শনিবার - মে ১৮ - ২০২৪

গঙ্গা জল কাঁদে ফারাক্কা বাঁধে

ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ছিলেন খুশবন্ত সিং। জাঁদরেল সাংবাদিক। প্রশংসা করা জানতেন না। সব সময় কেবল সমালোচনা করতেন। দিল্লিতে রুনা লায়লার কনসার্টে গেলেন। পুরো কনসার্ট দেখলেন। চরিত্রের কাঠিন্য বজায় রেখে শিল্পীর প্রশংসা দূরে থাক, সাধারণ মন্তব্যও করেননি। দেখা করেননি কিংবা সাক্ষাৎকারও নেননি। কিন্তু পরদিন তাঁর পত্রিকার এক আর্টিকেলে রুনা লায়লাকে নিয়ে বোমা ফাটালেন। রুনার গানে দিওয়ানা হয়ে বিষ্ফোরক মন্তব্য করলেন ফারাক্কা নিয়ে। ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের সবচে’ স্পর্শকাতর বিষয় তখন ফারাক্কা। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে সুষম জল বন্টনের। ভারত রাজী নয়। সেই পরিস্থতিতে খুশবন্ত সিং আর্টিকেল শেষ করেন এক আবেগী সংলাপ দিয়ে। “আমি শুধু একটা কথাই বলব বাংলাদেশ সরকারকে, প্লিজ গিভ আস রুনা লায়লা, অ্যান্ড টেক অল দ্য ওয়াটার অব ফারাক্কা।”
আর্টিকেলটি নিছক অরাজনৈতিক হলেও খুশবন্ত সিং জানতেন গঙ্গার পানির অধিকার বাংলাদেশের। গাঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে প্রকৃতি প্রদর্শিত পথে গঙ্গার যাত্রা বঙ্গোপসাগরের দিকে। সাগরে ঝাঁপ দেবার আগে রূপবতী গঙ্গা আরো বেশি রূপসী নাম ধারণ করে। দ্যি গ্রেট পদ্মা নদী। অবিভক্ত বাংলার প্রাণের নদী। খুশবন্ত সিং নদীর গতিপথ ভালোই বুঝতেন। মানবসৃষ্ট বাঁধ দিয়ে জলের অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। রুনা লায়লার হিন্দী উর্দু পাঞ্জাবী গানে মুগ্ধ হয়ে সত্যি কথাটা বের করে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন, রুনার বিনিময়ে ফারাক্কার সব জল নিয়ে যাক বাংলাদেশ। আদতে তিনি জানতেন, প্রকৃতির নিয়ম মানলে সব জলতো বাংলাদেশেরই প্রাপ্য!
ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা। তাই যদি হয়, তবে মায়ের হৃদয়ে বিভাজন কেনো? সুনীল গঙ্গেপাধ্যায় তাঁর নদী বিষয়ক এক গল্পসংকলনে বলেছিলেন, অপ্রয়োজনীয় ফারাক্কার কারণে দুই দেশের বাঙালীর সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরী হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এটি কোনো বাংলারই উপকারে আসে না। অথচ চিরস্থায়ী প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জুলাই ১০, ২০১৯ নয়া দিল্লীর দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার সংবাদ। মমতা ওয়েন্ট হ্যামার এন্ড টং এ্যাট ডিভিসি এন্ড ফারাক্কা অথরিটিজ। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী রেগে আগুন হলেন ডিভিসি এবং ফারাক্কা কর্তৃপক্ষের উপর। মালদা জেলার হরিশচন্দ্রপুরের বিধায়ক মুশতাক আলমের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দামোদর ভ্যালী কর্পোরেশন এবং ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের উপর ক্ষেপে যান তিনি। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য মুশতাক আলম তাঁর নির্বাচনী এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রনে মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ২০১৭ সালেও মালদা গিয়ে তিনি বন্যা দেখেছেন। ফি বছর পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু এলাকা বানের জলে ভাসে ফারাক্কার কারণে।
ভারতের বৃহৎ সংবাদ সংস্থা পিটিআই বা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার বরাতে বিজনেস স্টান্ডার্ড পত্রিকা ভয়ঙ্কর শিরোনাম দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। অক্টোবর ১,২০১৯ সংখ্যার পানিসম্পদ বিষয়ক সংবাদে শিরোনাম ছিলো ফারাক্কা ব্যারেজ মাস্ট বি ডিজম্যান্টলড ইন দ্য ইন্টারেস্ট অব বিহার। অর্থাৎ বিহারের স্বার্থে ফারাক্কা গুঁড়িয়ে ফেলা উচিত। ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশের পর সবচে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের বিহার রাজ্য। বিহারে প্রতিবছর বন্যার কারণ এই ফারাক্কা। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীরা বরাবরই সরব ফারাক্কার বিরুদ্ধে। পানিসম্পদ মন্ত্রী সঞ্জয় ঝা এবার সরাসরি ভেঙে ফেলার কথা বললেন। ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের গলার কাঁটা এই ফারাক্কা।

- Advertisement -

দুই দেশের লক্ষকোটি মানুষের গলার কাঁটাই যদি হয় তাহলে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের যৌক্তিকতা কি ছিলো? গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণের সর্বনাশা বুদ্ধিটা এলো কার মাথা থেকে? মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। কিন্তু সস্তা এক উত্তর। কোলকাতা বন্দর বাঁচাতে নির্মিত হয়েছিলো মাল্টিমিলিয়ন ডলারের ব্যারেজ। কিন্তু বন্দর কি আদৌ বাঁচানো গেছে?
ইতিহাসটা অনেক লম্বা। বান্দুংঃ জার্নাল অব গ্লোবাল সাউথ নামক এক গবেষণাপত্রে বিস্তারিত লিখেছিলেন মোহাম্মদ আবুল কায়সার এবং মোঃ আব্দুস সামাদ। অনলাইনে সেটি বিনামূল্যে পাঠযোগ্য হয় জানুয়ারী ৪, ২০১৬ সালে। সেখান থেকে কেবল শ্রীচন্দ্র নন্দীর গল্পটা বলি।
গল্পের পেছনের গল্পটাও জানা দরকার ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য। শুরুটা উনবিংশ শতকের শুরুতে। দেশভাগ হয়নি তখনো। ব্রিটিশরা কোলকাতা বন্দর রক্ষায় গঙ্গার পূর্বমূখী জলের প্রবাহ দক্ষিনে ঘুরিয়ে আনার চিন্তা করে। তবে কার্যকর বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ নেয়নি। এসময় পূর্ববাংলার কৃতি সন্তান মেঘনাদ সাহা এ ব্যাপারে গবেষণা শুরু করেন। বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা জন্মেছিলেন বর্তমান গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলায়। ঔপনিবেশিক আমলের শেষদিকে অবিভক্ত বাংলার তৎকালীন গভর্ণর কোলকাতার পার্শ্ববর্তী এলাকায় নদী শাসন এবং সুষম জলবন্টনের জন্য একটি অনুসন্ধানী কমিটি গঠন করে। বর্ধমানের মহারাজা এবং ড. মেঘনাদ সাহা ছিলেন এ কমিটির সদস্য।
যুক্তরাষ্ট্র তখন হুভার ড্যামসহ বড় বড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। টেনেসি ভ্যালী অথরিটি (টিভিএ) নামের একটি সংস্থা চালু করেছেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। এ সংস্থা টেনেসি, আলাবামা, মিসিসিপি, কেন্টাকি, জর্জিয়া, নর্থ কারোলাইনা এবং ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের নৌপথ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলবিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনসহ আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন গবেষণা, পরিচালনা এবং বাস্তবায়নের কাজ করে। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা তাঁদের পরিকল্পনায় অনুপ্রাণিত হন।
১৯৪৪ সালে মেঘনাদ সাহা এবং বর্ধমানের মহারাজা যুক্তরাষ্ট্রের টিভিএ’র আদলে ডিভিএ বা ডিভিসি অর্থাৎ দামোদর ভ্যালী অথরিটি বা কর্পোরেশন গঠনের প্রস্তাব করেন। তাঁদের প্রস্তাবনা বোর্ডের মাধ্যমে গভর্ণরের কাছে পেশ করা হয়। এ প্রস্তাবনায় মুর্শিদাবাদে গঙ্গা ও ভাগিরথীর জল সমন্বয়ের কথা থাকলেও গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা বলা হয়নি।
বছর তিনেক পর অর্থাৎ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। বেঙ্গল নামের রাজ্যটি পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ নামে বিভক্ত হয়ে যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের প্রাদেশিক মর্যাদা পায়। পশ্চিমবঙ্গের যেসকল জমিদারদের পূর্ববঙ্গে জমিদারী ছিলো, তাঁদের জমিদারী বেহাত হয়ে যায়। অথচ জমিদারদের খাজনা আয়ের সিংহভাগ ছিলো পূর্ববঙ্গ থেকে। পদ্মা মেঘনা যমুনার অববাহিকায় পূর্ববঙ্গের জমি ছিলো অধিক উর্বর। পশ্চিমবঙ্গের অনেক অঞ্চল পুরোপুরি ঊষর। সুতরাং ফসলের মূল আয় পূর্ববঙ্গ কেন্দ্রিক। কিন্তু জমিদারদের অবস্থান নগরকেন্দ্রিক হওয়ায় বেশির ভাগ জমিদারের অবস্থান তখন কোলকাতায়।
এমনি এক মহারাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দী। মুর্শিদাবাদ কাশিমবাজার রাজের শেষ মহারাজা তিনি। প্রখ্যাত লেখক এবং তৎকালীন বাংলার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। ১৯৩৬ সালে বাংলার নির্বাচনে নির্দলীয় প্রার্থী হিসাবে জয়লাভ করেন। পরে অবশ্য কংগ্রেস করেছেন। ১৯৪৮ সালে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে তিনি একটি নিবন্ধ লেখেন। যার সারমর্ম দাঁড়ায় এরকম যে দেশ বিভাগের কারনে ওপার বাংলা সব ফসলের ভাগীদার হচ্ছে। বিপদজনকভাবে পশ্চিম বাংলায় কোনো ফসল উৎপাদন নাই। সকল প্রকার ধানের আবাদ পূর্ববঙ্গে। দেশভাগের কারণে পশ্চিম বাংলার ট্র্যাজেডি হলো খাবার কম কিন্তু খাওয়ার মুখ বেশী। নদী প্রবাহে সকল পলি জমা হয় ওপার বাংলায়। এখানকার জমি উর্বর হয়না। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষের জীবন প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি। এখানকার নদীগুলো রক্ষার প্রয়োজন। তাছাড়া কোলকাতা বন্দর রক্ষা অত্যন্ত জরুরী।
মহারাজা শ্রীশচন্দ্রের নিবন্ধের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিলো গঙ্গার পানি আটকে দেয়া। গঙ্গার উপর ব্যারেজ দিয়ে জল প্রত্যাহার করা। এতে ফিডার ক্যানেল দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জমিগুলোয় সেচ সুবিধা দেয়া যাবে। পশ্চিমবঙ্গ সুজলা সুফলা হবে, যেমনটি পূর্ববাংলায় হয়েছে। তবে ভারতের সরকারী দপ্তরের দলিল দস্তাবেজে কোথাও ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের কারণ হিসাবে পশ্চিম বাংলার কৃষির কথা বলা হয়নি। বরং এক এবং একমাত্র কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে কোলকাতা বন্দর রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালন।
ভারত সরকারের দলিল দস্তাবেজ অনুযায়ী কোলকাতা বন্দরের সেডিমেন্টেশন দূর করতে ৬৪ হাজার কিউসেক পানি দরকার। ৬৪ হাজার কিউসেক মানে হলো প্রতি সেকেন্ডে ৬৪০০ হাজার ঘনফুট পানি। অর্থাৎ এক সেকেন্ডে একই পয়েন্টে জল আসবে ১৮ লাখ ১২ হাজার ২৭৮ লিটার। হুগলি নদীর মুখে এই পরিমান জলের প্রবাহ থাকলে বন্দরে জমাটকৃত সেডিমেন্ট ফ্লাশ আউট করা যাবে। প্রকৌশলীদের প্রাথমিক হিসেবটা এরকমই ছিলো। তাই ৩৮ কিলোমিটার লম্বা ফিডার ক্যানেল তৈরী করে গঙ্গার জল ফারাক্কা পয়েন্ট থেকে সরিয়ে নেয়া হলো ভাগীরথী-হুগলি রিভার সিস্টেমে। বন্দর রক্ষা ছাড়াও আরেকটি বড় সুবিধা হলো। নদীর পানির চাপ ও প্রবাহ বঙ্গোপসাগরের দিকে বেড়ে যাওয়ায় কোলকাতা এবং এর আশেপাশের এলাকার জল ও ভূমি লবনাক্ততা থেকে রক্ষা পেলো।
সরকারী নথিতে আরো তিনটি বিষয়ের উল্লেখ থাকলেও মহারাজা শ্রীশচন্দ্রের কৃষি উন্নয়নের কথা নাই। সরকারী বয়ানে ফারাক্কা বাঁধের উপর নির্মিত সড়ক ও রেল লাইন যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিরাট পরিবর্তন এনেছে। কোলকাতার সাথে উত্তরবঙ্গের (পশ্চিম বাংলার উত্তরবঙ্গ) যোগাযোগ সহজ করেছে। ভাগীরথী-হুগলী রিভার সিস্টেম হলদিয়া বন্দর থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত ভারতের অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল উম্মুক্ত করেছে। এটি ভারতের ন্যাশনাল ওয়াটারওয়ে-১। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে ফারাক্কা। ২১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালনা করা হয় ফিডার ক্যানেলে সরবরাহ করা জলের বিপুল প্রবাহ থেকে।
কোলকাতা বন্দর রক্ষা, উত্তরবঙ্গ ও দার্জিলিংএর সাথে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সুবিধা মাথায় রেখে ভারত ১৯৫০-৫১ সালে বাঁধ নির্মাণের সক্রিয় পরিকল্পনা শুরু করে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র তখন জন্ম নেয়নি। এটি তখন পাকিস্তানের অংশ। ভারতের পরিকল্পনায় পাকিস্তান উদ্বেগ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান পানিসম্পদ প্রকৌশলী বি এম আব্বাস এটি তাঁর দ্য গ্যাঞ্জেস ওয়াটার ডিসপিউট গ্রন্থে লিখেছেন, প্রাথমিক অবস্থায় পাকিস্তানের উদ্বেগ প্রকাশকে ভারত পাত্তা দেয়নি। ভারত জবাব দেয়, গঙ্গা ব্যারেজের কেবলমাত্র সমীক্ষা করা হচ্ছে। ব্যারেজ নির্মাণ পরবর্তী পারিবেশিক প্রতিক্রিয়া বা ফলাফল এখনো গবেষণা করে দেখা হয়নি। পাকিস্তান সরকারও গবেষণা করেনি। সুতরাং এ ব্যাপারে উদ্বেগ একটি কাল্পনিক ব্যাপার। এর কোনো ভিত্তি নেই।
ভারত প্রাথমিক সমীক্ষার কথা বললেও গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা একদিনও থামিয়ে রাখেনি। এ পর্যায়ে পাকিস্তান অনুরোধ জানায় ভারতকে যাতে বাঁধ বিষয়ক স্কিম হাতে নেয়ার আগে পাকিস্তানের সাথে পরামর্শ করে। ১৯৫৩ সালে ভারত প্রস্তাব দেয় দুদেশ যৌথভাবে গঙ্গার জল সম্পদ উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এরই প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্প (জি-কে প্রজেক্ট) নামে একটি আউটলাইন ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। ভারত সরকার পাকিস্তানের দেয়া আউটলাইন গ্রহণ করেনি। পাকিস্তান ভারতের অসংখ্য কূটনৈতিক বৈঠকের ভেতরেই ভারত গঙ্গা বাঁধের ডিজাইন, ড্রইং এবং ঠিকাদার নিয়োগের কাজ শেষ করে ফেলে। আলোচনা কখনো গতি লাভ করতে পারেনি পাকিস্তান সরকারের অন্যান্য ইস্যুর কারণে। বিশেষ করে ভারত পাকিস্তান কূটনীতির মূল আলোচ্য তখন কাশ্মীর। গঙ্গা ব্যারেজ মূলত পাকিস্তানী বাঙালিদের সমস্যা হওয়ায় এটি পররাষ্ট্র নীতিতে কম গুরুত্ত্ব পেয়েছে।
১৯৮০ সালে এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত, গবেষক বি. ক্রো তাঁর “পলিটিক্স এন্ড স্ট্যাগনেশন ইন দ্য রিভার অব সাউথ এশিয়া: হোয়াই আর গ্যাঞ্জেস এন্ড ব্রহ্মপুত্র আন্ডারডেভেলপড?” গ্রন্থে উল্লেখ করেন, পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যা আলোচনায় এতো ব্যস্ত ছিলো যে গঙ্গা বাঁধ নির্মাণের ড্রইং ডিজাইন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের সময় পায়নি। ভারত সহজেই সে সুযোগটি নিয়েছে। অথচ পাকিস্তান সিন্ধু বেসিন চুক্তিতে অসম্ভব সরব ছিলো। কাশ্মীর নিয়ে আলোচনায় দীর্ঘসূত্রতা, যুদ্ধ, সিন্ধুর জলবণ্টন, সীমান্ত ইস্যু, মোহাজের পুনর্বাসন ইত্যাদি আলোচনার ফাঁকে ফারাক্কা পয়েন্টে বাঁধ নির্মাণ যেনো পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের চোখে পড়েনি।
খেলায় ওয়াকওভার পাবার মতো ভারত একতরফা এগিয়ে গেলো বাঁধ নির্মাণে। ১৯৬১ সালে বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। ভারতের বিখ্যাত হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি নির্মাণ কাজের ঠিকাদারি পায়। জলের ঢল আটকে রাখা এবং খুলে দেবার জন্য ১১২টি গেট বানানো হয়। ১০৮টি গেট নদীর উপর মূল বাঁধে। বাকি ৪টি ফিশ লক গেট। এছাড়া ১১টি হেড রেগুলেটরি গেট রয়েছে প্রত্যাহৃত জল ফিডার ক্যানেলে পাঠাবার জন্য। ১১ গেট দিয়ে আনুমানিক ৪০ হাজার কিউসেক পানি ফিডার ক্যানেলে সরবরাহ করা হয়। ফারাক্কা ব্যারেজের দৈর্ঘ্য সোয়া দুই কিলোমিটারের উপরে। গাণিতিক মাপে ২,৩০৪ মিটার। উচ্চতা প্রায় ২৩ মিটার বা ৭৫ ফুট। ১৯৭০ সালে তৎকালীন ২০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ শেষ হয়।
বেশ নির্বিঘ্নেই শেষ হয় বাঁধ নির্মাণ কাজ। আন্তর্জাতিক কোনো চাপ কিংবা প্রতিবেশী পাকিস্তানের সাথে যুধ্বংদেহী ভাব সত্ত্বেও বাঁধ নির্মাণে সমস্যা হয়নি ভারতের। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অরক্ষিত সত্ত্বেও এ অঞ্চলে কেউ হামলা করেনি। বাঁধের নির্মাণ কাজ চলেছে বীরদর্পে। যুদ্ধ শেষ হলে আবার বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনায় বসে ভারত পাকিস্তান। ১৯৬৯ সালে সচিব পর্যায়ে পাকিস্তান প্যাকেজ ডিলের প্রস্তাব দেয় ভারতকে। বাঁধ নির্মাণ শেষ হবার পথে। ভারতের হাতে তখন স্টিয়ারিং হুইল। আসল কাজ তাঁরা করে ফেলেছে। সুতরাং পাকিস্তানের প্রস্তাব গ্রহণ করা বা না করার ক্ষমতা পুরোটাই ভারতের হাতে। পাকিস্তানের প্যাকেজ ডিল ছিলো একটি নির্ধারিত পরিমান পানি পাবার নিশ্চয়তা। সেই সাথে একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি যা দিয়ে ডিল বাস্তবায়ন এবং জলবণ্টন পর্যবেক্ষণ করা যায়। লক্ষণীয় যে প্রস্তাবটি তখন বাঁধ নির্মাণ সম্পূর্ণভাবে মেনে নিয়েই করা হয়েছিলো। অর্থাৎ এর আন্তর্জাতিক বৈধতা বা স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছিলো।
নির্মাণ শেষ হলেও বাঁধের টেস্টিং কমিশনিং থেমে থাকে। একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ভারত পূর্ণ সমর্থন নিয়ে পাশে দাঁড়ায়। অনেক বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন যুদ্ধের আবহে পাকিস্তান শত্রু দেশ হিসাবে ফারাক্কায় হামলা করতে পারতো। করেনি। কেনোনা তাদের ধারণা ছিলো ফারাক্কা গুঁড়িয়ে দিলে ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আর কোনো ভারত বিরোধী ইস্যু থাকবেনা। বন্ধুত্বের শেকড় তখন আরো গভীরে প্রোথিত হবে। সুতরাং এটা অক্ষত রাখাই রাজনৈতিকভাবে মঙ্গলজনক।
পরের ঘটনা প্রবাহ প্রায় সবার জানা। স্বাধীনতা পরবর্ত্তীকালে ফারাক্কা নিয়ে টানাপোড়েন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সত্যিই তিক্ত করে। পানি ভাগাভাগির বেশ কটি চুক্তি হলেও বাস্তবায়ন হয়নি। উজানের বৃহৎ দেশ হিসাবে ভারত যেভাবে চেয়েছে, চুক্তির প্রবাহ কিংবা কিউসেকের ডাটাবেস সেভাবেই হয়েছে। তাই মহারাজা শ্রীশচন্দ্রের পশ্চিম পাড় সুফলা হলেও খরায় পুড়েছে পুবের মাটি। ভাগীরথী-হুগলির বুকে জল থৈ থৈ করলেও পদ্মার বুকে শুষ্ক বালুচর। কোলকাতায় মিঠাপানি থাকলেও লোনা জল ভাসে বাংলাদেশের দক্ষিণে। ভূ-রাজনৈতিক কৌশলে ফারাক্কা নিয়ে খুব বেশি এগুনোর সুযোগ আছে বলে মনে হয়না। তবে গঙ্গা বাঁধ বিকল্প পদ্মা রিজার্ভার একটি সমাধান হতে পারে। ভীষণ ব্যয় বহুল প্রকল্প মনে হলেও বাংলাদেশের জন্য সেটি সম্ভব। পদ্মা সেতু নির্মাণ করা জাতি আমরা। গঙ্গা বিকল্প পদ্মা ব্যারেজে আটকে থাকার কথা নয়।

ব্রামটন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent