শনিবার - মে ১৮ - ২০২৪

বহুরূপী কাঞ্চন ফুল

বহিনিয়া ভ্যারিয়েগাটা এর ফুল

ইডেন কলেজ। উচ্চমাধ্যমিক প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের প্রাক্টিক্যাল ক্লাস চলছে। বিষয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান। ল্যাবরেটরি এটেনডেন্ট কতগুলো পাতাসহ ডাল নিয়ে এলেন এক্সপেরিমেন্টের মেটেরিয়াল হিসেবে। কম্পাউন্ড বা যৌগিক পাতা কত রকমের হতে পারে সেটা দেখানোই এক্সপেরিমেন্টের মূল উদ্দেশ্য। একটা পাতাতে চোখ আটকে গেল কয়েকজন ছাত্রীর। পাতাটি দুইভাগে ভাগ করা (Bi-lobed leaf)। মনে হয় কিডনি আকৃতির দুটি পাতা একসাথে খানিকটা জোড়া দেয়া হয়েছে। কাঞ্চন ফুল গাছের পাতার এটাই বৈশিষ্ট। ঢাকাতে বিভিন্ন জায়গাতে সাদা কাঞ্চন দেখা যায়। গাড়ো বেগুনী রঙের অথবা লালচে রঙের কাঞ্চনও দেখা যায় যাকে আমরা সম্ভবত রক্ত কাঞ্চন বলি। কিন্তু লাল কাঞ্চন যা নাকি সত্যিই রক্তের মত দেখতে তেমন কাঞ্চনের সন্ধান পাইনি বাংলাদেশে, হয়ত অন্যরা পেয়ে থাকবেন। জানতে পারলাম সাউথ আফ্রিকা এবং সিডনীর পথে ঘাটে লাল কাঞ্চনের দেখা পাওয়া যাচ্ছে যা সত্যিই রক্তের মত লাল।
অনেক প্রকারের কাঞ্চন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে। আমাদের পরিচিত কাঞ্চন Bauhinia জেনাসের সদস্য। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী বহিনিয়া জেনাসে প্রায় ৫০০ এর উপর প্রজাতি রয়েছে। এরা প্রধানত ট্রপিক্যাল এবং টেমপারেট এলাকাতেই বেশী হয়। এদের বিস্তৃতিকে বলা হয় প্যান-ট্রপিক্যাল ডিস্ট্রিবিউশন যার অর্থ দাঁড়ায় এই জেনাসের প্রজাতিরা উত্তর এবং দক্ষিন গোলার্ধ এর ট্রপিক্যাল এলাকা গুলোতেই বেশী জন্মায়। সবাই Fabaceae পরিবারের সদস্য। এই জেনাসের সব উদ্ভিদেরই ফুল বড়।
বিশিষ্ট ট্যাক্সোনোমিস্ট ক্যারোলাস লিন্নিয়াস জেনাস Bauhinia এর নামকরণ করেন। জমজ দুই ভাই Johann Bauhin এবং Gaspard Bauhin এর উদ্ভিদ বিজ্ঞানে অবদানকে সন্মান প্রদর্শন করবার জন্য তিনি এই জেনাসের নাম দেন Bauhinia । এরা দু’জন ছিলেন ষোড়শ শতাব্দির দুই সুইস বিজ্ঞানী। Johann ছিলেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এবং Gaspard ছিলেন একই সাথে উদ্ভিদ বিজ্ঞানী এবং পদার্থবিদ। বহিনিয়ার এক জোড়া পাতাকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা দুই সুইস জমজ ভাই এর প্রতিক মনে করেন।
বহিনিয়া জেনাসের সব উদ্ভিদকে খুব সহজেই চেনা যায় তাদের জোড়া দেয়া বাইলোবড পাতার দুটোর জন্য। পাতার শিরাবিন্যাস করতলাকার। বহিনিয়া প্রজাতির সুদৃশ্য ফুল এবং পত্রগুচ্ছের জন্যে এদেরকে অরনামেন্টাল গাছ হিসেবে লাগানো হয়। এই গাছগুলো অনেকটা মাঝারী আকারের বৃক্ষ। বহিনিয়া জেনাসে বৃক্ষ, গুল্ম এবং কাষ্ঠল লতা লিয়ানা (woody climber), জাতীয় গাছ রয়েছে। কালচে বাদামি রঙের মসৃণ ছাল বিশিষ্ট গাছ এরা। শীতের সময় কিছু বহিনিয়া গাছের পাতা ঝরে যায়। পাতা ঝরে যাবার সাথে সাথে মিষ্টি ঘ্রাণ যুক্ত ফুলে গাছের খালি ডালগুলো ভরে যায়। কিছু কিছু বহিনিয়ার কোনো কোনো ডালে পাতা থাকে কিন্তু যে ডালে পাতা থাকেনা সেই ডালেই ফুল আসে।
হং কং এর জাতীয় পতাকায় বহিনিয়ার সুদৃশ্য একটি ফুল দেখা যায়। আবার হং কং এয়ার লাইনস এর এয়ার ট্রাফিক কমুনিকেশনের জন্য তাদের রেডিও কল-সাইন হিসেবে ব্যবহার করে ‘Bauhinia’। বহিনিয়ার অনেক প্রজাতি ট্রপিক্যাল এলাকাতে অর্কিড ট্রি হিসেবে লাগানো হয়। সম্ভবত ফুল দেখতে অনেকটা অর্কিডের মত বলে এদেরকে অর্কিড ট্রি বলে। আরও বিভিন্ন নামগুলো হল মাউনটেইন এবনী এবং ক্যামেলস ফুট ট্রি। ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানে এদেরকে বলে কাঞ্চনার বা কাঞ্চনাল এবং বাংলাদেশে বহিনিয়ার প্রজাতিকে কাঞ্চন বলা হয়। বেশ কিছু বহিনিয়ার প্রজাতির আদি বাস ইন্ডিয়াতে। একই সাথে এদেরকে বাংলাদেশেও পাওয়া যায়। তার মধ্যে সবচাইতে বহুল পরিচিতগুলো হলো Bauhinia variegata, B. purpurea, এবং B. acuminata এবং B. tomentosa।
ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশে যে সমস্ত রঙের কাঞ্চন পাওয়া যায় তারা সাদা, বেগুনী, হলুদ, গোলাপি এবং গাড়ো লালচে গোলাপি যা দেখতে অনেকটা লালের মতই। বহিনিয়ার একই প্রজাতির মধ্যেই বিভিন্ন রঙের কাঞ্চন পাওয়া যাচ্ছে। প্রজাতি অনুযায়ি ভাগ করলে দেখা যায়ঃ
Bauhinia acuminata – শুধু সাদা রঙের কাঞ্চন
Bauhinia purpurea – শুধু বেগুনী রঙের কাঞ্চন
Bauhinia variegata – সাদা, হালকা এবং গাড়ো বেগুনী এবং গোলাপি রঙের কাঞ্চন
Bauhinia tomentosa- হলুদ রঙের কাঞ্চন (ইন্ডিয়াতে পাওয়া যায়)
Bauhinia galpinii – লাল রঙের কাঞ্চন (অস্ট্রেলিয়াতে এবং সাউথ আফ্রিকা পাওয়া যায়। সম্ভবত বাংলাদেশে বা ইন্ডিয়াতে পওয়া যায়না)
বহিনিয়া একুমিনাটা সাদা রঙের কাঞ্চন। যাকে আমরা শ্বেত কাঞ্চন বলে জানি। ফুল দেখতে সাদা কিন্তু ফুলের আকৃতি একেবারেই ভিন্ন অন্যান্য কাঞ্চন ফুল থেকে। সাদা সুগন্ধিযুক্ত পাঁচ পাপড়ি বিশিষ্ট ফুল। অন্যান্য কাঞ্চনের মতই এদের পাতা বাইলোবড। বহিনিয়া একিউমিনাটা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। এরা প্রায় তিন মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এদেরকে ডোয়ারফ সাদা বহিনিয়া, বা স্নোয়ি অরকিড-ট্রি বলা হয়। সাউথ ইস্টার্ন এশিয়াতে এদের আদিবাস। বিভিন্ন দেশে ব্যাপক কালটিভেশনের কারণে এদের সঠিক নেটিভ রেঞ্জ অস্পষ্ট। সম্ভবত মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন।
বহিনিয়া ভ্যারিয়েগাটা প্রজাতিতে সাধারণত চার রঙের ফুল পাওয়া যায়। সাদা, হালকা এবং গাড়ো বেগুনী বা গোলাপি এবং গোলাপি রঙের কাঞ্চন। এই প্রজাতির সাদা রঙের কাঞ্চনকে সাধারণত শ্বেত কাঞ্চন এবং সম্ভবত গাড়ো বেগুনী বা গাড়ো গোলাপি রঙের কাঞ্চনকে রক্ত কাঞ্চন বলা হয় বাংলাদেশে। যদিও এরা রক্তের মত লাল নয়। বহিনিয়া ভ্যারিয়েগাটার আদি বাস চায়না, ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট এবং সাউথ ইস্টার্ন এশিয়াতে। এই প্রজাতির গাছ ছোট এবং মিডিয়াম সাইজের হয়। ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। শুকনোর সময়ে পাতা ঝরে যায়। খুবই জনপ্রিয় সুগন্ধি ফুল এরা। ফুল হিসেবে সাবট্রপিক্যাল এবং ট্রপিক্যাল পরিবেশে এদের চাষ হয়। নিওট্রপিক্যাল এলাকাতে হামিং বার্ডদের আকর্ষণ করবার জন্যেও এদেরকে ব্যবহার করা হয়। পাঁচ পাপড়ির একটি ফুলের একটি পাপড়িতে একটু গাড়ো রঙের লাইন করে দাগ কাটা আছে। সম্ভবত সেই কারণে এদেরকে ভ্যারিয়েগাটা বলা হয়।
কাঞ্চন ফুল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় পাকিস্তানি এবং ইন্ডিয়ান খাবারে। ট্রাডিশনাল কাঞ্চনের খাবার তৈরিতে সাধারণত কাঞ্চনের কুঁড়ি, দই, পেঁয়াজ এবং ইন্ডিয়ান এবং পাকিস্তানি মশলা সহযোগে সুস্বাদু খাবার তৈরি করা যায় যা নাকি শরীরের জন্যেও ভালো। অনেক ঔষধি গুন আছে এই গাছের। বায়ুনাশক, স্থূলতা কমায়, কৃমি নাশক, ডাইরিয়া,আলসার, ত্বকের সমস্যা, টিবি ও‌ কুষ্ঠ রোগের ঔষধ হিসেবে কাজ করে এবং টনিক হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
বহিনিয়া পারপিউরিয়া-র গাছ দেখতে অনেকটা বহিনিয়া ভ্যারিয়েগাটা এর মতো। ফুলের রঙ গাড়ো উজ্জল বেগুনী রঙের হয়ে থাকে। এদের পাতা শীতের সময় ঝরে যায়। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরের আগে ফুল ফোটেনা। লম্বা সবুজ-বেগুনী ফল দেখা যায় যা দেখতে অনেকটা ফ্রেঞ্চ বিনের মত। পাঁচ পাপড়ি যুক্ত ফুল। পাপড়ির আগা সরু থাকে। পাপড়ি ভারিয়েগাটার চাইতে সরু বা চিকন। মাঝে মাঝে একটি পাপড়ির গোড়ার দিকে সাদাটে থাকে। এদের শিকড় খুবই বিষাক্ত।
বহিনিয়া গালপিনি-র ফুল হয় টকটকে লাল রঙের। পাতা অন্যান্য কাঞ্চনের মতই তবে আগার দিকে গোলাকার। এই প্রজাতির এপিথেটের (প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নামের শেষের অংশ) নামকরণ করা হয় Ernest Edward Galpin এর নাম অনুসারে। যিনি ছিলেন একজন সাউথ আফ্রিকান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান থেকে এই প্রজাতি সংগ্রহের সাথে ব্যাপকভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। এদের জংলী ফুল গুলো ইটের মত লাল হয়ে থাকে। কাল্টিভেটেড ভ্যারাইটির ফুলগুলো কমলা-লাল রঙের হয়ে থাকে। সামারে এদের গ্রোথ সবচাইতে ভালো হয়। এই সময় গাছ সবুজ থাকে। সাধারণত ঘন এবং আঁকাবাঁকা শ্রাব, গুল্ম বা ঝোপ জাতিয় গাছ। উচ্চতা প্রায় তিন মিটারের মত হয় পাঁচ মিটার প্রশস্ত হয় এই গাছ। এই প্রজাতির আদি বাস ইস্টার্ন এবং সাউদারন আফ্রিকাতে। খরা-সহিষ্ণু হওয়ার কারণে এই প্রজাতির ব্যাপকভাবে চাষ হয় আমেরিকা এবং মেক্সিকোর উষ্ণ এলাকা গুলোতে। আফ্রিকাতে এর জনপ্রিয় নাম Pride of De Kaap। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে একে বিভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন, রেড বিহিনিয়া, ন্যাস্টারশিয়াম বহিনিয়া, আফ্রিকান প্লুম এবং রেড অর্কিড বুশ। ফুল ফোটা শুরু হয় সাধারণত লেট সামার থেকে শীতের প্রারম্ভ পর্যন্ত। গ্রীষ্মের মাঝামাঝিতে গাছটি পাতাতে ভরে যায় আবার।
ছবির ক্যাপশনঃ
১) বহিনিয়া ভ্যারিয়েগাটা এর ফুল (সাদা) সূত্রঃ Pinterest
২) বহিনিয়া গালপিনি এর ফুল (লাল) সূত্রঃ www.plantbook.co.za
৩) বহিনিয়া ভ্যারিয়েগাটা এর ফুল (হালকা বেগুনি) সূত্রঃ keyserver.lucidcentral.org
৪) পাতাসহ বহিনিয়ার ডাল সূত্রঃ http://www.westafricanplants.senckenberg.de
৫) বহিনিয়া একুমিনাটা এর ফুল (সাদা) সূত্রঃ ml.wikipedia.org
৬) বহিনিয়া পারপিউরিয়া এর ফুল (উজ্ঞল বেগুনী) সূত্রঃ Heliconia Paradise
৭) বহিনিয়া একুমিনাটা এর ফুলসহ গাছ (সাদা) সূত্রঃ Plantekey Auroville Botanical Garden
৮) বহিনিয়া পারপিউরিয়া এর ফুলসহ গাছ (উজ্জ্বল বেগুনী) সূত্রঃ plantinfo.co.za
৯) বহিনিয়া গালপিনি এর ডালসহ ফুলের মঞ্জুরি (লাল) সূত্রঃ Flickriver
১০) বহিনিয়া ফুলের প্রতীকসহ হং কং এর জাতীয় পতাকা।

- Advertisement -

Read More

Recent