলিমা সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, এটা রুদ্রকে দিতে পারবেন?

–নিশ্চয়ই। (এনভেলাপটা টেবিলের ওপর রেখে জিজ্ঞেস করলাম) কি এটা?

তসলিমা বললেন–ডিভোর্স লেটার।

খানিকটা চমকে উঠলাম আমি!

–ডিভোর্স লেটার!

–হ্যাঁ।

তারপর কি মনে করে সেটা ফেরত নিয়ে বললেন

–না, এটা আমিই দেবো রুদ্রকে। আমাকেই দিতে হবে। যাই শার্লি। গেলাম। আবার দেখা হবে।

তসলিমা চলে গেলেন মেলার ভিড়ে।

খুব মন খারাপ করে বসে থাকলো শার্লি। একটা বিষণ্ণতা ওর বিকেলের উচ্ছ্বলতাকে গ্রাস করে নিলো।

সময় বহিয়া যায়।

২০১৮ সালের জুনের শেষ সপ্তাহে নিউইয়র্ক বইমেলায় গিয়ে তুমুল হল্লায় মেতে আছি।

বাংলাদেশ থেকে আসা লেখক প্রকাশক এবং নিউইয়র্কের লেখক বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছি।প্রতিদিন সন্ধ্যায় তুমুল আড্ডা দিচ্ছি ‘লেখক কুঞ্জ’ নামে পরিচিত চারপাশ উন্মুক্ত একটা গোলাকার স্টলে।

এখানেই দেখা হয়ে গেলো ‘পাগল মন’ খ্যাত কণ্ঠশিল্পী দিলরুবা খানের সঙ্গে। বহু বছর বাদে আমাদের দেখা। দুজনেরই উচ্ছ্বাস যেনো থামতেই চায় না।

বইমেলার ভিড়ে হঠাৎই পেয়ে গেলাম কেয়া চৌধুরীকে। বিটিভির নাটকের বিখ্যাত অভিনয় শিল্পী। কবি আহসান হাবীবের কন্যা। টেলিভিশনকে কেন্দ্র করে অনেক স্মৃতি আমাদের। আমাকে দেখেই হইহই করে উঠলেন। আমিও। জানলাম কন্যার কাছে এসেছেন।

আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই কেয়া আপা ফোন করলেন বিটিভির এক কালের বিখ্যাত প্রযোজক শাহীদা আরবীকে–সাথী আমি অমুক জায়গায়। তাড়াতাড়ি আসো তোমার সঙ্গে একজনের দেখা করিয়ে দিই। তুমি খুশি হবে তাকে দেখলে। দ্রুত আমি একটা পিলারের আড়ালে চলে গেলাম। শাহীদা আরবী এসেই কেয়া চৌধুরীকে বললেন–রিটন ছাড়া আর কার সঙ্গে দেখা করাইবা?

বিস্মিত আমি আড়াল থেকে সামনে আসি–আপা তুমি জানলে কী ভাবে যে কেয়া আপা আমার কথা বলছেন?

শাহীদা আরবী বললেন–নিউইয়র্ক বইমেলায় তোমারে ছাড়া আর কারে দেখলে আমি খুশি হমু কও!

এরপর আমাদের তিনজনার আড্ডার আতশবাজি কতো যে দ্যুতি আর রঙ ছড়ালো! শাহীদা আরবীও মার্কিন মুলুকে এসেছেন কন্যার সঙ্গে কিছুদিন থাকবেন বলে।

দেখা হলো সুমী সিকান্দারের সঙ্গে। কবি সিকান্‌দার আবু জাফরের কন্যা। সুমীর মা কবি কাজী রোজী। সুমীকে দেখলেই আমার মনের মধ্যে এক ধরণের উচ্ছ্বাস কাজ করে। ওর বাবার নামে চালু হওয়া ‘সিকান্‌দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার’টি প্রথমবারই পেয়েছিলাম আমি, ১৯৮২সালে, আমার প্রথম প্রকাশিত ছড়ার বই ‘ধুত্তুরি’র জন্যে। ছত্রিশ বছর আগে, তরুণ বয়েসে ছড়াকার হিশেবে প্রতিষ্ঠিত হবার সংগ্রামমুখর সময়টায় আমার পায়ের তলায় শক্ত মাটির ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলো সিকান্‌দার আবু জাফরের নামাঙ্কিত সেই পুরস্কারটি।

হঠাৎই মেলায় উদয় হলো তারেক অণু আর তানভীর অপু। ওরা দুই ভাই আমার বিশেষ প্রীতিভাজন। ওরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমেরিকার নানান অঞ্চল চষে বেড়ানোর প্ল্যান নিয়ে নিউইয়র্কে এসেছে। শেষ দিন ২৪ জুন রাতে মেলা শেষে ওদের সঙ্গে আমরা কয়েকজন হানা দিয়েছিলাম ম্যানহাটনের টাইম স্কয়ারে। মৃদুল আহমেদ আমাদের নিয়ে গিয়েছিলো। ড্রাইভ করতে করতে উচ্ছ্বাসে আনন্দে মৃদুল বারবার গেয়ে উঠেছে প্রিয় সব গান।টাইম স্কয়ার নামক আলো ঝলমল বর্ণিল আলোর প্লাবনে ভেসে যাওয়া এই জায়গাটা আমার বিশেষ প্রিয়। নানান দেশের নানান বয়েসের প্রাণবন্ত মানুষের বিপুল উপস্থিতি জায়গাটাকে স্বর্গীয় আবহে পরিপূর্ণ করে রাখে। এতো রঙ আর আলো পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই দেখেছি। টোকিওর সিনজুকু বলে একটা জায়গা আছে এরকম রঙিন, বর্ণাঢ্য। বারবার আসি আমি টাইম স্কয়ারে। রবীন্দ্রনাথও মনে হয় এসেছিলেন এখানে। নইলে আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা/ আলো নয়ন ধোয়া আমার আলো হৃদয় হরা’ গানটা লিখলেন কী করে!

বইমেলা সমাপ্তি দিনের সন্ধ্যায় জমাট আড্ডার ভিড়ে কবি সৈয়দ আল ফারুক আমাকে একান্তে জানালেন, জানো নাকি তসলিমা নাসরিন এসেছে মেলায়। অঙ্কুর প্রকাশনীর স্টলে। যাই দেখা করে আসি।

তসলিমার এক বোন থাকে নিউইয়র্কে। তাঁর বোনের কন্যাটির নাম ‘ভালোবাসা’। ভালবাসার মায়ের সঙ্গে বইমেলায় আমার দেখা হয় প্রায় প্রতিবারই। এবারও হয়েছে।

জমাট আড্ডা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে আমার সামান্য দেরি হয়ে গেলো। দ্রুত অঙ্কুর প্রকাশনীর স্টলে গিয়ে দেখি প্রকাশক মেসবাহ বসে আছেন। মহা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে আমি জানতে চাইলাম মেসবাহ ভাই তসলিমা নাকি এসেছেন? কোথায় তিনি?

মেসবাহ ভাই বললেন, এসেছিলেন, খুব অল্প সময়ই ছিলেন। খুব ভিড় হয়ে গেলো জায়গাটায় তাই চলে গেছেন।

শুনে খুব মব খারাপ হয়েছিলো আমার। আহারে কতোদিন দেখি না তাঁকে! নব্বুইয়ের দশকের পর আর দেখা হয়নি।

শুধুমাত্র লেখালেখির কারণে দাউদ হায়দারের মতো তাঁকেও আমরা দেশছাড়া করে রেখেছি। একজন মানুষের কাছ থেকে তাঁর মাতৃভূমি বা দেশ কেড়ে নেয়ার মতো ঘৃণ্য বর্বরতা আর কী হতে পারে!

২০০১-এর পর জামাত-বিএনপি জোট সরকার আমাকে সাত বছর দেশে ফিরতে দেয়নি। আমাকে আমার প্রাপ্য পাসপোর্টটি ফেরৎদেয়নি। কতো আবেদন নিবেদনকরেছি পাসপোর্টের জন্যে। কিন্তু দেয়নি।দেশে যাবার জন্যে কী রকম অস্থির পাগল দশা হয়েছিলো আমার! কতো যে অশ্রু ঝরেছে তখন! বুকের ভেতরে কেমন একটা শুন্যতা-হাহাকার জমাট বেঁধে থাকতো সারাক্ষণ। তখন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কণ্ঠে–‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে…তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’ শুনে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছি। মাত্র সাত বছরেই আমার যে কষ্ট হয়েছিলো সে তুলনায় তসলিমা নাসরিনের কষ্টটা আরো অনেক অনেক গুণ বেশি। এখন, আমি চাইলেই যখন তখন ফিরতে পারি নিজের দেশে। কিন্তু তসলিমা পারেন না।

একজন মানুষের কাছ থেকে তার দেশ কেড়ে নেয়া আধুনিক পৃথিবীর সবচে অসভ্য আচরণ।

তসলিমার সঙ্গে দেখা হলে ভালো হতো। কতোদিন দেখিনি তাঁকে!

কে জানে হয়তো দেখা একদিন হয়েই যাবে আমাদের, এই পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে।

- Advertisement -

Read More

Recent