জ্যাকি কার্টিয়ার, ফরাসী সামুদ্রিক অভিযাত্রী, ১৫৩৪ থেকে ১৫৪২ সাল পর্যন্ত, সেন্ট লরেন্স নদীর উপসাগরের অভ্যন্তরে তিন বারে তিনটি সামুদ্রিক অভিযানের নেতৃত্ব দেন। এই অভিযানের সময়, তিনি সোনা ও সম্পদের অন্বেষণে এসেছিলেন, কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে প্রথমবারের মতো নদীর অভ্যন্তর, উপসাগর থেকে মন্ট্রিয়াল পর্যন্ত সঠিকভাবে ম্যাপ করেছিলেন। এই ন্যাভিগেশন ও বিভিন্ন দক্ষতার জন্য কার্টিয়ারকে এখনও “কানাডা” নামের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করে।
একটি দেশের নামকরণের অর্পিত কর্মভার সহজ কাজ নয়। নামটি অবশ্যই ভূমি এবং জনগণের চরিত্রকে প্রতিফলিত করে, সর্বতোভাবে গ্রহণীয় এবং গর্ব ও শক্তির অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে। কানাডা নামের উৎপত্তির অনেক গল্প আছে, কিন্তু অনেকেই স্বীকার করে যে কানাডা নাম এসেছে আদিবাসী ইরোকোয়িয়ান শব্দ “কানাটা” থেকে, যার অর্থ গ্রাম বা কুঁড়েঘরের সমষ্টি মিলে একটি সম্প্রদায়। কার্টিয়ার ১৫৩৫ সালের সফরের সময় “কানাটা” কথাটি শুনে, কানাডা মনে করেন, তিনি সেন্ট লরেন্সের পাশে “কানাডার উপনিবেশ” প্রতিষ্ঠা করেন, যাকে ফরাসীরা “নতুন ফ্রান্স” বলেও অভিহিত করেছিল। সেখান থেকে “কানাডা” এর ব্যবহার প্রাধান্য পায়। আরও উপযুক্ত নাম কল্পনা করা তখন হয়ত কঠিন ছিল। কানাডা – এই ভূমির জনগণকে একটি সম্প্রদায় মনে করেছিল, এক সম্প্রদায়ের ছত্র ছায়ায় বিভিন্ন উৎসের লোকদের একত্রিত করে জাতীয় ঐক্যের বোধ জাগানোর জন্য অন্য যে কোনো নামের চেয়ে দেশের কানাডা নাম শ্রেয় প্রতিপন্ন হয়েছিল।
জ্যাকি কার্টিয়ার প্রথম সেন্ট লরেন্স উপসাগর এবং সেন্ট লরেন্স নদী তীরের বর্ণনা ও মানচিত্র তৈরি করেছিলেন। ১৫৩৫ সালে তার এই অভিযান ছিল দ্বিতীয় বারের মত সমুদ্র যাত্রায় সেন্ট লরেন্স নদীতে অগ্রযাত্রা, তখন তার সাথে ইরোকোয়ান আদিবাসী প্রধান ডোনাকোনার দুই ছেলেও ছিল। এদের দোভাষী হিসাবে প্রশিক্ষণের জন্য কার্টিয়ার প্রথম সমুদ্রযাত্রার পর দুই যুবককেই ফ্রান্সে নিয়ে গিয়েছিলেন।
কার্টিয়ার তার জার্নালে কানাডা নামটি নথিভুক্ত করেছিলেন, “কানাডা রাজ্য” বর্ণনা করেছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে সমুদ্র থেকে সেন্ট লরেন্স নদীর প্রবেশ পথই “কানাডায় যাওয়ার পথ এবং শুরুর পথ।” তিনি আদিবাসী প্রধান ডোনাকোনারের সম্প্রদায় ও অঞ্চলের নাম দেন “কানাডার প্রদেশ।” ১৫৪৫ সাল নাগাদ, ইউরোপীয় বই এবং মানচিত্র সেন্ট লরেন্স নদীর তীরে এই ছোট অঞ্চলটিকে “কানাডা” হিসাবে উল্লেখ করতে শুরু করেছিল। ১৫৪৭ সালে, মানচিত্র গুলি সেন্ট লরেন্স নদীর উত্তরে কানাডা নামটি দেখাচ্ছিল। কার্টিয়ার সেন্ট লরেন্স নদীকে লা রিভিয়ার ডু কানাডা (“কানাডার নদী”) হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং নামটি ধরে রাখা শুরু হয়েছিল। যদিও ফরাসীরা এই অঞ্চলটিকে নিউ ফ্রান্স নামে অভিহিত করেছিল, ১৬১৬ সালের পর কানাডার মহান নদী এবং সেন্ট লরেন্স উপসাগর বরাবর সমগ্র এলাকাটিকে কানাডা বলা হত।
১৭০০এর দশকে দেশটি পশ্চিম এবং দক্ষিণে বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে “কানাডা” উত্তর আমেরিকার মিডওয়েস্টে বিস্তৃত একটি অঞ্চলের নাম হয়ে উঠেছিল। ১৭৬৩ সালে ব্রিটিশরা নিউ ফ্রান্স জয় করার পর, উপনিবেশটির নামকরণ করে কুইবেক প্রদেশ। তবে কুইবেক প্রদেশটিকে আপার কানাডা এবং লোয়ার কানাডা উপনিবেশ হিসাবে পরে বিভক্ত করেছিল। আপার কানাডা, যেখানে বেশির ভাগ ব্রিটিশ অনুগতরা বসতি স্থাপন করেছিল, ব্রিটিশ সাধারণ আইন গ্রহণ করেছিল। লোয়ার কানাডা, যেখানে বেশিরভাগ ফরাসীরা বাস করত, ফরাসীদের সম্পত্তির অধিকার এবং ১৭৭৪ সালে ফরাসী কানাডিয়ানরা যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছিল সেগুলিও অক্ষুণ্ণ রেখেছিল, এবং নাম কুইবেক প্রদেশ ঘোষণা দিয়েছিল৷ ১৭৯১ সালের সাংবিধানিক আইন অটোয়া নদীর পশ্চিম অংশ (আপার কানাডা) ইংরেজি আইনি ব্যবস্থার অধীনে এনেছিল, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ইংরেজি ভাষাভাষীরা বাস করতে শুরু করেছিল। যেটি আজ আধুনিক অন্টারিও।
কার্টিয়ারের কানাডা নামের ব্যবহার প্রথম নাও হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন, যেহেতু তার আগেও স্পেন, পর্তুগাল এবং ব্রিটেনের জেলেরা তিমি মাছ শিকার করতে এই নতুন বিশ্বে এসেছিল। মেক্সিকো এবং পেরুতে স্প্যানিশরা স্বর্ণ ও সম্পদ অনুসন্ধানের জন্যও উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে কারণে ফ্রান্সের রাজা ফ্রাঁসোয়াও প্রথম কার্টিয়েরকে ১৫৩৪ সালে কানাডায় তার প্রথম সমুদ্রযাত্রায় পাঠাতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। স্প্যানিশরা যখন ইরোকোয়ান অঞ্চলে আসে আদিবাসীরা তাদের বলেছিল “আকা নাডা” যার অর্থ এখানে কিছু নাই। অভিযাত্রীরা মনে করেছিল “আকা নাডা” স্থানের নাম।এটিও কানাডা নামের একটি ইঙ্গিত হয়ত বহন করে।
১৮০৯ সালে লন্ডনে ইতিহাসবিদ হিউ গ্রে দাবি করেছিলেন যে, যখন ফরাসীরা নতুন ভূমিতে এসেছিল তখন আদিবাসীরা তাদের স্প্যানিশ মনে করে এবং তাদেরও চলে যেতে বলে বারবার “আকা নাডা” উচ্চারণ করে। ফরাসীরা বুঝতে না পেরে ভেবেছিল এটি দেশের নাম হতে পারে এবং কানাডা বলে ধারণা করে, এমন মতামতও রয়েছে।
যেহেতু এলাকাটিতে ফরাসী বসতি স্থাপন করা শুরু হয়েছিল, স্থানীয় আদিবাসী জনগণ নতুন সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিল। নিউ ফ্রান্স নামে নতুন দেশে অধিবাসীরা কানাডাকে পছন্দ করতে শুরু করেছিল। পরে উপনিবেশ স্থাপন করতে এসে ব্রিটিশরা অবশ্য কুইবেক নামটি ব্যবহার করতে বেশি ঝুঁকেছিল। স্যামুয়েল ডি চ্যাম্পলেইন নিউ ফ্রান্স নামের এই ফরাসী উপনিবেশের প্রথম গভর্নর জেনারেল হন এবং ১৬০৮ সালে তিনি যে সেন্ট লরেন্স নদী পাড়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন, তার নামটি দিয়েছিলেন কুইবেক। ফরাসীদের অনেকেই এই নামটির বিরোধিতা করেছিল। অবশেষে ব্রিটিশরা ১৭৯১ সালে কানাডা আইনে “কানাডা” নামটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে এবং আপার ও লোয়ার কানাডা তৈরি করে।
একটি নাম নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে কারণ খন্ডিত উপনিবেশ গুলিকে একত্রিত করার কথা বিবেচনা করা হয় এবং কনফেডারেশনের নেতারা বিকল্প উপাধি নিয়ে অনেক আলোচনা করেন। তারা তখন রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রয়াত স্বামী অ্যালবার্টসল্যান্ড বা রাণীর নিজ নাম ভিক্টোরিয়াল্যান্ডের সাথে সম্মানিত করার কথাও চিন্তা করেছিল। অন্যান্য পরামর্শের মধ্যে ছিল বোরেলিয়া, ব্রিটানিয়া, ক্যাবোটিয়া, নরল্যান্ড, সুপিরিয়র এবং ট্রান্সটলান্টিয়া ইত্যাদি। অবশেষে, ১৮৬৭ সাল থেকে উপনিবেশ গুলি সবমিলে কানাডার ডোমিনিয়ন নামে একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়, কার্টিয়ারের “কানাটা” থেকে “কানাডা” উচ্চারিত হওয়ার ৩০০ বছরেরও বেশি সময় পরে।
১ জুলাই, ১৮৬৭ সালে কনফেডারেশন গঠনের সময় নতুন সমষ্টিগত দেশটির আইনি নাম কানাডা হিসাবে গৃহিত হয়েছিল। কনফেডারেশন কনভেনশন আনুষ্ঠানিকভাবে কানাডা নামে সব প্রদেশকে যুক্ত করে, যার মধ্যে রয়েছে কুইবেক, অন্টারিও, নোভা স্কোটিয়া এবং নিউ ব্রান্সউইক। “কানাডা নামে এক আধিপত্য” হিসেবে পরে ধীরে ধীরে ম্যানিটোবা ১২ মে ১৮৭০ সালে, নর্থ-ওয়েষ্ট ট্যারিট্যরি ১৫জুলাই ১৮৭০ সালে, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ২০ জুলাই ১৮৭১ সালে, প্রিন্স এ্যাডওয়ার্ড অ্যায়ল্যান্ড ১ জুলাই, ১৮৭৩ সালে, আলবার্টা ও সাসকাচোয়ান ১ সেপ্টেম্বর, ১৯০৫ সালে, নিউফাউন্ডল্যান্ড ৩১ মার্চ, ১৯৪৯ সালে এবং সর্বশেষ নুনাভুত ১এপ্রিল, ১৯৯৯ সালে এই আধুনিক কানাডার কনফেডারেশনে যোগদান করে। যে কনফিগারেশন তৈরি হয়েছে, আজ এলাকার আয়তন অনুসারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ (রাশিয়ার পরে) বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১ জুলাই তাই এখনও কানাডা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।
কানাডার এই সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের হাস্যরসের জন্য পরিচিত এবং বলার মতো আরেকটি কাল্পনিক গল্প রয়েছে। ১৮১১ সালে একটি প্রস্তাবনা এমন হয়েছিল যে কানাডা নামটি নিউ ফ্রান্সের বাসিন্দাদের কাছ থেকে এসেছে যারা প্রতিদিন শুধুমাত্র একটি বিয়ারের ক্যান পান করার অনুমতি পেয়েছিল, “ক্যান এ্যা ডে” দিনে একটি বিয়ার ক্যান। তাই “কানাডা ডে” অর্থাৎ কানাডা দিবস উদযাপন করার জন্য, সম্ভবত এই শেষ গল্পটি অন্য যে কোনও হিসাবে উপযুক্ত হাস্যরসের ছিল। আমাদের দেশের নামের উৎপত্তির অনেক রঙিন গল্পের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেতে পারি যা আমাদের ইতিহাসকে ধারণ করে এবং গর্ব করার মত মনে করি। যে দেশটিতে জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে কানাডায় একই সম্প্রদায় ভুক্ত কানাডিয়ান বলে ভাবে।
কানাডিয়ান পরিচয়ের বেশিরভাগ ধারণা ঐক্য এবং বহুত্বের ধারণার মধ্যে স্থাপিত হয়েছে। কানাডিয়ান রীতিনীতি এবং ঐতিহ্য শেয়ার করে একক কানাডার একটি জাতির দৃষ্টিভঙ্গির উপর জোর দিয়ে, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির লোক এসে অভিবাসী হয়েও একসাথে মর্যাদার সাথে বসবাস করছে, যাকে আজকাল মাল্টিকালচারালিজম বলা হচ্ছে।
স্কারবোরো, অন্টারিও, কানাডা