রবিবার - মে ১৯ - ২০২৪

তিস্তা ব্যারেজের ইতিকথা

আইয়ুব খান ক্ষমতায় এলে পাকিস্তানের অসংখ্য উন্নয়ন পরিকল্পনার মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে গোনা যে কয়টি প্রকল্প স্থান পায় তিস্তা ব্যারেজ এর অন্যতম

সনি আর টুনি দুই ভাই। তিব্বতের শেরপা সম্প্রদায়ের লড়াকু পর্বত সৈনিক। স্কটিশ বিজ্ঞানী অ্যালেক্সান্ডার মিচেল কেল্লাস এই দুই ভাইকে আবিষ্কার করেন ১৯১১ সালে। পাহাড়ি জল হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সুঠাম দেহী দুই ভাইকে আবিষ্কারের পেছনে এক বিশাল বৈজ্ঞানিক রহস্য লুকিয়ে আছে।
বিজ্ঞানী অ্যালেক্স ছিলেন রসায়নবিদ। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পারদ তখন উত্তুঙ্গে। বিজ্ঞানীরা বিশ্ব সমাজের সবচে বড় সেলিব্রেটি। সেসময় তাঁর ‘হাই-আলটিচ্যুড ফিজিওলজি থিওরি’ হৈ চৈ ফেলে সারা বিশ্বে। বাই প্রোডাক্ট বিষফোঁড়ার মতো সমালোচনার ঝড়ও ওঠে। অন্য বিজ্ঞানীরা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন তাঁকে। বিদ্রুপ করা হলো, কাগজের বিজ্ঞানপত্রকে মানবদেহে প্রতিস্থাপন করে ‘থিওরি’ প্রমান করুণ মিস্টার কেল্লাস?
বিজ্ঞানী অ্যালেক্সান্ডার মিচেল কেল্লাস তত্ত্ব দিয়েছেন হিমালয়ের উচ্চ চূড়ায় উঠতে মানবদেহে সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেন প্রয়োজন নেই। হাই-আলটিচ্যুড ফিজিওলজিতে তিনি তাত্ত্বিকভাবে সরলীকরণ করেছেন সুঠাম দেহের সুগঠিত সুস্থ ফুসফুসে বাড়তি অক্সিজেন ছাড়াই মানুষ হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠতে পারে। এক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত বায়ু চাপ এবং অপ্রতুল অক্সিজেন বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেনা।
অ্যালেক্স ভারতবর্ষে এলেন। সীমানা পেরিয়ে উত্তরের পর্বত মালায় গেলেন। তিব্বতের পাহাড় জঙ্গল গ্লেসিয়ার চষে বেড়ালেন। সুখী শেরপা গোষ্ঠির যুৎসই সুঠামদেহী মানুষ খুঁজতে লাগলেন। গিনিপিগ হিসাবে নয়। কাউকে তিনি গিনিপিগ বানাতেন না। মানবীয় গুণের বিশাল মনের মানুষটির হার্ট বা হৃদয়টাই কেবল বড়ো ছিলোনা। ছিলো বিশাল একটা ফুসফুস। যা দিয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতেন। একারণে নিজেই হতে পেরেছিলেন বিখ্যাত মাউন্টেনিয়ার বা পর্বতারোহী। পাহাড় বেয়ে উপরে উঠতে তাঁর দমে ঘাটতি হয়নি কখনো।
হঠাৎ একদিন সনি টুনির দেখা পেয়ে গেলেন। ভীষণ পছন্দ হলো ওঁদের। দুই ভাইয়ের শারীরিক গড়ন এবং সাহস মুগ্ধ করলো এই বিজ্ঞানী কাম পর্বতারোহিকে। টিমের সদস্য করলেন। ট্রেনিং দিলেন। এবার এসাইনমেন্ট!!
বেশ কঠিন এসাইনমেন্ট দেয়া হলো। উঠতে হবে ৭ কিলোমিটার উঁচু পর্বত চূড়ায়। কাঞ্চনজঙ্গা থেকে ৭৫ কিলোমিটার উত্তরে পাউহুনরি নামক পর্বতচূড়ায়।
আনুমানিক রুট আগেই ঠিক করা ছিলো। এবার কবি নজরুলের দুস্তর পারাবারে দুর্গম গিরি যাত্রা। নিশ্চিত মৃত্যু মাথায় রেখে তিন বীর সনি, টুনি, অ্যালেক্স যাত্রা শুরু করলেন। অক্সিজেন বোতল ছাড়াই শুরু হলো আরোহন। পাহাড়ি জঙ্গলে বিষাক্ত পোকা, সর্পদংশন, বৃক্ষ কন্টক আর পা হড়কে ভয়ংকর মৃত্যুকূপে পতিত হবার শংকা। একফুট একফুট করে উপরে উঠছে। উঠতে হবে ২৩ হাজার ৩৮৬ ফুট!
নীচে তাকালে ভয়াবহ গিরিখাত। পাথুরে খাঁড়া গা। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হবার দশা! হলিউড থ্রীলার এর কাছে নস্যি। থ্রী-ডি থিয়েটারে বসে এমন দৃশ্য দেখলে দর্শকের সীট থেকে পড়ে যাওয়া নিশ্চিত! আর ওঁরা সেটি বাস্তবে রূপদান করে যাচ্ছে……।
১৪ জুন ১৯১১। দুটি নতুন বিশ্ব রেকর্ড। এক. সর্বোচ্চ চূড়ায় মানুষের নন-মেক্যানিক্যাল আরোহন। দুই. ৭ কিলোমিটারের অধিক উচ্চতায় সাপ্লিমেন্টারী অক্সিজেন ছাড়া মানুষের স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহন।
রেকর্ড বলবৎ ছিলো ১৯২৮ পর্যন্ত। পামির মালভূমিতে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের লেনিন পিক (বর্তমানে তাজিকিস্তানের ইবনে সিনা পর্বতচূড়া) বিজয়ের মাধ্যমে এ রেকর্ডের অবসান হয়।
মনে মনে এবার পাঠকের প্রশ্ন। অক্সিজেন, ফুসফুস, রসায়ন, বায়োলজি আর পর্বত চূড়ার সাথে শিরোনামে দেয়া ‘তিস্তা ব্যারেজের ইতিকথা’র সম্পর্ক কি? জানি… সবাই এখন অযথা প্যাঁচালের দায়ে লেখকের মুন্ডুপাত করছেন। তবে হ্যাঁ, সম্পর্ক একটা আছে। কেনোনা অ্যালেক্স তাঁর অক্সিজেন ফিজিওলজি প্রমাণ করতে হিমালয়ের পাউহুনরি নামক যে চূড়ায় উঠেছিলেন, সেটিই আমাদের প্রিয় নদী তিস্তার জন্মস্থান। “কোথাকার জল কোথায় গড়ায়”, এই আপ্তবাক্যের সত্যতা যাচাইয়ের চমৎকার প্রেক্ষাপট হতে পারে তিস্তার গল্প। রসায়ন, বায়োলজি আর ভূগোলের বরফ শীতল জল পাউহুনরি থেকে গড়িয়ে চুপিচুপি ডুব দেয় যমুনার উষ্ণ পানিতে।
প্রকৃতির কী আশ্চর্য খেয়াল! চীন-ভারত সীমানায় চীনের তিব্বতের পাউহুনরি পর্বত চূড়ার বরফ গলা জলে সৃষ্ট সিকিমের সোলামো সোলামো (Tso Lhamo) লেক বা হ্রদ। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৫১০০ মিটার উচ্চতায় এ হ্রদ। সোলামো হ্রদের দক্ষিণে বহমান স্রোতের নাম তিস্তা। সেখান থেকে দীর্ঘ ৪১৪ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে তিস্তার শেষ বিন্দু গড়িয়েছে বাংলাদেশের যমুনায়। কুড়িগ্রাম গাইবান্ধার বিশুষ্ক চরাঞ্চলে! ফুলছড়ি ঘাটের কাছে।
উত্তরবঙ্গের লক্ষ কোটি কৃষকের ফসলি জমির তৃষিত জলধারার নাম তিস্তা। রুক্ষ শুষ্ক মৃত্তিকা কন্যার মন ভেজাবার প্রাকৃতিক কৌশলী নদী। প্রকৃতির যে কৌশলে ঊষর মৃত্তিকার নরম জঠরে জন্মে সবুজ ফসল। গোলাভরা শস্য।
নদীজল আর মৃত্তিকা কন্যার প্রাকৃতিক প্রেমের গল্পে বারবার বাঁধা হয়েছে দাঁড়িয়েছে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি। ভিলেনের ভূমিকায় প্রতিবার অবতীর্ণ হয়েছে প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারত। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাকৃতিক কৌশলের পরিপূরক হিসাবে প্রকৃষ্ট কৌশল অর্থাৎ প্রকৌশল বিদ্যার আশ্রয় নেয়া হয়। উদ্যোগ গ্রহন করা হয় তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের।
উদ্যোগটা সর্বপ্রথম ১৯৩৫ সালে নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হুভার ড্যামসহ বিশ্বেজুড়ে বড় বাঁধ নির্মাণ চলছে তখন। সেই জোয়ারে বৃটিশ ভারত সরকার বেশ কটি বাঁধ ভারত বর্ষে নির্মাণের পরিকল্পনা করে। কিন্তু অবহেলিত উত্তরবঙ্গ রাজনৈতিকভাবে বিষয়টিকে বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারেনি। প্রস্তাবনাতেই প্রস্থান ঘটে। এরপর এলো সাতচল্লিশের দেশ ভাগ। অবহেলিত পূর্ব বাংলার উন্নয়ন ভাবনায় তিস্তা প্রকল্পের নাম উচ্চারিত হয়নি। অথচ পূর্ব বাংলা কৃষি ভান্ডার উত্তরবঙ্গে ব্যাপক চাষাবাদের সুযোগ ছিলো। কেবল সেচের অভাবে লক্ষ লক্ষ একর জমিতে ফসল উৎপাদন সম্ভব হয়নি।
আইয়ুব খান ক্ষমতায় এলে পাকিস্তানের অসংখ্য উন্নয়ন পরিকল্পনার মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের হাতে গোনা যে কয়টি প্রকল্প স্থান পায় তিস্তা ব্যারেজ এর অন্যতম। ১৯৬০ সালে একটি প্রাথমিক সমীক্ষা হয় হাই জিন এন্ড এসোসিয়েটস এবং এসোসিয়েটেড কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স নামক দুটি প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠান দুটি পরামর্শ দেয় তৎকালীন রংপুর জেলার হাতীবান্ধা থানার গড্ডিমারী এলাকায় বাঁধ নির্মাণের। এতে তিস্তা নদীর পানি খালের মাধ্যমে খরা এলাকায় সরবরাহ সুবিধা হবে। পরে ১৯৬৮-৭০ সালে বিনি এন্ড পার্টনার নামে আরেকটি প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডালিয়া এলাকায় বাঁধ নির্মাণের পরামর্শ দেয়। সর্বনিম্ন খরচ এবং সর্বাধিক অর্থনৈতিক সুবিধা প্রাপ্তির আশায় সরকার একাধিক পরামর্শক নিয়োগ করে থাকেন।
একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সবকিছু স্থবির হলেও পরবর্তীতে আবার সচল হয়। বিভিন্ন স্থানের মাটি পরীক্ষা, পানির গভীরতা পরীক্ষা, গতি প্রকৃতি গবেষণা, অনুসন্ধান এবং জরিপ কাজ চালানো হয়। এরই মাঝে ভারত তিস্তা নদীর উজানে গাজোলডোবা নামক এলাকায় বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ভারতের প্রকল্পটি কৃষি ভিত্তিক নয়। হাইড্রোইলেক্ট্রিক। অর্থাৎ বিদ্যুৎ তৈরীর জন্য বাঁধ নির্মাণ। আমাদের কাপ্তাই বাঁধের মতো। গাজোলডোবা বাঁধের অবস্থান আমাদের তিস্তা বাঁধ থেকে ১০০ কিলোমিটার উজানে। পূর্ব সিকিমের ডিকচু শহরের কাছে।
পাকিস্তান আমলে বিদ্যুৎ এবং পানি ব্যবস্থাপনার জন্য ওয়াপদা নামক প্রতিষ্ঠান ছিলো। মূলত তাঁদের তত্ত্বাবধানেই দেশী বিদেশী প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানগুলো বাঁধের গবেষণা এবং জরিপ কাজ চালিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ওয়াপদা ভেঙে দুটো আলাদা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান তৈরী করা হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। তিস্তা পরিচালনা, গবেষণা, অনুসন্ধান এবং জরিপের যাবতীয় তদারকির দায়িত্ত্ব অর্পিত হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকৌশল পরামর্শের জন্য দ্বারস্ত হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। দুই প্রতিষ্ঠানের গবেষক ও পরামর্শক প্রকৌশলীদের যৌথ উদ্যোগে পূর্বের সকল রিপোর্ট নতুন করে যাচাই বাছাই করা হয়। পানি সম্পদ প্রকৌশল ও ব্যবস্থাপনার জন্য সকল ডিজাইন সম্পন্ন করা হয়। অবশেষে ১৯৭৯ সালে তখনকার রংপুর জেলার ডিমলা থানার ডালিয়া এলাকায় বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়।
উত্তরবঙ্গের লাখো কৃষকের স্বপ্ন, বাঁধ হলে জমি জল পাবে। কিন্তু উজানে বাঁধ নির্মাণ এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ পানি প্রত্যাহারের বিভিন্ন কর্মসূচির কারণে ডালিয়ায় বাঁধ নির্মাণের আগেই সীমানার ওপাশ থেকে জলের চাপ কমে যায়। আন্তৰ্জাতিক রীতিনীতি মানা না মানা নিয়ে শুরু হয় দুদেশের টানাপোড়েন। ঝুলে যায় বাংলার কৃষকের ভাগ্য।
১৯৫৯ সালের সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্ট অনুযায়ী প্রস্তাবিত ব্যারেজে পানি সরবরাহ থাকার কথা ছিলো ২৫৫ কিউমেক বা প্রায় ৯০০০ কিউসেক। এই পরিমান পানির সরবরাহ হলে বৃহত্তর রংপুর দিনাজপুর এবং বগুড়ার সাত জেলার ৭ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা যাবে। ২০০০ হাজার সালের শুষ্ক মওসুমে গড়ে সর্বোচ্চ পানির সরবরাহ ছিলো। কিন্তু এই সর্বোচ্চ সরবরাহ দিয়েও প্রস্তাবিত ভূমির শতকরা ৮০ ভাগ জমিতে পানি দেয়া সম্ভব হয়নি। তিস্তা ব্যারেজ ডিজাইন করা হয়েছিলো বিপুল ক্ষমতা ধারণ করে। ক্ষমতা মানে পানি সরবরাহ করার ক্ষমতা।
ব্যারেজটি ৪৪টি গেটের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৭ শত ৫৫ কিউমেক পানি সরবরাহ করতে পারে। অথচ ২০০০ সালের শুষ্ক মৌসুমে গড় সরবরাহ ছিলো মাত্র ২০৪ কিউমেক। গড়পড়তা হিসাবে এটাই সর্বোচ্চ। মোট সরবরাহ ক্ষমতার মাত্র শতকরা ১.৬ ভাগ। ফেব্রুয়ারি মাসে পানির স্রোতধারা সবচে কম থাকে। খুব কম দিনই ১৬০ কিউমেক বা সাড়ে ৫ হাজার কিউসেক অতিক্রম করে।
চড়াই উৎরাই পেরিয়ে তিস্তা ব্যারেজের কাজ শুরু হয়েছিলো ১৯৭৯ সালে। ডালিয়ার দুয়ানি পয়েন্টে। শেষ হতে লেগে যায় প্রায় এক যুগ। ১৯৯০ সালের আগস্ট মাসে এটি সমাপ্ত হয়। যদিও এ প্রকল্পের সাথে যুক্ত ইরিগেশন ক্যানেলটির কাজ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে এবং সম্পন্ন হয় ১৯৯৮ সালে। ইরিগেশন ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ১১০ মিটার। এর সাথে রয়েছে অতিরিক্ত পলিমাটি আলাদা করার আরেকটি বেশি কৌশল। এমন ধরণের স্ট্রাকচার সচরাচর সব বাঁধে দেখা যায়না। এই বাঁধে এটি রাখার কারণ তিস্তার পানিতে ভেসে আসে প্রচুর পলিমাটি। যা ভূমিকে উর্বর করে , কিন্তু এটি ব্যারেজ স্ট্রাকচারের উপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে। তাই বিশেষ আরেকটি ট্র্যাপ তৈরী করে পলিমাটি আলাদা করা হয়েছে।
তিস্তা ব্যারেজের ডিসচার্জ ক্ষমতার বাইরেও অতিরিক্ত বন্যার পানি সরবরাহ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ৬১০ মিটার লম্বা ফ্লাড বাইপাস রয়েছে। আবার প্রায় আড়াই কিলোমিটার লম্বা (২ হাজার ৪ শত ৬০ মিটার) ক্লোজার ড্যাম বা বাঁধ রয়েছে। তিস্তা ব্যারেজ কেবল একটি ব্যারেজ প্রকল্পই নয়। এর ব্যাপ্তি বিশাল। অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং আশাব্যাঞ্জক প্রকল্প। ব্যারেজের পানি উজান থেকে ভাটির দিকে আসার পর সেটি নিয়ন্ত্রণের জন্য ৮০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ বানানো হয়েছে। আবার ৭ লক্ষ ৫০ হাজার হেক্টর ভূমিতে পানিতে সরবরাহের জন্য ৩০৭ কিলোমিটার প্রধান খাল, ১৪৫০ কিলোমিটার মাঝারি খাল এবং ২৭৩৫ কিলোমিটার ছোটো নালা তৈরী করা হয়েছে। এর সাথে সংযুক্ত রাখা হয়েছে ৮০০০ ছোট আউটলেট খাল। পানিসম্পদ বিষয়ে এতো বড় কর্মযজ্ঞ আগে হয়নি কখনো। পরেও হয়নি।
খরচের হিসাবটা কোনো রেফারেন্স থেকেই সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। একেতো দুর্নীতি প্রতি পদে পদে। তার উপর এতো বড় জটিল প্রকল্পে টাকা পয়সা এক খাত থেকে অন্য খাতে ব্যয় করা হয়। যার ফলে খাতওয়ারি কোথায় কতো খরচ হলো তার হিসাব বের করা কঠিন। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেও মন্ত্রীরা সঠিক খরচ উত্থাপনে ব্যর্থ হন। এটি কেবল তিস্তা প্রকল্প নয়। সরকারি সব প্রকল্পেই এমন ঘটনা ঘটছে। তবে ১৯৯০ সালে মূল ব্যারেজ হবার পর একটি অংক প্রকাশ করা হয়েছিলো। তাতে প্রকল্প ব্যয় দেখানো হয়েছিলো ওই সময় পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮ হাজার ৫ শত ৭৪ মিলিয়ন টাকা। আশার কথা হলো এ অংকটি যদি সঠিক হয় তাহলে খরচের দিক থেকে দেশের অন্যান্য সেচ প্রকল্পের মধ্যে এটিই সস্তায় করা হয়েছে।
আগেই বলা হয়েছে তিস্তা ব্যারেজ বাংলাদেশের সবচে বড় সেচ প্রকল্প। এটি গঙ্গা কপোতাক্ষ প্রকল্পের ৪ গুণ, চাঁদপুর প্রকল্পের ১২ গুণ এবং মেঘনা ধনাগদা প্রকল্পের ৪০ গুণ। গড়পড়তা খরচে হেক্টর প্রতি ব্যয় করা হয়েছে ১৯৯০ সালের বাংলাদেশী মুদ্রায় ২৭ হাজার টাকা।
কিন্তু পানি সম্পদে অন্যান্য সকল প্রকল্পের দুর্ভাগ্যের সাথে এ প্রকল্পটিও মুখ থুবড়ে পরে আছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা প্রায় ৫৫ টি। সবগুলো নদীতেই প্রায় বাঁধ দিয়ে অথবা খাল কেটে পানি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে গেছে। শুস্ক মওসুমে পানি থাকেনা অনেক নদীতে। প্রমত্তা পদ্মা নদীতে শীতকালে হাঁটু জল। আর তিস্তায় ব্যারেজের উজানে ধুম করে সরবরাহ নেমে যায় ৫০০০ কিউসেক থেকে ৫০০ কিউসেকে। এ দিয়ে ৫০ হাজার হেক্টর জমিতেও পানি দিয়ে জমি আবাদ কঠিন হয়ে পরে। লালমনিরহাট জেলা সহ পার্শবর্তী জেলাগুলো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উত্তরবঙ্গের মঙ্গা নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও মূল সমস্যা এই জলরাজনীতি।
রাজনীতি প্রসঙ্গ যখন এলোই তাহলে তৃতীয় নয়নে একটু নিরপেক্ষ খোলা দৃষ্টিতে দেখা যাক। ১৯৩৫ সাল থেকেই ব্রিটিশ ভারত সরকার এ এলাকার কৃষকদের জন্য তিস্তার উপর ব্যারেজ বা আড়াআড়ি বাঁধ নির্মাণের কথা ভেবে আসছিলেন। বিশ্বে তখন সেচ কাজে বাঁধ নির্মাণের জয়জয়কার। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। হুভার ড্যাম সহ বড় বড় বাঁধ হয়েছে না হচ্ছে। একই সময়ে কাপ্তাই লেকেও জলবিদ্যুতের জন্য বাঁধের কথা ভাবা হচ্ছে।
সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলা ভীষণ অবহেলিত হয়ে পরে। ভারতের কাছে পশ্চিমবঙ্গ যে গুরুত্ত্ব পেয়েছে, পাকিস্তানের মানচিত্রে পূর্ববঙ্গ তার ৫ ভাগ গুরুত্ত্ব পায়নি। আইয়ুব খানের সামরিক সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর তুলনামূলক পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে কিছু উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই অফিসিয়ালি এ সময় কালেই করা হয়। ১৯৫৮ সালে ক্ষমতা নিয়ে পরের বছর ১৯৫৯ সালে সমীক্ষা করা হয়।
দেশ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সীমিত বাজেটেও একেবারের জন্য এর ডিজাইন ড্রয়িং বন্ধ করে দেননি। আর ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের সরকার সরাসরি নির্মাণ কাজ শুরু করে দেন। এরশাদ সরকারের পুরো আমল জুড়ে এগিয়ে চলে এ প্রকল্প। সুতরাং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণের ব্যাপারে কোনো সরকারেরই তেমন কোনো গাফলতি চোখে পড়েনা।
তাহলে প্রকল্প অকার্যকর পড়ে থাকার কারণ কি? এটি পুরোপুরি আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি এবং জল-রাজনীতির যাঁতাকল। যে যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশ। অভিন্ন নদীগুলো থেকে ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহার নদীগুলোকে শুস্ক মওসুমে চরাঞ্চলে পরিণত করছে। শুকনো বালুচরে কৃষকের কপাল আছড়ানোর দৃশ্য ভারতের বড় বড় রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিগোচর হলেও সমস্যা সমাধানে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছেনা। কেন্দ্রীয় সরকার রাজি হলে প্রাদেশিক সরকার বাধা দেয়। প্রাদেশিক সরকার জলের ভাগ দিতে চাইলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চোখ উল্টিয়ে বসে। বিগত কয়েক দশক হলো আঞ্চলিক রাজনীতিতে এ খেলাই চলছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলগুলো এবং শিল্প ও বণিক সমিতিগুলো এ নিয়ে তেমন সোচ্চার নন। কেনোনা, বলির পাঠা তো কেবল বাংলাদেশের কৃষক সমাজ।

ব্রামটন, অন্টারিও, কানাডা

- Advertisement -

Read More

Recent