রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

জিনের কারবার

ছবি ইলি এলেন

কোরআন-পুরাণের জিন না, এ একেবারে শরীরের কোষে বসবাসরত জিন। আগেই যেমনটা বলেছি, অর্থাৎ মায়ের জরায়ুতে পিতার শুক্রাণু ও মায়ের ডিম্বাণুর মধ্যে নিষিক্তের সময় উভয়পক্ষ থেকে সমান সমান ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের একটা মিতালি গড়ে ওঠে। বিশে^র বেশিরভাগ মানুষের কোষে এই ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম অটুট। এর ব্যতিক্রম ঘটলে, অর্থাৎ প্রকৃতির খেয়ালে কারো কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম না হলে, তারা ভিন্ন ধরনের মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়, তখন আমৃত্যু এই অসংগতি নিয়ে তাদের চলতে হয়। যাহোক, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরে এই ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমকে ঘিরে ২০-২৫ হাজার জিন বসবাস করে এবং এদের বেশিরভাগই প্রোটিনজাত। সবচেয়ে মজার তথ্য হচ্ছে মাত্র ১ ভাগ জিন মানুষের নিজস্ব, বাকি ৯৯ ভাগ অন্যান্য প্রাণীর জিনের মতো কোনো আদি উৎস থেকে বিবর্তনসূত্রে পাওয়া। অন্ততপক্ষে ১৪৫টি জিন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা উদ্ভিদ থেকে সরাসরি এসেছে। তার মধ্যে ২০-২৫টা প্রোটিনজাত জিন আমাদের শরীরকে পাহারা দেয় অথবা আরও ভালোভাবে বললে তারা আমাদের কোষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের সাথে যুক্ত। বিশেষ করে সারতুইন পরিবারের ৭ সদস্য, তারা যেন ঠাকুরমার ঝুলি নামক রূপকথার গল্পের সেই পারুল বোনের সাতভাই। বিজ্ঞানীরা আদর করে ডাকে সারতুইন ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬ এবং ৭। ছত্রাক থেকে আসা বিধায় বিজ্ঞানীরা তাদের নাম আর বদলায়নি। বাংলায় ইচ্ছে করলে আমরা তাদেরকে চম্পা হিসাবে ডাকতে পারি। গল্পটা এরকম :

এক দেশের এক রাজা সন্তানের আশায় একে একে ছয়জনকে বিয়ে করে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে ওই ছয় রানির কারোরই বাচ্চাকাচ্চা হয় না। তখন স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে রাজা সপ্তম বিয়ে করলে সেই সপ্তম রানির গর্ভে একসাথে সাতটি ছেলে ও একটি মেয়ের জন্ম হয়। সন্তান জন্মের খবর পেয়ে ওই ছয় রানি বাচ্চাগুলোকে মেরে গর্তে পুঁতে রাখে আর রাজাকে বলে যে ছোট রানির গর্ভে ইঁদুর-বেড়ালের জন্ম হয়েছে। শুনে রাজার সে কি রাগ! রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে তিনি তখন ছোট রানিকে বনবাসে পাঠিয়ে দেন। ওদিকে কিছুদিনের মধ্যে পুঁতে রাখা সেই গর্ত থেকে একসাথে সাতটি চম্পা ফুল এবং একটি পারুল ফুলের জন্ম হয়। ফুলগুলো দেখতে যেমন নজরকারা, তাদের গন্ধও তেমনি মনোহারি। রাজার মালি সেই ফুল তুলতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং একমাত্র বোন পারুল ফুলের অনুরোধে একে একে রাজা এবং ছয় রানিকে তো বটেই, এমনকি বনবাস থেকে ছোট রানিকেও সেখানে আসতে হয়। তখন সকলের সামনে ওই ফুলেরা তাদের গল্প শোনায় এবং এভাবে ছয়রানির শয়তানির খবর রাষ্ট্র হয়ে গেলে রাজা তাদের তাড়িয়ে দিয়ে ছোট রানিকে ঘরে ফিরিয়ে নেয়।

- Advertisement -

রূপকথার গল্পের সাথে কোষের মধ্যে বসবাস করা ওই সাতভাইয়ের গল্পের কোনো মিল হয়তো নেই, কিন্তু বাস্তবে তাদের কাজকাম ওই রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। ছত্রাকের মধ্যে বসবাসরত সারতুইন নামক জিনগুলোর ওপরে চালিত যেকোনো পরীক্ষার ফলাফল মানুষের বেলায়ও যে হুবুহু খেটে যায়, বিস্ময়ের কারণ সেটাই। এই সারতুইন পরিবারের সদস্য হয়ে টিকে আছে কব্বি নামক ব্যাকটেরিয়াজাত এক জিন। কোটি কোটি বছর আগে এই ছত্রাক কিংবা ব্যাকটেরিয়াই কি তবে আমাদের আদি প্রাণের উৎস? সেই প্রশ্ন কিন্তু মনের মধ্যে ওঠে। জবাব যাই হোক, এই জিনেরা এককভাবে অথবা সম্মিলিতভাবে ওই পারুল বোনের কেবল খোঁজখবর রাখে তা না, যেকোনো বিপদে তারা বোনের পাশে দাঁড়ায়।

অধ্যাপক ডেভিড সিনক্লিয়ারের মতো দীর্ঘায়ুর গবেষকদের কাছে এই সাত জিনের কদর তাই অনেক বেশি। কী কী খেলে বা কী ধরনের জীবনযাপন করলে এরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, সেটা নিয়ে নানা গবেষণা। ৭টি জিনের মধ্যে ৩টা থাকে মাইট্রকন্ড্রিয়ার ভেতর, ৩টা মাংসপেশিতে এবং বাকি ১টা থাকে প্রতিটি কোষের সাইটপ্লাজমায়। এরা হয় বিশেষ ধরনের মেটাবলিজমের অথবা ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ মেরামতের কাজ করে। এমনিতে সক্রিয় থাকে না, কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে তারা জেগে ওঠে। যেমন স্বল্পাহার, রোজা, শরীরচর্চা ইত্যাদিতে সারতুইন-১ এবং ২ উভয়েই সাড়া দেয়। আবার ঠাÐায় কাঁপতে থাকলে বা অনেক গরমে শরীর ঘামতে শুরু করলে সারতুইন-৩ জেগে ওঠে। নানা কারণে যখন ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তাদের মেরামত করতে জেগে ওঠে সারতুইন-১, ৬ এবং ৭। বিশে^র বিভিন্ন দেশের শতায়ুদের নিয়ে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, এদের শরীরের সঞ্চয়ি হিসেবে সারতুইন-১ এর পরিমাণ অন্যদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। সেজন্য, তারা ঘুমায় ভালো এবং জ¦র-সর্দি-কাশি তো বটেই জীবনযাপনজনিত নানা রোগবালাই তাদের কাছে আসতে পারে না।

রোজা, স্বল্পমাত্রার শরীরচর্চা ছাড়াও উদ্ভিদজাত অনেক খাবারের মধ্যে সারতুইনকে জাগানোর গোপন রহস্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিরূপ পরিবেশে টিকে থাকে এমন বৃক্ষের ফলে, ছালে কিংবা শেকড়ে এমন সব উপাদান থাকে, যা আমাদের পরিপাকতন্ত্রের পথ বেয়ে কোষের সেই বিশেষ জিনগুলোকে সক্রিয় করে তোলে। হার্ভার্ড বিজ্ঞানী ডেভিড সিনক্লিয়ার এর নাম দিয়েছেন জিনোহার্মেসিস এবং এই প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদজগতের এই গোপন হাতিয়ারটি জীবদেহে সঞ্চারিত হয়। এ নিয়ে পরে বিস্তারিত বলা যাবে, আপাতত জেনে নিই কোন কোন খাবারে সারতুইন নামক কোন কোন জিন জেগে ওঠে, সেই কথা। পলিফিন্যাল বেশি এমন যেকোনো খাবার যেমন জয়তুন ফল থেকে পাওয়া এক্সট্রাভার্জিন অলিভ অয়েল, ডার্কচকোলেট, মাচা গ্রিন-টি, ওয়ালনাট, পার্সলি পাতা, কেল শাক, লাল পেঁয়াজ এবং হলুদ― এগুলো সারতুইন ১ ও ২কে জাগায়। ৩কে জাগানোর জন্য কোনো খাবার নেই। কিন্তু ৬ ও ৭কে জাগাতে ব্রকলি, সেলারি, সবুজ আপেলেই সেরা।

ক্যালগেরি, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent