শনিবার - মে ১৮ - ২০২৪

সম্পদের কেন্দ্রীকরণ : একটি অশনি সংকেত

ছবি ন্যাথানিয়েল বোম্যান

এবারও আমাজন ডট কমের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় প্রথম অবস্থানে রয়েছেন। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছেন যথাক্রমে বিল গেটস এবং ওয়ারেন বাফেট। মার্ক জাকারবার্গ আছেন অষ্টম স্থানে। কিন্তু এই সংবাদটি জনসাধারণের জন্য কি কোনো বার্তা বহন করে? আপাততঃ দৃষ্টিতে এই তথ্যটি কুইজ প্রতিযোগিতায় কাজে লাগতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু একটু গভীরে তলিয়ে দেখলে এটি মোটেও হেলাফেলা করার মত সংবাদ নয়।
ক্রেডিট সুইসের গবেষণা তথ্য অনুযায়ী (রিপোর্ট ২০১৩) বিশ্বের মাত্র এক শতাংশ ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ সারাবিশ্বের অর্ধেক সম্পদের মালিক এবং দশ শতাংশ ধনীক শ্রেণি ৮৫ শতাংশ সম্পদের অধিকারী এবং ৯০ ভাগ আমজনতা মাত্র ১৫ শতাংশ সম্পদের অধিকার ভোগ করে। মাত্র ৪০০ জন আমেরিকান ধনী ব্যক্তি যে পরিমাণ সম্পদের অধিকারী সমগ্র আমেরিকার অর্ধেক জনগণ অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষের সেই পরিমাণ সম্পদ নেই। জানুয়ারি ২০১৯ এ প্রকাশিত অক্সফাম এর রিপোর্ট বলছে ২০১৮ সালে বিশ্বে যে সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে তার ৮২ শতাংশের মালিকানা গেছে ১ শতাংশ ধনীদের দখলে। আর পিরামিডের পাদদেশে পড়ে থাকা ৩৭০ কোটি মানুষের কোন সম্পদ বাড়েনি। নিঃসন্দেহ এটি একটি ভয়াবহ বৈষম্যের চিত্র। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে একটি অশনি সংকেত।
অশনি সংকেত এই জন্য যে, কতিপয় ব্যক্তির নিকট সম্পদের এই কেন্দ্রীকরণ ক্রমশই পুঞ্জিভূত হচ্ছে। সম্পদের অসম বণ্টন এবং আয় বৈষম্যের চূড়ান্ত ফলাফলে ঘটতে পারে যে কোনো ধরনের বিষ্ফোরণ। এভাবে চলতে থাকলে এমন একটা সময় আসবে যখন কতিপয় ধনী ব্যক্তির থলে ভর্তি অর্থের দিকে তাকিয়ে থাকবে অধিকাংশ জনগণ। অর্থের অভাবে সংকুচিত হবে বাজার। কমে যাবে উৎপাদন। অধিকাংশ মানুষ হয়ে পড়বে কর্মহীন, বেকার। ক্রেতার অভাবে হাহাকার করবে শপিং মল। কমে যাবে অনলাইনের কেনাকাটা। শুধু বেকার জনসাধারণই নয়, স্বয়ং আমাজন ডট কমের কর্ণধার ক্ষতিগ্রস্থ হবেন এই দুষ্ট চক্রের খপ্পরে পড়ে।
সুতরাং বাজার অর্থনীতি এই দুষ্ট চক্রের শৃংখলে বাঁধা পড়ার আগেই আমাদের উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। একটি চক্রাকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেখানে অর্থ এবং সম্পদ কতিপয় ব্যক্তির নিকট পুঞ্জিভূত না হয়ে বরং সমাজের বিবিধ শ্রেণি ও পেশার মানুষের কাছে বণ্টন হয় এবং ক্রেতা শ্রেণি তৈরি হয়। ক্রেতা শ্রেণি তখনই তৈরি হবে যখন মানুষের কাছে থাকবে যোগ্যতা ভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ। আর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সচেতন হতে হবে।
প্রথমত, মানুষের কর্মসংস্থানকে বিলীন করে এই ধরনের যান্ত্রিক প্রযুক্তি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবটীয় পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। প্রযুক্তি যে কর্মসংস্থান হ্রাস করার পরিবর্তে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘বিকাশ’। মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে একটি অপ্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করেছে বিকাশ। শহরে ও গ্রামে-গঞ্জে এজেন্ট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে তৈরি করেছে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর জন্য কর্মসংস্থান।
দ্বিতীয়ত, নবীন প্রজন্মকে সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় কারিগরী এবং বিবিধ পেশায় শিক্ষা লাভ এবং দক্ষতা অর্জনের সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের নবীন উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার জন্য প্রণোদনা দিতে হবে।
তৃতীয়ত, নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. ইউনূস কর্তৃক প্রবর্তিত সামাজিক ব্যবসা বা সোস্যাল এন্টারপ্রাইজের বিকাশ ঘটাতে হবে। বর্তমানে গ্রামীণ এবং ব্রাক সামাজিক ব্যবসা বা সোস্যাল এন্টারপ্রাইজ নিয়ে কাজ করছে। ভবিষ্যতে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকেও সামাজিক ব্যবসা বিকাশে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক ব্যবসার অর্থায়নের জন্য বড় করপোরেশনগুলো তাদের সিএসআর ফান্ড থেকে অর্থায়ন করতে পারে। প্রথাগত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশপাশি সামাজিক ব্যবসা বিকাশ লাভ করলে অর্থের কেন্দ্রীকরণ অনেকটাই রোধ করা সম্ভব হবে।
সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনেতিক ব্যবস্থায় চারটি ক্ষেত্রে রক্ষা বুহ্য তৈরি করতে পারে। প্রথমত, সামাজিক ব্যবসার বিকাশের ফলে জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশের বিপর্যয় রক্ষা করার ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসা একটি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে। ধরা যাক, পরিত্যক্ত প্লাস্টিককে রিসাইকেল বা পুনঃ বিন্যাস করে পণ্য উৎপাদন এবং বাজারজাত করা যেতে পারে। এতে করে একদিকে কর্মসংস্থান তৈরি হবে অন্য দিকে রক্ষা পাবে পরিবেশ। নতুবা নদী নালা সমুদ্রে পরিত্যক্ত নিমজ্জিত প্লাস্টিক সামগ্রী দুর্বিসহ করে তুলতে পারে আমাদের জীবন যাত্রা এবং পরিবেশ।
চতুর্থত, স্বাস্থ্য সেবা ক্ষেত্রেও রক্ষা কবচ হতে পারে সামাজিক ব্যবসা বা সোস্যাল এন্টারপ্রাইজ। সম্প্রতি নিপোটের একটি সমীক্ষায় প্রকাশ পায় যে বাংলাদেশে ১০ শতাংশ ব্যক্তি ডায়াবেটিসে ভুগছে। এছাড়া হাইপারটেনশন রোগে আক্রান্তের সংখ্যাও ব্যাপক। নিয়ন্ত্রন করা না গেলে এই সকল অসংক্রামক রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য বিরাট হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সামাজিক ব্যবসার আওতায় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র এবং হাসপাতাল পরিচালনা করা হলে সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা দেয়া সম্ভব হবে। এছাড়াও সামাজিক ব্যবসার আওতায় স্বাস্থ্য বীমা ব্যবসা দিতে পারে সামাজিক সুরক্ষা।
সম্পদের ক্রমাগত কেন্দ্রীকরণ রোধ করতে হলে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে যা কর্মসংকোচন নয় বরং কর্মসংস্থান তৈরি করে। উৎপাদন এবং সেবা খাতে যে ভাবে অটোমেশন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে তা কতটা ব্যয় হ্রাস করে এবং কত সংখ্যক কর্মসংস্থান বিলোপ করে তা ভেবে দেখা দরকার। অটোমেশন বা স্বয়ংক্রীয় প্রযুক্তির ব্যবহার এমন হওয়া উচিত যা উৎপাদন এবং সেবাদানে গতি এনে দেবে কিন্তু মানবিয় স্পর্শ রোহিত করবে না।
সম্প্রতি গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুন্দর পিচাই এবং চীনের টেলিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেন ঝেংফেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। সুন্দর পিচাই বলছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স (এআই) মানবজাতির জন্য আশীর্বাদও হতে পারে কিংবা অভিশাপও হতে পারে। নির্ভর করছে বিশেষজ্ঞরা এটাকে কিভাবে ব্যবহার করবেন। সুন্দর পিচাই বলেন এআই প্রযুক্তি স্বয়ংক্রিয় গাড়ি এবং স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অধীনে নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে থেকে একটি যুক্তিগ্রাহ্য উপায় বের করার পক্ষে তিনি মতামত ব্যক্ত করেছেন।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি ইউরোপিয় ইউনিয়ন আগামী পাঁচ বছরের জন্য চেহারা শনাক্তকারী প্রযুক্তি ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। সুন্দর পিচাই বলেন, প্রযুক্তি হিসাবে এআইয়ের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্তে¡ও এটির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে মানুষের অস্তিত্ব ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। কারন ফেক ভিডিও কিংবা কম্পিউটারে তৈরি নিখুঁত নকল ভিডিও মানব সভ্যতাকে তীব্র হুমকির মুখে ফেলেছে। এই ধরনের নেতিবাচক কাজে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। অপর পক্ষে হুয়াওয়ে, প্রধান রেন ঝেংফেই বলছেন, যন্ত্রের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে মানুষের মনের ভয় অমূলক। একসময় মানুষ পারমাণবিক বোমা ভয় পেত। এখন মানুষ শংকা প্রকাশ করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে। এআই কখনোই মানুষের প্রতিযোগী হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিতর্ক যাই থাকুক না কেন, নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে যেন রোবটিকস এবং এআইয়ের প্রয়োগ মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হয় এবং কর্মসংস্থান লোপ করা নয় বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হয়।

- Advertisement -

Read More

Recent