বৃহস্পতিবার - মে ৯ - ২০২৪

বিজয় সংহত করণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
৯ জানুয়ারি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে বঙ্গবন্ধুর মিটিংটি আয়োজন করেন লন্ডনে ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের হেড অব ইন্ডিয়ান ডেস্ক-এর ইয়ান সাদারল্যান্ড। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে মিটিং আয়োজন সম্পন্ন করে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এটি ছিল এক অতীব প্রয়োজনীয় এবং বঙ্গবন্ধুর ভাষায় অত্যন্ত কার্যকরী ও প্রতিশ্রুতিশীল মিটিং। এর আগে-পরে কোন এক সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বঙ্গবন্ধুর ফোনে কথা হয়, যা আয়োজন করে দেন লন্ডনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আপা বি পন্ত, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুকে লন্ডনে অভ্যর্থনা জানানো কয়েকজনের একজন। বঙ্গবন্ধুকে আনার জন্য ভারতের পক্ষ থেকে একটি ভিআইপি প্লেনের ব্যবস্থা করা হলেও পরে এডওয়ার্ড হিথের সাথে কথা বলে ইন্দিরা গান্ধী ব্রিটিশ রয়াল এয়ারফোর্সের একটি মিলিটারি জেটের ব্যবস্থা করেন এবং দ্বিতীয়বারে ফোনকলে সেটি তিনি বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন। শশাঙ্ক ব্যানার্জি তাঁর লেখায় তেমনটিই উল্লেখ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের কাছে লেখা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের বর্ণনা অবশ্য একটু আলাদা। তাঁর তথ্য মতে রয়াল ব্রিটিশ এয়ারফোর্সের বিশেষ প্লেনে করে দেশে ফেরার সিদ্ধান্তটি ছিল স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর।
যেভাবেই ঘটুক, বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে বাংলাদেশ বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ধারণাকে মজবুত করতে সাহায্য করে। কারণ, পশ্চিমা বিশ্বে নেতিবাচক প্রচারের প্রভাবে মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে ভারতের ঔপনিবেশ। শুধু তাই না, বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযানকে আগ্রাসন বিবেচনা করে বহু দেশ বাংলাদেশের আবির্ভাবের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সক্রীয় অংশগ্রহনকে আগ্রাসন বিবেচনা করা হতে পারে, তেমন সচেতনতা ভারত সরকারের ছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এ বিষয়ে কতটা সচেতন ছিলেন তা বুঝা যায় ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল তারিখে তাজউদ্দীন আহমেদের সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময় প্রবাসে সরকার গঠনের আহ্বান জানানোর ঘটনায়। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য প্রদেশে চলমান মাওবাদী গেরিলা তৎপরতাকে মাথায় রেখে সম্পূর্ণ জাতীয়তাবাদী চেতনা-নির্ভর বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা মুজিববাহিনীকে গড়ে তোলা হয়, মূলত: চীনের অভিসন্ধি থেকে মুক্তিযুদ্ধকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য থেকে। মুজিবনগর সরকারের অভ্যন্তরে মার্কিন বনাম রাশিয়া দ্বন্দ্ব, সরকারের উপদেষ্টা পদে চীনপন্থী হিসেবে পরিচিতি মাওলানা ভাসানী ও সোভিয়েত-পন্থী হিসেবে পরিচিত মণি সিং-এর দ্বন্দ্ব, সেনাবাহিনীর অফিসারদের মধ্যে নানাধরনের রাজনৈতিক বিশ্বাসের টানাপোড়েন, এসব লেগেই ছিল। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সরকারের পক্ষে ঐক্য ধরে রাখা আদৌ সম্ভব হতো কি-না সেই বিষয়টি ভারত সরকারকে বিবেচনা করতে হয়েছিল। সেই বিবেচনা থেকে মুজিববাহিনী তৈরী এবং তাকে মুজিবনগর সরকারের কর্তৃত্বের বাইরে রাখা। এই ব্যক্তিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করার জন্য যা যা লাগে তার সবকিছু প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমেই সম্পন্ন করেছিল ভারত সরকার। এমনকি, শেষ পর্যায়ে এসে বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের বিষয়টি অনিবার্য হয়ে উঠলে সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে এককভাবে পাঠানোর পরিবর্তে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনী গঠন করে ওই অভিযানটি পরিচালনা করেন ইন্দিরা গান্ধী। নানাভাবে চেষ্টা করেও মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বৃহত্তর জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে প্রমান করা সম্ভব হয়নি। না জাতিসংঘে না মার্কিন জনগণের কাছে।
১৬ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনীর কাছে পাকিস্তান মিলিটারির আত্মসমর্পনের সেই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনের কয়েকদিনের মাথায় প্রবাসী মুজিবনগর সরকার ঢাকায় এসে দায়িত্ব গ্রহন করে এবং পাকিস্তানের রেখে যাওয়া প্রশাসনিক কাঠামোকে একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী কাঠামোতে রূপান্তরের কার্যক্রম শুরু করে।
ওদিকে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে লন্ডন যাত্রা এবং সেখান থেকে দিল্লী হয়ে ঢাকায় আসার পুরো পথে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী ভারতীয় কুটনীতিক শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু তখন বঙ্গবন্ধু, ১৯৬২ সাল থেকে যিনি বাংলাদেশ নামক উদ্যোগের সাক্ষী; তা সত্ত্বেও ভারতের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সন্দেহ নামক মারাত্মক রোগ দ্বারা বঙ্গবন্ধু যেন কোনোভাবেই আক্রান্ত না হন, সেদিকে ছিল তাঁর সতর্ক দৃষ্টি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিসের সাথে বঙ্গবন্ধুর কথাবার্তা শশাঙ্ক ব্যানার্জির পক্ষে জানার কথা না; কিন্তু বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রথম সুযোগে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার সংক্রান্ত অনুরোধের পরে পশ্চিমা বিশ্বের মনোভাব অুনমান করতে তাঁর এতটুকু দেরি হয়নি।
শীতলযুদ্ধের এক নম্বর প্রতিপক্ষ সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার কারণে বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীন দেশ হিসেবে বিকশিত হতে পারবে কি না সে বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সন্দেহ ছিল পনেরো আনা। সেই আশঙ্কার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিস্কন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের মধ্যে অনুষ্ঠিত আলোচনায়। ভারতের প্রভাবমুক্ত হয়ে বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কি না, সেই সন্দেহ মার্কিন নীতি নির্দ্ধারকদের পেয়ে বসেছিল। তাছাড়া, জুলফিকার আলি ভুট্টো কর্তৃক পাকিস্তানের সাথে শিথিল কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব তো ছিলই। কিন্তু সেই কনফেডারেশন কতটা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে মার্কিনীদেরও সন্দেহ ছিল বারো আনা। বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বিষয়ে ১৩ পৃষ্ঠার গোপন নথিতে সেই প্রেক্ষাপটটি উঠে এসেছে:
যখন আমরা বিশ্বাস করি যে, পৃথক বাংলাদেশ একটি বাস্তবতা, তখন আমাদের অন্যরূপ আর কিছুই করা ঠিক হবে না। আগামী আরো কয়েক মাস আমাদেরকে সতর্কততার সাথে মূল্যায়ন করতে হবে যে, সাবেক পূর্ব প্রদেশ সম্পর্কে ভুট্টো কী ধরণের কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের প্রকৃতি এবং নিজ ভূ-খন্ডের ওপর সার্বভৌমত্বের অর্থবহ অনুশীলনে বাংলাদেশের সামর্থ বা সামর্থের অভাবকেও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।
সামর্থ ও সামর্থের অভাব হচ্ছে সেই সব নির্ণায়ক, যা দেখে একটা রাষ্ট্র নিজ পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম কি না সেটা অনুমান করা হয়। মার্কিন নথিতে বাংলাদেশের সামর্থের বিষয়টি ভারত প্রজাতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তির পাশাপাশি উভয় দেশের আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের সাথে সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, তাতে সন্দেহ নাই। এটি ফেলে দেয়ার মতো না। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে মার্কিন বিশ্লেষকদের নজর না পড়াকে দুঃখজনকই বলতে হবে। ভারত প্রজাতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি বা গল্পের দূর্বলতা নিয়ে অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে নতুন করে বলার কিছু নাই। এটুকু উল্লেখ না করলেই নয় যে, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনের গল্পটি এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা। অজ্ঞানতা অথবা অঞ্চলবহির্ভূত তত্ত্বের প্রভাবে সমাজের উপরিকাঠামোতে বায়বীয়ভাবে সৃষ্ট কিছু সমস্যা ছাড়া বাংলাদেশের মানুষকে ভারত অথবা পাকিস্তানের মানুষদের ন্যায় জাতীয় পরিচয় নির্দ্ধারণের মতো জটিল কোনো সংকটে পড়তে হয়নি।
ক্যালগেরি, কানাডা
- Advertisement -

Read More

Recent