বৃহস্পতিবার - মে ৯ - ২০২৪

বিপর্যস্ত অনুভব : তিন

ছবিক্রিস লেটন আনসপ্লাশ

ইসরাত, শিবু, সাদেকীনের সাথে বর্ডার পাড়ি দিয়ে ভারতের ক্যাম্পে এসেছে কুলসুম বিবি প্রায় এক মাস। এখানে ডাক্তার ওকে চিকিৎসা করেছে বেশ কিছু দিন। ওর শরীর আগের চেয়ে কিছু ভালো। মানুষের এমন কষ্ট, সুন্দর তরতাজা পোলাপানগুলা যুদ্ধ করতে যায় কেউ আর ফিরে আসে না। কেউ আসে আহত অবস্থায়। কুলসুম বিবি চোখের পানি রাখতে পারে না। ও আর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে না। আহত মুক্তিযোদ্ধার জন্য ছেড়ে দেয় ওর বিছানা। সেবা শুশ্রুষায় লেগে যায় ওদের। ভাত রান্না করে। মুখে তুলে খাওয়ায় পোলাপানদের। ওর বড়ো মায়ার শরীর। ফুলির কথা মনে হয়, বড় কষ্ট হয় কলিজার মাঝে চিপ দিয়া উঠে। কেমন আছে মেয়েটা। বেঁচে আছে না মরে গেছে কে জানে। এমন ছারখার হয়ে গেল সব কিছু। সাজান বাড়িঘর হাসি-তামাসা। সব ছাইড়া মানুষ এখন খালি যুদ্ধ করে। মানুষে মানুষ মারে। কুলসুম বিবির ইচ্ছা করে ঐ হারামীর বাচ্চাদের মারতে। কমান্ডার সাবরে কয়, স্যার, আমারে যুদ্ধ করনের লাইগা একটা বন্দুক দেন। বন্দুক চালান শিখাইয়া দেন। আপনার দুইটা পায় ধরি স্যার, আমারে যুদ্ধে যাইতে দেন। আমি পাকিস্তানি ইবলিশদের মারতে চাই। যারা আমার সোয়ামী, বাচ্চা, ঘর-দুয়ার সর্বনাশ করছে আমি হেগরে নাশ করমু। আগুনের ভাটার মতন জ্বলে কুলসুম বিবির চোখ। বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করা ছাড়া আরো নানা রকম যুদ্ধ করা যায়, তুমি সেটা করো কুলসুম। দেশের ভিতর যাবে শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনীর লোকদের সাথে মিশবে, কথা বলবে। ওদের ভিতরের খবর নিয়া আসবে আমাদের জন্য, পারবে ? খুব পারমু স্যার, আমার সব গেছে কিছু হারানোর ভয় নাই আর আমি যাবো। আমারে খালি বলেন কোথায় যেতে হবে। অসম্ভব বলে বলিয়ান কুলসুম বিবি মৃত্যু ভয়ের পরোয়া করে না আর।
সবজির ঝুড়ি মাথায় নিয়ে মিলিটারির ঘাঁটির ভিতর ঢুকে যায়। রাজাকারদের বিনা পয়সায় সবজি দিয়ে ওদের সাথে খোশগল্প করতে করতে শুনে নেয় ওদের গোপন অভিসন্ধি। কুলসুম বিবির মতন সবজিওয়ালীকে ওরা পাত্তা না দিয়ে বলে ফেলে ওদের অনেক গোপন পরিকল্পনা ওর সামনে। বুক ধুকপুক করে, হাত নিশপিশ করতে থাকে ওর। সবজির ঝুড়ির ভিতর লুকানো ছুরি দিয়ে কেটে ফেলতে ইচ্ছা করে ওর এক একটা মাথা হারামীর বাচ্চাগুলার। সব শোনা হয়ে গেলে কিছুই শুনেনি কিছুই জানে না, বুঝে না এমন ভাব করে আড়মোড়া ভেঙে উঠে হাঁটা দেয়। ওদের চোখের আড়ালে এসেই দৌড়ায় খবর পৌঁছে দেয়ার জন্য যত দ্রুত পারে। এমনি খবর পৌঁছে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সহযোগিতা করে কুলসুম বিবি। যখন দেখে ওর খবর পেয়ে মিলিটারিদের নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে মুক্তিযোদ্ধারা তখন কুলসুম বিবির বড় খুশী লাগে। আনন্দে শুকুরানা নামাজ পড়ে। মাস পাঁচেক এমন গুপ্তচরের কাজ করে সাহায্য করে কুলসুম বিবি মুক্তিবাহিনীকে। এরপর একদিন আবার ওকে ক্যাম্পে আটকে ফেলে মিলিটারিরা। রাতব্যাপী ওদের যৌন ক্ষুদার সুখ মেটায় কুলসুম বিবির শরীরের উপর। নিস্তেজ মৃতপ্রায় কুলসুম বিবিকে উদ্ধার করে দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযোদ্ধোরা হাত বাঁধা ঝুলন্ত অবস্থায় এক ক্যাম্প থেকে।
কত বছর পার হয়ে গেছে যুদ্ধ শেষের। দেশ স্বাধীন হওয়ার। যে ছেলেরা প্রাণের মায়া না করে যুদ্ধ করেছে দেশের স্বাধীনতার জন্য তারা আজ কে কোথায় কেমন আছে ?
দেশ স্বাধীন হওয়ার আট মাস পরে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় কুলসুম বিবি হাসপাতালে। আদর করে নাম রাখে জয়, জয় বাংলার জয়। কিন্তু এই ছেলেরে নিয়ে কোথায় যাবে, চোখের জলে ভাসতে ভাসতে, বিদেশের এক মহিলার হাতে তুলে দেয় কুলসুম বিবি পেটের সন্তান জয়কে। ফিরে আসে নিজের ভিটায়। কিন্তু এক বছরের মাঝে সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। কুলসুম বিবির বাড়িঘর রাজাকারের দখলে। তারা নাকি মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ঘরের মাঝে বাঁধাই করে রেখেছে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট। সব হারানো কুলসুম বিবিরে খেদায়ে দিছে নিজের ভিটামাটি থেকে। পথে পথে ঘুরে ভিক্ষা করে দিন পার করে কুলসুম বিবি।
ছেলেটার সখ খবর সংগ্রহ করা। ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে একটা ভালো চাকরি পেয়েছে, চাকরি করে কিন্তু ছুটিছাটা বা সপ্তাহান্তের দিনগুলো ঢাকার বাইরে বেরিয়ে পড়ে। ঘুরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আর ছবি তুলে। মাঝে মধ্যে জার্নাল, ম্যাগাজিন বা পত্রিকায় দেয় ছাপতে। খুঁজে পাওয়া কোনো চমকপ্রদ লেখা বা অসাধারণ ছবি। পথে মাঠে ঘুরে বেড়ায় খবরের খোঁজে। এছাড়া যে কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও নতুন মানুষের সাথে কথা বলে। নতুন বিষয়ে জানতে ওর ভালো লাগে। যাকে তাকে জিজ্ঞেস করে নানান কথা, কার মাঝে যে কি ছাইচাপা হীরে লুকিয়ে আছে না মিশলে, না কথা বললে তা জানা যাবে না।
এমনি একদিন এক গ্রামের পথে ঘুরে বেড়ানো মহিলার সাথে গল্প করতে করতে পেয়ে যায় অতি সাধারণ কুলসুম বিবির বুকের গহীনে লুকানো গোপন হীরার খনির খবর। চোখ ভরে যায় জলে, লজ্জায় নত হয় মাথা। এমন অবিচার কেন মানুষের ওপর। যাদের মাথায় তুলে রাখার কথা। এই দেশের মানুষ তাদের কোনো খোঁজও নেয় না। অনেকে জানেও না কত রক্তের বিনিময়ে, কত ইজ্জতের বিনিময়ে এই দেশ তারা পেয়েছে।
এ এক অদ্ভুত দেশে যে সব মানুষের সব হারানোর বিনিময়ে আজ এই স্বাধীন বাংলাদেশ সেসব মানুষের কোনো মর্যাদা নাই এই দেশে।
মাগো, আমার কোনো ক্ষমতা নাই তোমার জন্য কিছু করার, পারলে সোনায় মুড়ে দিতাম তোমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। তবে আমি যা করতে পারি তোমার কথা ছাপাতে পারি পত্রিকায়। জানাতে পারি দেশের মানুষেরে একজন মুক্তিযোদ্ধা নারীর অসাধারণ কাহিনী, যদি তুমি আমাকে অনুমতি দাও।

বহু কাল বাদে যেন এক মুক্তিযোদ্ধা দেখে কুলসুম বিবি। সেই আবেগে থরথর মন। সব ভুলে হাতে হাত ছেলেগুলো গুলি, বোমা. গ্রেনেডের সামনে ছুটে যেত জীবন বাজি রেখে। ঢেলে দিত বুকের রক্ত মাটির বুকে। হিন্দু, মুসলিম, ধনী, গরিব, শিক্ষিত, মূর্খের কোনো পার্থক্য ছিল না। একটাই স্বপ্ন একটাই আশা ছিল বুকে, দেশ স্বাধীন করতে হবে।
কতো বয়স এই ছেলেটার? যে যুদ্ধ দেখেনি অথচ জানে যুদ্ধের ভয়াবহতা। যার মনটা আবেগে ভালোবাসায় ভরপুর। এত বছর পর এই ছেলেটা ওর সাহসের কথা জানাতে চায় দেশের মানুষদের। কুলসুম বিবি বলে ঠিক আছে বাবা লেখ তোমার পত্রিকায় যদি তুমি ভালো মনে করো। যে আশা নিয়ে ছেলেরা যুদ্ধ করেছিল তাদের সব আশা পূরণ হয়নি। তবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। একটা দেশ আমরা পেয়েছি এইটাই বড় কথা।
তোমার জন্য আমি মন ভরে দোয়া করি, তোমার মতন মানুষ হোক বাংলাদেশের সব ঘরে।

- Advertisement -

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent