ভাষার হেতু কেহ প্রান বিসর্জন দিতে পারে তাহা ইহার ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত না হইলে কেহ বিশ্বাস করিবে না। রক্তে রঞ্জিত হইয়া আমাদিগের প্রানের ভাষার অধিকার সেই দিন রক্ষিত হইয়াছিল।
সালাম,রফিক,বরকত সেই সংগ্রামের অকুতোভয় সৈনিক। তাহারা আত্নত্যাগ না করিলে উর্দু হইতো আমাদিগের রাষ্ট্রভাষা। এই মাতৃত্বহীন বিজাতীয় ভাষায় আমাদিগকে কথা বলিতে হইতো। অফিস,আদালত সবখানেই পূর্ব পাকিস্তানের বাংগালী জনগোষ্ঠিকে এক অকল্পনীয় বৈরিতার মুখোমুখি হইতে হইতো। উর্দু উত্তমরূপে না জানিবার হেতু চাকুরির ক্ষেত্রে নানাবিধ অসুবিধার সম্মূখীন হইতে হইতো। আমাদিগকে বড়জোর কেরানীর পদ লইয়া সন্তুষ্ট থাকিতে হইতো। কে না জানে উচ্চপদের জন্য ভাষার উপর নিপুনজ্ঞান থাকা অপরিহার্য। বাংগালী জনগষ্ঠির উর্দুর উপর পারদর্শীতা ছিল না বলিলেই চলে।তাই তাহারা এই বিজাতীয় ভাষা লইয়া যে চরম বিপাকে পতিত হইতো তাহা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়। জ্ঞানী ব্যক্তি যে কেহ এহেন অনুমান করিতে সক্ষম হইবেন বলিয়া আমার ধারনা। আমরা মাতৃগর্ভ হইতে ধরনীতে আসিবার পর যে ভাষা কর্নকুহরে গুঞ্জরিত হইয়াছিল তাহা আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা। মা যে ভাষায় কথা বলিতেন,যে ভাষায় ভাবিতেন,যে ভাষায় লেখিতেন,যে ভাষায় কর্ম সম্পাদন করিতেন আমরা শিশুকাল হইতে বড় হওয়া অব্দি সেই ভাষাই রপ্ত করিয়াছি। তাই মায়ের ভাষার প্রতি আমাদিগের নাড়ির সম্পর্ক আজন্মকাল হইতে বহিয়া চলিয়াছে। বাংলা আমাদিগের অস্তিত্বের সহিত,আবেগের সহিত,অনুভূতির সহিত মিশিয়া একাকার হইয়া গিয়াছে। তাই ইহাকে বাদ দেওয়ার অর্থ হইতেছে দেহ হইতে প্রানস্পন্দনকে কাড়িয়া লওয়া। মুখ হইতে প্রবাহিত নিঃশ্বাসকে স্তব্ধ করিয়া দেওয়া।
প্রশ্ন হইতেছে, প্রানস্পন্দন ব্যতীত দেহ কি বাচিতে পারে? নিঃশ্বাস ছাড়া কি হৃদয়স্পন্দন চলিতে পারে? ইহার উত্তর যদি “না” হয় তাহা হইলে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সেই দিনের রক্তরঞ্জিত রাজপথের ইতিহাস বৃথা যায় নাই।
আজি মাতৃভাষায় কথা বলিতেছি মনে হইতেছে প্রান ভরিয়া নিঃশ্বাস লইতেছি। আজি মাতৃভাষায় কথা বলিতেছি মনে হইতেছে হৃদয় তন্ত্রীতে স্পন্দন জাগিয়া রহিয়াছে।
আমার এই আবেগের স্থানটি সকল বাংলা ভাষাভাষীদের মনে একই রূপে মূর্ছিত হয়।
আজ বিশ্বব্যাপী জানিতে পারিয়াছে পৃথিবীর বুকে এমন এক মানবজাতি রহিয়াছে যাহারা নিজদিগের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রান দিয়াছিল। আমাদিগের সেই বিরত্বের ইতিহাস আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাইয়াছে। আজ সেই মহান দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারী। আজ মনে পড়িতেছে, বহু দিন পূর্বে নগ্ন পদব্রজে ভাবগাম্ভীর্যের সহিত প্রভাত ফেরিতে যোগ দিয়াছিলাম। তখন ছিল না যান্ত্রিক সভ্যতার অবদান, মোবাইলের ক্লিক ক্লিক ধ্বনি। ছিল না শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার ঘনঘটা। তখন ছিল হৃদয়ের গভীর হইতে উৎসরিত বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। নত শিরে ভাষা শহীদদের প্রতি শোকাভিভূত প্রানের আকুতি।
বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তোমাদের কারনেই আজ বাংলা ভাষায় লেখিতে পারিতেছি।
এই যে আমার এই নাতীদীর্ঘ লেখাটি তাহাও এই ভাষা দিবসের কারনেই।
স্কারবোরো, অন্টারিও, টরন্টো