মঙ্গলবার - মে ৭ - ২০২৪

আমার স্মৃতির বাড়ি

আমার স্মৃতির বাড়ি

গত পরশু থেকে গোবিন্দগন্জের ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশের আমাদের বাড়িটি সড়ক বিভাগের লোকেরা ভাঙ্গতে শুরু করেছে। আমি এই দুর প্রবাসে বসে বড় বড় হাতুরি শাবল আর গাঁইতির শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে ঐসব হাতুরির আঘাত আমার বুকের উপর পরছে দুরুম…. দুরুম করে

আমার রক্ত মাংস পিষে থেতলে করে দিচ্ছে তারা। আমার শৈশবের আদরের আঁচলটা যেন টেনে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে। তবুও ভাবছি বৃহত্তরের স্বার্থে ক্ষুদ্রতরের এই দান মানুষের মঙ্গলের জন্যই তো! সেখানে আমাদের শোবার বিছানার উপর দিয়ে আট লেনের হাইওয়ে হবে, যাত্রীদের যাতায়াত দ্রুতগামী হবে সেখানে সবার সম্মিলিত প্রয়াস না হলে কি করে হয়! হোক মানুষের মঙ্গল হোক। মানুষের মঙ্গলের জন্য এই দেহটাকে দান করেছি আর এতো সামান্য বাড়ি।

- Advertisement -

আমরা যারা প্রবাসে থাকি এমনকি যারা গ্রাম থেকে উঠে এসে ঢাকা রাজধানীতে মাথা গোঁজার জন্য একটু ঠাই করে নেই সেই বাসা ও বাড়িগুলো কেন যেন মফস্বলের বাড়ির মত স্থায়ী হয়ে ওঠে না, এইসব শহুরে বাসার সঙ্গে আমাদের আবেগ নেই, কোন স্মৃতি কাতরতা নেই, এখানে আমরা আলাদা আলাদা অচেনা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা যেন! সেখানে আমাদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীদেরকেই তো আমরা চিনি না। আজ এখানে তো কাল ওখানে ভাসমান নৌকার মত। অথচ গোবিন্দগন্জের বাপ দাদার এই বাড়িটিকে ঘিরে আমার অনেক আবেগ আছে, এই বাড়ি আমার দাদা বাপ কাকা এমনকি আমার সব ভাইদের আত্মপরিচয়ের ঠিকানা ছিল। এই বাড়ির নাম বললেই দশ বিশ চল্লিশ ক্রোশ দুরের লোকজন আমাদের চিনতো। ছোট বেলায় বালকসুলভ চপলতায় দুরে কোথাও হারিয়ে গেলে বলতাম নন্দী বাড়ির ছেলে আর লোকজন আদর করে ধরে তাদের সাইকেলে চেপে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে আমাদের বাড়ির সামনের মহাসড়কটি খুব সরু এক লেনের ছিল। পাকা সিমেন্টের পথ। সারাদিনে সব মিলিয়ে গোটা কয়েক বাস ট্রাক যাতায়াত করত, আমরা সীমানা প্রাচীরের আম গাছে বসে দুষ্টুমি করতাম, চলমান ট্রাকে ঢিল ছুঁড়তাম। অলস দুপুর অথবা রাতের সুনশান নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাত করে দুই একটি পরিবহণ ট্রাক ভেঁপু বাজিয়ে চলে যেত

রাত বেশি হলে তাদের গতি বাড়ত, আমাদের পুরোনো কাঠের দোতলা কেঁপে উঠত, খাট পালং দরজাতে মৃদু ঝাঁকুনি লাগত , এভাবেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। এই ঝাঁকুনির ভেতর একটা অন্যরকম আবেশ ছিল। বৃহস্পতিবার আর রবিবার সপ্তাহের এই দুই হাট বারে গোবিন্দগন্জ থানা সদর স্থল বন্দর হাঁটুরেদের আনাগোনায় সরব হয়ে উঠত। ধান পাট,সরিষা আনাজপাতি, শাড়ি লুঙ্গি, কেরোসিন তেল, মনোহরী দ্রব্যের বিকিকিনিতে একটা শব্দের ছন্দময় হামিং তৈরি হতো রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত। তারপর সব স্তিমিত হয়ে যেত, সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সব চলত ঢিলে ঢালা, অলস দুপুরে তাস খেলা, শিব মন্দিরে গাজায় টান দিয়ে ভক্তদের কীর্তন আর ভোরে মসজিদের আযানের সুমধুর নরম সুর । আহারে কি সুন্দর ছিল বাজারের উপর শিববাড়ি গলির আমাদের এই বাড়িটি! বাড়ির পুবদিকে মহাসড়ক আর পশ্চিমে বাজার। ঝড় বৃষ্টি তুফান উঠতো , হাটুরেরা এসে আমাদের মারোয়ারী বিশাল বাড়িটির বারান্দায় আশ্রয় নিত। তুফান এলে শাল কাঠের দরজার খিড়কি খুলে দিয়ে তাদের আশ্রয় দিয়ে খুব আনন্দ উপভোগ করতাম। হাঁটুরেদের অনেকেই আমাদের নানা বাড়ি সাতাইল বাতাইল এলাকার লোক, তাদের দাবি বেশি, হাটবারে তারা আমাদের বাড়িতে সাইকেল রেখে হাট বাজার করেন। যাত্রাগান এলে যাত্রা দেখতে আসেন। অনেকে অনুমতির তোয়াক্কা না করে হাইওয়ের অংশের গেট দিয়ে ঢুকে পশ্চিম দিকের বাজারে শর্টকাট মারেন। আহারে আমাদের এই স্মৃতির বাড়িটি মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনদিন ধরে লুটপাট হলো, কিন্ত আমার বাবা বাড়িতেই পড়ে রইলেন। বাড়ির ভেতর আম কাঠাল নারকেল গাছ , তারাও আমার ভাইদের সাথে সাথেই ভাই বোনের মত বড় হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের পর অনেকদিন স্থবির ছিল গোবিন্দগন্জ সহ দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। অভাব অনটন ছাড়া মানুষ নেই, ধুলোর পরত বাড়ির টিনের চালায়। খাবারের জন্য অনাহারি লোকজনের উৎকন্ঠিত মুখ, উপার্জনের সুযোগ কম, তখন আমার বাবার বিখ্যাত মনোহরি দোকানটি আশে পাশের দুই তিন থানার লোকজনের কাছে পরিচিত ছিল। ববনপুরের বিখ্যাত জোতদার আমার দাদা কালিপদ নন্দী’ তার ছেলে মেয়েদের সদরে পড়াশোনার জন্য তখনকার আমলে ১৯৪৯ সালে দ্বিগুণ দাম ১২ হাজার টাকা দিয়ে গোবিন্দগন্জের এই বাড়িটি কিনেছিলেন শ্রী হুনুমানজি নামের এক মারোয়ারির কাছে থেকে । বাড়িটি কেনার পর আমাদের গ্রামের জোত বাড়ি ববনপুর থেকে নিয়মিত ঘোড়ার পিঠে সাওয়ার হয়ে তিনি গন্জের এই বাড়িতে আসতেন। একদিন ঘোড়ার পিঠ থেকে সাহেব গন্জ পুলের নিচে পড়ে গিয়ে গুরুতর আহত হয়ে শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি মারা গেলেন আমাদেরএই সদরের বাড়িতেই । সেই বাড়ির উত্তরসূরী ছিলাম আমরা। জন্মের পর থেকে এই বাড়ির সেই কাঠের দোতলার কড়িকাঠ, খিলান, দরজা জানালা প্রতিটি অংশকে চিনেছি, পেয়ারা গাছ বেয়ে উঠে দোতলার দেয়ালে পেন্সিল দিয়ে কত কত ছবি এঁকেছি। উত্তপ্ত দোতলা থেকে হাটের সুন্দর দৃশ্য দেখেছি, ফেরিওয়ালার লেকচার শুনেছি মাইকে, হাটের মজমা দেখেছি……। সব আজ নিশ্চিন্ন হয়ে যাচ্ছে দুরুম দুরুম বিকট শব্দ করে । কালের বিবর্তন, সময়ের যবনিকাপাত এতটাই নিষ্ঠুর।

পঞ্চাশের দশকে আমাদের গোবিন্দগন্জে মোট বাড়ির সংখ্যা ছিল দশ পনেরটি। সব উড়িয়া মারোয়ারিদের গদিঘর। কাপড়ের দোকান, পাটের গুদাম আর বাড়ি নিয়ে মারোয়াড়ি বাড়ি। সেই পনেরটি বাড়ির ভেতর আমাদের বাড়িটিও ছিল। ১৯৪৭ দেশ বিভাগের পর মারোয়ারিরা ভারতে চলে গেলেন বাড়িঘর বেঁচে। তারপর ১৯৫২ গেল , ১৯৭১ গিয়ে হিন্দুদের ভেতর আশা জাগল মাতৃভূমি ছেড়ে কেন ভারত যাব? এজন্যই গোবিন্দগন্জের বাসিন্দাদের ভেতর হিন্দুদের সংখ্যা বাড়তে লাগল, টাঙ্গাইল, পাবনা থেকে সাহা, বনিকরা এসে গোবিন্দগন্জে ঠিকানা খুঁজে নিলেন।

নব্বইয়ের দশকে দেশের অর্থনীতিতে উন্নয়নের হাওয়া লাগলে আমার জন্মভভিটা গোবিন্দগন্জ বদলাতে লাগল। বাড়ি ভেঙ্গে মার্কেট হতে শুরু করল। আমাদের পুরোনো বাড়ির চিহ্ন আর রইল না। সব পাকা ইমারত। নীচে বড় মার্কেট উপরে আমাদের বাড়ি। তবুও দেশে গেলে ছাদের উপর গিয়ে আমার শৈশবের শিব বাড়ির পাকুড় গাছটার পাতা ধরে তাকে আদর করে দিতাম। তার সঙ্গেই বিড়বিড় করে কথা বলতাম। আমার শৈশব থেকে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা, কিশোর বেলার চপলতা, যৌবনের উদ্যমতা সব কিছুই দেখেছে এই পাকুর গাছ। মিউনিসিপ্যালের লোকজন তার ডাল পালা ছেটে ছোট করে দিলেও শীর্ণ দেহেও সে কালের সাক্ষী হিসেবে ছিল। শিব মন্দিরের জটা বিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বট গাছটাও তাই। আমরা গন্জ থেকে শহুরে হলাম, বদলে গেল ভুপ্রকৃতি, নিসর্গ, চারিদিকে ঘিঞ্জি বাড়ি ঘর দোকান পাট! তবুও আমাদের ঠিকানার সেই বাড়িটি স্মৃতির বাড়ি হয়েই থাকল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় গভীর রাতে নাইট কোচ থেকে নেমে রাস্তার পাশেই গেটের উপর দিয়ে পাড় হতাম। বাড়ির কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এসেই থেমে গিয়ে আনন্দে লেজ নাড়ত, মা রাত জেগে বসে থাকতেন আমার অপেক্ষাতেই। ঢাকার নাইট কোচের অনেক ড্রাইভার চিনতেন বিশ্ব রোড হাইওয়ে সংলগ্ন আমাদের বাড়িটি । ঢুলু ঢুলু ঘুম নিয়ে ড্রাইভারের হাঁক ডাকে উঠে দাঁড়াতাম। আহা সুইট হোম , আমার নাড়ি পোতা পবিত্র জন্মভিটা গোবিন্দগন্জ!

এখন থেকে কালের গর্ভে সব মিলিয়ে যাবে। থাকবে না স্মৃতি জাগানিয়া কোন অনুষঙ্গ, কোনদিন আমার উত্তরসূরী কেউ কোন গাড়িতে চেপে এই রাস্তা ধরে এগিয়ে যাবার সময় তারা জানবেও না তাদের পূর্ব পুরুষদের বুকের উপর দিয়েই তারা অতিক্রম করছে দীর্ঘপথ।

- Advertisement -

Read More

Recent